বিশ্ব মেরিটাইম দিবসে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির স্মরণীয় একটি দিন
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর, ২০২৫, ১০:৪২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

||ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন||

বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণশক্তি যদি খুঁজে বের করতে চাই, তবে তা নিঃসন্দেহে সামুদ্রিক শিল্প। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খাদ্য, জ্বালানি, চিকিৎসা সামগ্রী কিংবা কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়ার পেছনে যে বিশাল নীরব অবদান রয়েছে, তা বহন করছে সমুদ্রপথ। এ অবদানকে সামনে এনে, নৌ-পরিবহনের নিরাপত্তা, সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরতেই প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার পালিত হয় বিশ্ব মেরিটাইম দিবস। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (আইএমও) এর উদ্যোগে পালিত এ দিন কেবল শিপিং শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্বই নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির প্রসারকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি সে উপলক্ষে আয়োজন করে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, কুইজ ও ব্যতিক্রমী আয়োজন।

শোভাযাত্রায় উৎসবের আবহ

২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব মেরিটাইম দিবস উপলক্ষে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিপিং অ্যান্ড ম্যারিটাইম সায়েন্স বিভাগ আয়োজন করে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শিক্ষার্থীদের হাতে ব্যানারফেস্টুন, মুখে সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার স্লোগান সব মিলিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয়ে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত পথজুড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। শোভাযাত্রার লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের মাঝে নৌপরিবহন খাতের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।

তত্ত্ব ও বাস্তবতার মেলবন্ধন

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিপিং অ্যান্ড ম্যারিটাইম সায়েন্স বিভাগ আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রমে পরিচালিত। এখানে শিক্ষার্থীদের শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দক্ষ করে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। বিভাগে রয়েছে নটিক্যাল সায়েন্স, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও টেকসই শিপিং সংক্রান্ত বিশেষায়ন। আধুনিক ল্যাব, গবেষণাগার ও ফিল্ড ভিজিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠেন দেশের সামুদ্রিক খাতের ভবিষ্যৎ কর্ণধার।তত্ত্ব আর বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটাতে শিক্ষার্থীরা পরিদর্শনে যান হাতিরঝিল মেগা প্রকল্পে। সেখানে তারা পানিদূষণ, পরিবেশের ভারসাম্য ও টেকসই নগর উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করেন। কীভাবে নগর প্রকল্পগুলো দূষণমুক্ত রাখা যায়, কীভাবে পানি ব্যবস্থাপনা ও নৌপথকে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব এসব বিষয়ে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। গবেষণার ফলাফল নিয়ে তারা আলোচনা করে ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ করে। শুধু হাতিরঝিলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি। তারা যান তুরাগ নদীর তীরে, যেখানে নৌযাত্রা ও নদীপথের বাস্তব অবস্থা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। দূষণের প্রভাব, নৌযান চলাচলের সমস্যা এবং নাব্যতা সংকট সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তারা। এই অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের শুধু বইয়ের পাতায় নয়, বাস্তবতার মাটিতেও শিক্ষা দেয়।

হাতিরঝিল মেগা প্রকল্পের গুরুত্ব

ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হাতিরঝিল প্রকল্প আজ নগরবাসীর কাছে শুধু একটি লেক বা সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং এটি আধুনিক নগর পরিকল্পনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রায় ৩০০ একরের বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই মেগা প্রকল্পে রয়েছে লেক-ভিত্তিক নৌপরিবহন ব্যবস্থা, চারটি প্রধান সেতু, একাধিক ফ্লাইওভার, প্রায় ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়াকওয়ে, পার্ক এবং আধুনিক আলোকসজ্জা। এখানে নান্দনিক নকশার ব্রিজ ও ওয়াটারফ্রন্ট প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে টেনে আনে। হাতিরঝিলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকার যানজট কমানো, বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা এবং নগরবাসীর জন্য একটি সবুজ-বান্ধব বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা। শিপিং অ্যান্ড ম্যারিটাইম সায়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, "এখনো এই প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ রক্ষণাবেক্ষণ ও আশপাশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়ে গেছে। লেকের পানিদূষণ ও বর্জ্য ফেলা রোধ করা না গেলে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই হাতিরঝিলকে টেকসই রাখতে শুধু সরকারি তদারকি নয়, বরং নাগরিক সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণও অপরিহার্য।"

তুরাগ নদীর দূষিত চিত্র

 নদী শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।ঢাকার উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদী একসময় ছিল রাজধানীর প্রাণ। কিন্তু বর্তমানে এ নদী মারাত্মক দখল ও দূষণের কবলে পড়েছে। শিল্পবর্জ্য, আবাসিক বর্জ্য ও অবৈধ দখলের কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যাচ্ছে, যা জলাবদ্ধতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পর্যায়ে একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি।  শিক্ষার্থীরা পরিদর্শন করে লক্ষ্য করেন,  ‘নদীশাসন, শিল্পবর্জ্য শোধনাগার স্থাপন এবং নদীর দুইপাড়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি।  তুরাগ নদীর রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।’

মেধা যাচাই ও কুইজ প্রতিযোগিতা

দিনশেষে মূল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয় প্রাণবন্ত কুইজ প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হয় নৌপরিবহন শিল্প, সামুদ্রিক আইন, আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (আই এম ও)এর ভূমিকা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত নানা বিষয়ে। কুইজে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জ্ঞান ও মেধার প্রদর্শন করেন। এই প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতা ও শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি সম্পূর্ণ হয়।

নেপথ্যের চালিকাশক্তি

পুরো আয়োজনের নেতৃত্ব দেন শিপিং অ্যান্ড ম্যারিটাইম সায়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করুক। বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্র খাত সম্পর্কে জানুক, বুঝুক এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ। সমুদ্র খাতকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতির বড় পরিবর্তন সম্ভব, পাশাপাশি পরিবেশকেও রক্ষা করা যাবে।’ তার এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে এবং ভবিষ্যতের প্রতি নতুন প্রত্যয় জাগায়।

শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা

আয়োজন শেষে শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানান, এই ধরনের কার্যক্রম তাদের নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। কেউ বললেন, ‘বইয়ে পড়েছি, কিন্তু আজ হাতিরঝিলে গিয়ে বুঝলাম বাস্তব সমস্যাগুলো কত জটিল, এবং সেটা নিয়ে কতটা কাজ করতে হবে।’ কেউ আবার বললেন, ‘কুইজে অংশ নিয়ে জানলাম কত কিছুই এখনও শেখা বাকি।’ শিক্ষার্থীদের এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, দিনটি শুধু একটি দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ছিল তাদের শেখা, বেড়ে ওঠা ও নতুন স্বপ্ন দেখার দিন।

বিশ্ব মেরিটাইম দিবসের এ আয়োজন দেখিয়ে দিলো, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ কেবল তত্ত্বভিত্তিক শিক্ষা নয়, বরং বাস্তবমুখী জ্ঞান ও সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি করার দিকেও অঙ্গীকারবদ্ধ। সমুদ্র ও নৌপথ শুধু অর্থনীতির চালিকাশক্তিই নয়, তা পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নেরও হাতিয়ার। শিক্ষার্থীরা যদি আজ থেকে সচেতন হয়, আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে আরও শক্তিশালী, সবল এবং বিশ্বমানের সামুদ্রিক শক্তি।

লেখক: শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট

এনএইচ/