আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ছিল, আর এখন মবের ভীতি: কামাল আহমেদ
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর, ২০২৫, ০১:৪৫ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর এক আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ছিল। আশা ছিল, সাংবাদিকেরা তাদের কলম খুলে লিখবেন। কিন্তু এখন মবের ভীতি। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছি না।’

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কামাল আহমেদ এসব কথা বলেন। আজ বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

কামাল আহমেদ বলেন, ‘গণ–আন্দোলনের মাধ্যমে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটার পরে দেশ ও জাতির মধ্যে একটা বড় ধরনের প্রত্যাশা ছিল যে সত্যিই একটা বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে পাব। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও সে রকমই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। দেশে একটা অত্যন্ত ভাইব্রেন্ট মিডিয়া আমরা তৈরি করতে পারব, যা গণতন্ত্রকে সাহায্য ও সমৃদ্ধ করে।’

কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে কামাল আহমেদ  বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম তখনই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, যখন তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হবে। যদি আর্থিক স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। সেই নির্ভরশীলতার কারণেই যতটুকু আমি নির্ভরশীল হব, ততটুকুই আমার স্বাধীনতা ছাড় দেব। কম্প্রমাইজ করব খর্বভাবে।’

সুপারিশ প্রতিবেদন গত মে মাসেই জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে আমাদের বলা হলো যে আশু করণীয় ঠিক করে দেন, যেগুলো খুব দ্রুত করা যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই করে দিলাম সেটা। তারপর তো ডেফিনেটলি (নিশ্চিতভাবে) আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে অন্তত আশু করণীয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হবে এবং কিছু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো যে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু দৃশ্যমান হয়নি। আর দৃশ্যমান না হওয়াটা কমিশনের সদস্যদের জন্য খুব বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে গেছে।’  

সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইনের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘কমিশন থেকে সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইন করার জন্য বলেছিলাম। যাতে আইনের কাজটা খুব দ্রুতগতিতে সরকার করতে পারে, সে জন্য একটা খসড়াও তৈরি করে দিয়েছিলাম। অধ্যাদেশটা সরকার যদি শুধু তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দিত জনমত নেওয়ার জন্য, তাহলে এত দিনে সেই মে মাস থেকে আজকে অক্টোবর শেষ...তাহলে এর মধ্যে কিন্তু সেটা সম্ভব হতো। কোথায় কী ত্রুটি আছে, সেই খসড় আইনের ভাষায় অথবা কোথায় কী পরিবর্তন দরকার, সেগুলো সবকিছুই।’

কিন্তু সেটা মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয় জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁদের নিজেদের মধ্যে ওটার মূল্যায়ন করার একটা উদ্যোগ নিয়েছেন, মূল্যায়ন করেছেন। মূল্যায়ন করে তাঁরা যে পরিবর্তন প্রস্তাব করেছেন, তাতে আর ওই আইন না করাই ভালো। কারণ, ওই আইন করার যে উদ্দেশ্য ছিল, সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি খর্ব করে ওনারা এই নাম অপব্যবহার করে একটা আইন করতে চাইছেন।

কামাল আহমেদ আরও বলেন, ‘গতকালই ঢাকার জেলা আদালতে তিনজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই আইন যদি হতো, তাহলে এই সাংবাদিকদের রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হতো। তাঁদের হয়তো এই হয়রানি, এই দুর্ভাগ্য হতো না। এখন আসলে যেটা হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না, তার উল্টোটা হচ্ছে। আমরা সাংবাদিকেরা মনখুলে, কলমখুলে লিখব—এমন আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন কী হচ্ছে, একটা মবের ভীতি। এই মবের ভীতি কেন থাকবে? কারণটা হচ্ছে, সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি যেমন, ঠিক তেমনি এটা ঠেকানোরও চেষ্টা নেই।’

সংস্কারের সুপারিশের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘যতগুলো বিষয়ের পরামর্শ দিলাম, সেগুলোর কোনোটার ক্ষেত্রেই কোনো অগ্রাধিকার আমরা দিচ্ছি না। এর মধ্যে অনেকবার আমরা সরকারের তরফ থেকে বক্তব্য শুনেছি। বিশেষ করে তথ্য উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন যে তাঁরা এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেবেন। তিনি স্পষ্ট করে এই সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন সম্পর্কেই বলেছেন যে আর কিছু না হোক এটা তাঁরা করবেন।’

কামাল আহমেদ আরও বলেন, ‘সংস্কারের সুপারিশগুলো নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার কথা আমি শুরুতে বলেছিলাম। যে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তন, এসেছে সেই পরিবর্তন থেকে অনেকের মধ্যেই একটা বড় সম্ভাবনা, বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণের কোনো আলামত আজ পর্যন্ত আমরা দেখছি না। তিনি  রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কাছে তাঁরা ক্ষমতায় গেলে সুপারিশ বাস্তবায়নের কীভাবে করবেন, সেটা জানতে চান।’

কামাল আহমেদ জানান, তাঁরা অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারের সুপারিশ তৈরির পরিকল্পনা করেন। গণমাধ্যমশিল্পে জড়িত প্রধান অংশীজন মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক এবং অন্যান্য, বিশেষ করে পাঠক-দর্শকদের একটা মতামত নেওয়া হয়। জাতীয় জনমত সমীক্ষাও করা হয়। জরিপে ৪৫ হাজার মানুষের মতামত নেওয়া হয়।

গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরীন, নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) সদস্য এ কে আজাদ, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম, সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের (বিজেসি) সভাপতি ও মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রাজা, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান মওদুদ হোসেন আলমগীর (পাভেল), এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম রেজওয়ান উল আলম, এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান প্রমুখ।

এলএইস/