ডাকসু ভিপির সাম্প্রতিক বক্তব্য ও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নোক্তা
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর, ২০২৫, ০৭:৪৫ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

আবু সাঈদ

ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের একটি বক্তব্য নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এতে তার রাজনৈতিক দর্শন খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বিষয়টি একটু স্পষ্ট করে বলা যাক।

ডাকসু ভিপি বললেন, ‘বিজেপি বা তালেবানি ধাঁচে দেশ চালাতে চান না।’ বিজেপির ধাঁচ যে খারাপ, এটি বলাই বাহুল্য। তবে তালেবানি ধারাকে তিনি বিজেপির পাল্লায় মেপেছেন। এটি তার বড় ধরনের পদস্খলন। কারণ, বিজেপির সাথে কোনোদিক থেকেই তালেবানের মিলঝিল নেই। বরং তালেবান শরিয়াহ প্রদর্শিত উত্তম পন্থায় শরিয়াহ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

জামায়াতের ঊর্ধ্বতন নেতারা তো এখন খেলাফতব্যবস্থা চান না, তা রাখঢাক ছাড়াই প্রচার করছেন। তবে তাদের বক্তব্যে ইকামাতে দ্বীনের আশ্বাস দেখা যায়। কিন্তু কথা হলো, ইকামাতের দ্বীনের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদগণ বলেন, পুরো দ্বীনকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। সংক্ষিপ্ত ভাষায় বললে, সমাজে দ্বীনকে বিজয়ী করা। দ্বীনকে বিজয়ী করা খেলাফত ছাড়া তো সম্ভবই নয়। তারা যদি খেলাফতই প্রতিষ্ঠা করতে না চান, তাহলে ইকামতে দ্বীন কীভাবে করবেন? খেলাফতব্যবস্থা চান না বলে তো প্রকারান্তরে ইকামতে দ্বীনকেই ডিনেই করছেন।

খেলাফত প্রতিষ্ঠার রূপরেখা ইস্যুতে তালেবান যে পথে এগোচ্ছে, তা হয়তো আমাদের দেশে সম্ভব নয়। সেজন্য গণতান্ত্রিক পন্থাকে আশ্রয় করে ইসলামের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, এরপর ব্যাপক জনসমর্থনের মাধ্যমে খেলাফতের দিকে অগ্রসর হওয়া অনেক দূরবর্তী প্রসেস; এছাড়া এই প্রসেসে অগ্রসর হয়ে খেলাফত কায়েম করা দুঃসাধ্য পর্যায়ের, ইখওয়ানের ব্যর্থতা যা প্রমাণ করে; তথাপি এই প্রক্রিয়াকে আমলে নিলেও এটি শরিয়তপ্রদর্শিত উত্তম পন্থা নয়। 

তো তালেবানি ধারা উত্তম পন্থা, জা.শি. বা জামায়াত যে ধারায় এগোচ্ছে, তা হলো সাময়িক সমর্থনযোগ্য পন্থা। তাহলে সাময়িক সমর্থনযোগ্য পন্থা অবলম্বন করে উত্তম পন্থাকে ইগনোর করা কি বোকামি নয়? তাদের তো উচিত ছিল তালেবানি পন্থার প্রতি অবনত শির থাকা। কারণ, তাদের যেটা করা দরকার ছিল, সেটা তারা পারছে না, তালেবান পারছে। কিন্তু তারা কৃতজ্ঞ না হয়ে উল্টো উন্নাসিক হয়ে গেল।

মোটকথা, বিজেপির সাথে তালেবানি ধারাকে মিলিয়ে একদিকে শরিয়াহ প্রদর্শিত ইকামতে দ্বীনের পন্থাকে অবজ্ঞা করেছে। অন্যদিকে, একটি নিকৃষ্টতম উগ্রাবাদের সাথে মিলিয়ে সত্যপন্থার প্রতি বিরূপ ধারণা জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছে। যা তালেবানের প্রতি একধরনের অন্যায়।

দুই. ভিপি সাহেব জুলাইয়ের শহীদদের স্বপ্নের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে চান। এখন জুলাইয়ের শহীদ যারা, তাদের অধিকাংশই ইসলামপন্থায় বিশ্বাসী। তাদের বিভিন্ন সময়ের ফেসবুক পোস্টে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আবেগ প্রতিফলিত হয়েছে। এর মানে, তারা যেহেতু একাডেমিশিয়ান ইসলামিস্ট নন, স্বভাবতই একাডেমিশিয়ান আলেমদের প্রদর্শিত পন্থাতেই তারা আস্থা রাখছেন। আর একাডেমিশিয়ান আলেমরা তালেবানি ধারাকে আজিমত বা উত্তম পন্থা জ্ঞান করেন, তার মানে জুলাই শহীদদের স্বপ্নও এমন ছিল। তাহলে ভিপি সাহেব জুলাইয়ের শহীদদের স্বপ্নের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণ বলতে কী বোঝাতে চান? এর মাধ্যমে তিনি কি আসলেই জুলাই শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান না এমন অস্পষ্ট বুলি আওড়িতে নিজের মতাদর্শকেই সমুন্নত করতে চান?

তিন. জা.শি. অনেকেই ইকামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চান। এর সর্বোত্তম মডেল তো তালেবানি ধারা। কিন্তু এটাকে যখন তারা অস্বীকার করছেন, তাহলে উচিত ছিল তারা নিজেরা কোনো মডেল উপস্থাপন করা। কিন্তু জামায়াতের কি এমন সাধ্য বা মুরোদ আছে যে, তারা একটা মডেল পেশ করতে পারবে? তাদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বদের কথাবার্তায় কখনোই বোঝার সুযোগ নেই যে, তারা গতানুগতিক মডেলের বাইরে ভিন্ন কোনো মডেলে ইকামতে দ্বীন করতে চান। জামায়াতসহ যারাই ইকামতে দ্বীন করতে চান, তাদেরই উচিত নিজ নিজ মডেল সামনে নিয়ে আসা।

চার. আজকাল জা.শি.র অনেকেই নিজ মতামতের পক্ষে বস্তাপচা নানান উদ্ধৃতি নিয়ে আসেন। এখানেই তারা মাওলানা মওদুদীর মতোই ভুলটা করছেন। মনে রাখবেন, কোনো বইয়ে একটি কথা থাকার অর্থ এই নয় যে, ওই কথাটি গ্রহণযোগ্য। বরং যেকোনো কথা গ্রহণ করার শরিয়ত প্রদর্শিত নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। ওই পদ্ধতিতে আপনি অগ্রসর না হলে বিভ্রান্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে। উলামায়ে কেরাম মাওলানা মওদুদীর যেসব ভুল ধরেছেন, সেগুলোর রেফারেন্স মাওলানার কাছে ছিল। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য রেফারেন্স ছিল না। ফলে তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে। এখন আপনারাও যদি একই পথে হাঁটেন, তাহলে সত্যপন্থায় উঠতে পারবেন না। বিষয়গুলো মাথায় রাইখেন।

পাঁচ. তালেবানি ধারাকে জা.শি. পছন্দ করে না। এর নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে দুটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক. পাকিস্তানি প্রীতি; দুই. তালেবান দেওবন্দী আদর্শ মেনে চলে। আর দেওবন্দের সাথে জাশির দূরত্ব ঐতিহাসিক। এছাড়া আফগানি জামায়াত প্রসঙ্গ, মডেল সংকটসহ আরও কিছু কারণে তারা তালেবানি ধারাকে পছন্দ করে না।

লেখক: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

এলএইস/