জামায়াতের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে উঠছেন আমীর হামজা!
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর, ২০২৫, ০২:৩৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

বিশেষ প্রতিনিধি

বিভিন্ন সময় বেফাঁস বক্তব্য দিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত হন ইসলামি বক্তা মুফতি আমীর হামজা। বিতর্ক যেন তাকে কোনোভাবেই পিছু ছাড়ে না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সতর্ক থাকবেন-এমন ঘোষণার পরও একের পর এক বক্তব্যের মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলছেন তিনি। সবশেষ কওমি মাদরাসাপড়ুয়া ও দেওবন্দি আলেমদের নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন আমীর হামজা। আলোচিত এই বক্তা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে জামায়াতের মনোনয়নও পেয়েছেন।

তবে এই বক্তা জামায়াতের জন্য দিন দিন গলার কাঁটা হয়ে উঠছেন। তার এক একটি বক্তব্য জামায়াতকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী যখন দিন দিন রাজনীতিতে তাদের অবস্থান পোক্ত করছে তখন আমীর হামজার মতো বক্তাদের বিতর্কিত বক্তব্য দলটিকে চরমভাবে বিব্রত করছে।

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী তাদের ঘরানার বক্তাদের নিয়ে ঢাকায় দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করেছে। সেখানে দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে-ময়দানে কীভাবে বক্তব্য দিতে হবে; কী বলা যাবে, কী বলা যাবে না- এসব বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আমীর হামজা, তারেক মনোয়ারদের মতো জামায়াতপন্থী বক্তারা এতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছেন বলে মনে হয়নি। এখনো তারা সেই পুরনো ভঙ্গিতেই কথা বলে যাচ্ছেন।

নসিহতমূলক সেই অনুষ্ঠানের রেশ কাটতে না কাটতেই আমীর হামজা গোটা কওমি অঙ্গন নিয়ে বিষোদগার করেছেন। তিনি তাদের কূপমণ্ডুপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দীন কায়েমের পথে কওমিপড়ুয়াদের বাধা হিসেবে অভিহিত করেছেন। বলেছেন, কওমি মাদরাসাপড়ুয়ারা চারদেয়ালে বন্দি। তাদের জীবনের স্বপ্ন একটি মসজিদ আর একটি মাদরাসা। এর বাইরে তারা কিছু ভাবতে পারেন না। এর বাইরে যে জগৎ আছে সেটা না জানার কারণে দীন কায়েমের পথে কওমি মাদরাসা এবং দেওবন্দি আলেমরা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।

আমীর হামজার এই বক্তব্যে কওমি মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই তাকে তুলোধুনো করছেন। তারা বলছেন, কথিত ‘ভার্সিটির মাল’ আমীর হামজারা যখন আলিয়া মাদরাসায় কিছু পড়াশোনা করে দুনিয়ার লোভে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে যাচ্ছেন তখন খেয়ে-না খেয়ে দীনের প্রকৃত ঝান্ডা কওমিপড়ুয়ারাই ধরে রাখছেন। বৈষয়িক প্রাপ্তির চেয়ে তাদের কাছে দীনি খেদমতই মুখ্য। এজন্য তারা নিজের জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে হলেও এদেশে দীনের চাষবাস যেন টিকে থাকে সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। 

তারা বলছেন, দীনি ইলমের চর্চা এবং দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কওমির ধারেকাছেও নেই আলিয়া। কওমি আলেমদের অবদানের কথা সর্বমহলে স্বীকৃত। খোদ জামায়াতের নেতারাও সেটা স্বীকার করেন। দলটির আলোচিত নেতা মরহুম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বিভিন্ন সময় কওমি আলেমদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কওমি ও আলিয়াকে দুই চোখ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জামায়াতি ঘরানার আলেম হিসেবে পরিচিত মাওলানা কাজী ইবরাহিম প্রকাশ্যে বলেছেন, কওমি আলেমরা না থাকলে এদেশে দীনের প্রকৃত ধারা অক্ষুণ্ন থাকতো না। এই অবস্থায় আমীর হামজার মতো একজন ‘বাজারি’ ও ‘বিতর্কিত’ বক্তার এই বক্তব্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

শুধু আমির হামজাই নয়, এর আগে জামায়াতের বক্তা হিসেবে পরিচিত মাওলানা তারেক মনোয়ার দরসে নেজামির আলেমদের মসজিদগুলো থেকে বের করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিতর্কিত হন। তার দাবি, কওমি আলেমরা ফ্যসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের সঙ্গে তাল দিয়ে চলেছেন। এজন্য এখন তাদেরকে মসজিদের ইমামতি থেকে বের করে দিয়ে জামায়াতপন্থীদের ঢোকাতে হবে। অথচ গত ১৬ বছর কওমি আলেমদের জেল-জুলুমের কথা গোটা জাতি জানে।

মাওলানা আমীর হামজা কিংবা তারেক মনোয়াররা এমন একটা সময় কওমি মাদরাসা কিংবা দেওবন্দি আলেমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন, যখন জামায়াতে ইসলামী অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট বা ভোটের সমঝোতা করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামি দল জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে। আগামী নির্বাচনে তাদের মধ্যে জোট বা সমঝোতা হওয়ার একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। 

এদিকে আমীর হামজার এই বক্তব্যে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলামীও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলছিলেন, আমরা শত চেষ্টা করেও চিহ্নিত কয়েকজন বক্তাকে থামাতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমাদের দলের অভ্যন্তরে আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত আমীর হামজার মনোনয়ন বাতিলও হতে পারে। ইতোমধ্যে তাকে সতর্ক করা হয়েছে। সম্প্রতি বক্তাদের নিয়ে যে প্রোগ্রাম জামায়াত করেছে সেখানে মূলত আমীর হামজা ও তারেক মনোয়ারদের মতো বিতর্কিতদের উদ্দেশ্য করেই সব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আড়াই বছর কারা নির্যাতনের শিকার হন মুফতি আমীর হামজা। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিভিন্ন মাহফিলে নানা বক্তব্য দিয়ে বারবার বিতর্কিত হন তিনি। কখনো আল্লাহর কথা স্মরণ করে ভারতীয় নায়িকা রাশমিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলেন। কখনো নিজেকে ‘ভার্সিটির মাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কখনো নবীজিকে ‘সাংবাদিক’ বলে অভিহিত করেন। কখনো ভুয়া, আজগুবি তথ্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন এই বক্তা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আমীর হামজার মতো বক্তাদের মুখে লাগাম না টানতে পারলে রাজনীতির ময়দানে জামায়াতের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে আলেমদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দল হিসেবে জামায়াত যখন চেষ্টা চালাচ্ছে তখন বিতর্কিত এসব বক্তার বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আরএইচ/