তালেবান সরকার: দেওবন্দি উলামার ত্যাগ, তিতিক্ষা ও চিন্তাধারার ফল
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:০৮ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

সম্প্রতি ভারত সফর করেন আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকি। এ সময় তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ সফর করেন। সেখানে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁর আগমন উপলক্ষে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানীর পক্ষে একটি স্বাগত ভাষণ দেওয়া হয়। সেই ভাষণের বাংলা অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো। ভাষণটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন: আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার তাফসির বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক সলিমুদ্দিন মাহদী কাসেমী।

হামদ ও সালাতের পর,

সম্মানিত ইসলামিক ইমারাত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মর্যাদাবান ইমারাত প্রতিনিধি মণ্ডলী ও সম্মানিত অতিথিবৃন্দ!

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

আজ আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ আল্লাহ তাআলার শুকর ও আনন্দে। আমরা এই মহৎ ধর্মীয় ও চিন্তাশীল শিক্ষাকেন্দ্র—দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাঙ্গণে, আপনার মতো সম্মানিত অতিথিকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনাকে বলছি “মারহাবা ও খুশ আমদীদ”, এবং হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আজ দারুল উলূম দেওবন্দের বাতাস এক বিশেষ আত্মিক আবহে ভরপুর। এই সেই প্রতিষ্ঠান, যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল জ্ঞান, ঈমান ও স্বাধীনতার ওপর।

আজ ইসলামিক ইমারাত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগমন দারুল উলূমের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করছে।

এটি কেবল একটি সাক্ষাৎ নয়, বরং আত্মিক সম্পর্ক ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পুনর্নবীকরণ।

দেওবন্দ ও আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক:

ভারত সফর আপনার জন্য যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। এই সাক্ষাৎ কোনো সরকারের নয়, বরং হৃদয়ের সংলাপ। দারুল উলূম দেওবন্দ—যা উপমহাদেশের ধর্মীয় চেতনা ও চিন্তার কেন্দ্র—এমন এক ঐক্যের প্রতীক, যা যুগে যুগে আলোকিত হয়ে আছে।

১৮৬৬ সালে (১২৮৩ হিজরি) প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম দেওবন্দ:

শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি ছিল উপমহাদেশে ধর্মীয় জাগরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ইসলামী পরিচয় রক্ষার এক মহান আন্দোলন।

যখন পরাধীন ভারতের বুকে ঈমানের আলো ম্লান হচ্ছিল,

তখন কয়েকজন নিষ্ঠাবান আলেম মসজিদ ছত্তার নিচে, ডালিমগাছের তলায়, মাটির উপর বসে একটি প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন—যার আলো আজও সমগ্র উপমহাদেশকে আলোকিত করছে।

দারুল উলূম কেবল শিক্ষা কেন্দ্র নয়, বরং এটি এক চিন্তাধারার মাদার ইনস্টিটিউশন, যা ইসলামের সংরক্ষণ, শরিয়তের ধারাবাহিকতা ও মুসলিম উম্মাহর স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

শাহ ওলিউল্লাহ থেকে শাইখুল হিন্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা:

দারুল উলূম আসলে সেই আত্মিক ধারার সম্প্রসারণ,

যার সূচনা হয়েছিল হযরত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী (রহ.) এর মাধ্যমে, এবং যা মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতভী (রহ.), মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী (রহ.), ও শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহ.)-এর হাত ধরে একটি আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে রূপ নেয়। শাইখুল হিন্দ সেই মুক্তিকামী মানুষ, যিনি কুরআনের তাফসিরের সঙ্গে স্বাধীনতার ব্যাখ্যাও লিখেছিলেন। তিনি শিখেছিলেন—

‘যে জাতি থেকে জ্ঞান কেড়ে নেওয়া হয়, তার স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়।’ তাই তিনি মাদ্রাসার তক্তিতে লেখা পাঠকে স্বাধীনতার ম্যানিফেস্টোতে রূপান্তরিত করেন।

রেশমি রুমাল আন্দোলন ও আফগান সংযোগ:

“রেশমি রুমাল আন্দোলন” ছিল সেই দৃঢ়তা ও ত্যাগের প্রতীক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শাইখুল হিন্দ তাঁর সহচরদের নিয়ে এক গোপন পরিকল্পনা করেন। তিনি জানতেন—যদি কোনো জাতি ঈমান, আত্মসম্মান ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়, তবে তা হলো আফগান জাতি।

তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী (রহ.)

ও মাওলানা মনসুর আনসারী (রহ.)-কে আফগানিস্তানে পাঠান, যাতে সেখান থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম নতুন দিশা পায়।

আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী স্বাধীন হিন্দ সরকার ছিল সেই চিন্তা ও আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা। এর সভাপতি ছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিং, প্রধানমন্ত্রী মাওলানা বারকাতুল্লাহ ভোপালী (রহ.) এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী (রহ.)।

তাঁরা চেয়েছিলেন কাবুল, ইস্তাম্বুল ও ভারতের মুজাহিদদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে। এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং চিন্তা ও আত্মার বন্ধনও ছিল। দেওবন্দ ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক তাই এই রেশমি রুমাল আন্দোলনের মধ্যেই মূলত গাঁথা, যা পরে জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিনিময়ে আরও দৃঢ় হয়েছে।

ত্যাগ, কারাবাস ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার:

এই নিষ্ঠা ও আনুগত্যের অপরাধে শাইখুল হিন্দ (রহ.) ও তাঁর সঙ্গীরা—মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), মাওলানা আজির গুল (রহ.) প্রমুখ— মাল্টার অন্ধকার কারাগারে বন্দি হন। কিন্তু তাদের সেই ত্যাগ স্বাধীনতার এমন প্রদীপ প্রজ্বলিত করে যার আলো আজও ভারত ও আফগানিস্তানের হৃদয়ে জ্বলে।

আফগানিস্তানের অবদান ও সম্পর্কের দৃঢ়তা:

দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দেশ হিসেবে আফগানিস্তানই এই প্রতিষ্ঠানকে বরণ করে নেয়। আফগান তরুণরা এসে এখানে জ্ঞান অর্জন করে নিজ দেশে ঈমান ও শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিল।

১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত আফগানিস্তানের শত শত ছাত্র এখানে অধ্যয়ন করেছেন। বিভাজনের পর দেওবন্দের ফারেগ আলেমরা বিভিন্ন স্থানে একই চিন্তাধারায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং আজও সেই বারকতময় ধারা প্রবাহিত হচ্ছে।

রাজা জাহির শাহ ও বাবুয্-জাহির ফটক:

হাকিমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মদ তাইয়্যিব (রহ.)-এর আমলে আফগান রাজা জাহির শাহ দারুল উলূমের প্রতি তাঁর হৃদয়গ্রাহী সম্পর্ক প্রকাশ করেন। তাঁর অনুদানে ১৩৫৯ হিজরি/১৯৪০ সালে দারুল হাদীস ভবনের পশ্চিম পাশে নির্মিত হয় বাবুয্-জাহির নামক মনোরম ফটক, যার ভিত্তি স্থাপন করেন নবাব সদর ইয়ার জং মাওলানা হাবীবুর রহমান শরওয়ানী (রহ.), এবং ১৯৪২ সালে তা সম্পন্ন হয়।

এটি কেবল ইট-পাথরের দরজা নয়, বরং ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও আফগান-মৈত্রীর প্রতীক, যা আজও দেওবন্দের মাটিতে প্রোথিত। ১৯৫৮ সালে রাজা জাহির শাহ স্বয়ং দারুল উলূম দেওবন্দ সফর করেন।

বর্তমান সফর ও আশাবাদ:

আজ ইসলামিক ইমারাত আফগানিস্তানের সম্মানিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকি (হাফিজাহুল্লাহ) দারুল উলূমে আগমন করেছেন—এটি সেই আত্মিক সম্পর্কের পুনর্জাগরণ। আজকের আফগানিস্তান, নানা পরীক্ষার মধ্যেও, ঈমান, দৃঢ়তা ও স্বাধীনতার প্রতীক।

ইসলামিক ইমারাত আফগানিস্তান যে অটলতা প্রদর্শন করেছে ধর্মীয় পরিচয়, শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে—তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য গর্বের বিষয়।

আমরা সম্মানিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে আমিরুল মুমিনীন হযরত হিবতুল্লাহ আখুন্দজাদা (হাফিজাহুল্লাহ) ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং সমগ্র আফগান জাতির প্রতি ভালোবাসা ও সালামের শুভেচ্ছা জানাই।

আমরা ভারত সরকারের প্রতিও কৃতজ্ঞ, যে তারা আমাদেরকে এই মহিমান্বিত অতিথির স্বাগত জানানোর সুযোগ দিয়েছেন।

আমরা আশা করি— এই সফরের মাধ্যমে ভারত–আফগান সম্পর্ক আরও গভীর হবে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিনিময় বাড়বে, এবং আফগানিস্তান সমৃদ্ধি ও কল্যাণের নতুন অধ্যায় রচনা করবে।

দোয়া ও সমাপ্তি:

আমরা দোয়া করি—আমাদের দেশ ভারত যেন শান্তি ও সম্প্রীতির অঙ্গন হিসেবে অগ্রগতির পথে অটল থাকে, আর আফগানিস্তান যেন থাকে জ্ঞান ও শান্তির কেন্দ্র, যার সঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন চিরকাল অটুট থাকে।

আমরা আশাবাদী যে, দেওবন্দ ও কাবুলের সম্পর্ক এখন আর কেবল ঐতিহাসিক নয়, বরং এটি জ্ঞান-বিনিময়, সাংস্কৃতিক সংযোগ ও চিন্তাশীল সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা। এটাই ছিল শাইখুল হিন্দের স্বপ্ন—যাতে জ্ঞান ও অঙ্গীকার পাশাপাশি চলে, এবং উম্মাহর ক্ষতগুলো জ্ঞান ও ভালোবাসার আলোয় আরোগ্য লাভ করে।

শেষ কথা:

সম্মানিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়!

দেওবন্দ আপনারই ঘর। এ সেই বাগান, যার প্রতিটি পাতা ঈমানের সুঘ্রাণে ভরা, যার প্রদীপ উম্মাহর পথ আলোকিত করে। আপনার আগমনে এই পরিবেশ আরও দীপ্ত ও প্রাণবন্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যেন এই ভালোবাসাকে চিরস্থায়ী করেন, এই সম্পর্ককে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব দান করেন, এবং জ্ঞান ও ঈমানের এই বন্ধনকে কিয়ামত পর্যন্ত অটুট রাখেন।

সালামান্তে:

মুফতি আবুল কাসেম নোমানী

মুহতামিম, দারুল উলূম দেওবন্দ

তারিখ:

১৮ রবিউস সানি ১৪৪৭ হিজরি

১১ অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

এলএইস/