ইসলামি বইমেলা: বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজনেও সীমাবদ্ধতার নানা ছাপ
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর, ২০২৫, ০৪:৩৮ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পূর্ব প্লাজা ও দক্ষিণ সড়কে চলছে ইসলামি বইমেলা ২০২৫। সিরাতুন নবী (সা.) হিজরি ১৪৪৭ উপলক্ষে মাসব্যাপী এই মহোৎসব আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পবিত্র কোরআন ও হাদিস ছাড়াও দেশে প্রকাশিত ইসলামি বইয়ের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা ব্যাপক। অথচ ঢাকার অনেক সাধারণ মানুষই জানেন না এমন একটি মহৎ আয়োজন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সচেতনতার অভাব ও প্রচারণার ঘাটতি মেলাটিকে তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন থেকে বঞ্চিত করছে। মেলায় মোট স্টল রয়েছে ১৭৯টি। অংশ নিয়েছে ১৫০টি প্রকাশনা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

আন্তর্জাতিক মাত্রা, বিদেশি প্রকাশকদের আকর্ষণীয় অংশগ্রহণ

এবারের মেলায় প্রথমবারের মতো বিদেশি প্রকাশকরা অংশ নিয়েছেন। মিসর, জর্দান, লেবানন, পাকিস্তানসহ বিশ্বের নানা দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা এনেছে কোরআনের ব্যাখ্যা, নবীজির জীবনী এবং গবেষণাধর্মী বই। এতে ইসলামি বইমেলা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাত্রা। পাঠকদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যেখানে তারা এক মঞ্চে পেতে পারছেন দেশি-বিদেশি ইসলামি সাহিত্য।

আয়োজনের বৈচিত্র্য সীমাবদ্ধতা

মেলায় রয়েছে শিশুচত্বর, নারীদের আলাদা বসার জায়গা, লিটল ম্যাগাজিন কর্নার, লেখক কর্নার এবং তথ্যকেন্দ্র। শিশুদের চত্বরকে ঘিরে অভিভাবক ও ছোটদের ভিড় প্রতিদিনই বাড়ছে। তবে দুর্বলতার জায়গা হলো তথ্যকেন্দ্র। দর্শনার্থীরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না, স্টল নম্বর, সময়সূচি কিংবা বইয়ের তালিকা জানতে গিয়ে অনেকেই সমস্যায় পড়ছেন।

শিশুদের হাত ধরে ইসলামের জ্ঞানচর্চা

শিশুদের জন্য এবারের মেলায় রয়েছে ব্যতিক্রমী আয়োজন। সুকুন পাবলিশিং এনেছে আদব-আখলাক, মসজিদ ও আল্লাহর ১২ নামের গল্পভিত্তিক তিনটি সিরিজ এবং সিরাতনির্ভর ফ্ল্যাশকার্ড। নাশাত পাবলিকেশন প্রকাশ করেছে ২৪ খণ্ডের শিশুতোষ সিরিজ, যার উদ্দেশ্য শিশুদের ইসলামি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করা এবং বিভ্রান্তিকর বই থেকে দূরে রাখা। টুন টুন পাবলিকেশন নিয়ে এসেছে চার স্তরের বাংলা ও ইংরেজি সিরিজ, আর আতফাল দিয়েছে বিজ্ঞানীদের জীবনীভিত্তিক নতুন সিরিজ। ফিউচার উম্মাহ বিডি প্রায় ৩০টি বই প্রকাশ করেছে, যেগুলোর লক্ষ্য শক্তিশালী ইসলামি প্রজন্ম তৈরি। এসব আয়োজন প্রমাণ করে শিশুরাই আগামী দিনের আলো, আর ইসলামি বইমেলা সেই আলোর প্রদীপ জ্বালাতে কাজ করছে।

নবীজির জীবনী পাঠকের অবিচল আকর্ষণ

এবারও নবীজির জীবনীভিত্তিক বই পাঠকদের মাঝে বিশেষ সাড়া ফেলেছে। মাওলানা যাইনুল আবিদীনের লেখা ‘আমাদের নবীজি’ ইতোমধ্যেই পাঠকদের দৃষ্টি কাড়ছে। নবীজির জীবন ও আদর্শ নিয়ে যুগে যুগে অগণিত রচনা হয়েছে, আর প্রতিটি নতুন রচনা পাঠকের হৃদয়ে নতুন আলো জ্বালিয়েছে। ওয়াফি পাবলিকেশনও শিশুদের জন্য নবীজির জীবন ও নৈতিকতা সহজভাবে উপস্থাপন করেছে। নবীজির জীবনের শিক্ষা প্রতিটি যুগেই মানবতার দিশারি, আর ইসলামি বইমেলা সেই আলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে।

দর্শনার্থীর ঘাটতি, ক্রেতা যেন বাড়ছে না

যদিও মেলায় ১৭৯টি স্টল ও ১৫০টি প্রকাশক অংশ নিয়েছে, তবু লোকসমাগম প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। দেখা যাচ্ছে প্রধানত বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও কিছু শিশু অভিভাবকদের সঙ্গে এসে মেলাটিকে প্রাণবন্ত করছে। কিন্তু সাধারণ পাঠক ও নগরবাসীর উপস্থিতি খুবই সীমিত। কারণ, অনেকেই জানেই না ঢাকায় এতো বড় ইসলামি বইমেলা চলছে। ইসলামি ফাউন্ডেশনের প্রচারণার ঘাটতি এবং মূলধারার গণমাধ্যমের অনাগ্রহই এর অন্যতম কারণ। একুশে বইমেলার মতো মিডিয়া কাভারেজ পেলে ইসলামি বইমেলা আরও জনপ্রিয় হতে পারত।

পাঠক টানতে পরিকল্পিত উদ্যোগ

ইসলামি বইমেলাকে কেবল একটি প্রদর্শনী না বানিয়ে একে জনসম্পৃক্ত উৎসবে পরিণত করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ জরুরি। প্রথমত, মূলধারার মিডিয়ায় প্রচার বাড়াতে হবে। শুধু বিজ্ঞাপন নয়, টিভি টকশো, বিশেষ সংবাদ কাভারেজ, রেডিও প্রোগ্রাম এবং সামাজিক মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রচারণা ইসলামি বইমেলার পরিচিতি বহুগুণ বাড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, মেলাকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি নেওয়া উচিত, যেমন বই আলোচনা, ইসলামী সাহিত্যবিষয়ক সেমিনার, লেখক পাঠচক্র, শিশুদের জন্য গল্প বলা প্রতিযোগিতা এবং কোরআন তেলাওয়াতের আয়োজন। এগুলো দর্শনার্থীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করবে।

তৃতীয়ত, ইনফরমেশন সেন্টারকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করা জরুরি। বর্তমানে দর্শনার্থীরা সেখানে তেমন সেবা পাচ্ছেন না। ডিজিটাল ডিসপ্লে, মোবাইল অ্যাপ, কিংবা অনলাইন বুক ডিরেক্টরি চালু করা হলে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন কোন স্টলে কোন বই রয়েছে। চতুর্থত, মাদ্রাসার বাইরে সাধারণ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ আমন্ত্রণ, ছাড়ের কুপন বা স্টুডেন্ট ডে আয়োজন করলে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়বে।

সবশেষে, ইসলামকে জানার, বোঝার এবং জীবনে প্রয়োগ করার উপকরণ এই বইগুলোকে মানুষের সামনে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে হবে। শুধুমাত্র বিক্রি নয়, জ্ঞানচর্চা ও আত্মশুদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে ইসলামী বইমেলাকে গড়ে তোলা গেলে এটি একুশে বইমেলার মতোই সবার কাছে সমান গুরুত্ব পাবে।

লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট

আরএইচ/