লাদাখের উত্থান: যখন পরিচয় ধর্মের ঊর্ধ্বে ঐক্য গড়ে তোলে
প্রকাশ:
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৬:১১ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
![]()
মুহাম্মাদ শোয়াইব ২৪ সেপ্টেম্বর লেহ-তে রক্তক্ষয়ী ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত এবং ষাটেরও বেশি মানুষ আহত হওয়া কেবল আইনশৃঙ্খলার ভেঙে পড়া নয়। এটি এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মুহূর্ত—একটি সংকেত যে লাদাখের মানুষ, হোক বৌদ্ধ বা মুসলিম, তারা উপেক্ষিত পরিচয়, অধিকার ও ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের ভঙ্গ প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্যমতে, পুলিশ গুলি চালানোর পর বিক্ষোভকারীরা বিজেপি অফিস ও একটি সিআরপিএফের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর প্রশাসন কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করে। ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে অন্তত ৪ জন নিহত এবং প্রায় ১০০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী অন্তত ৫০ জনকে আটক করেছে। বিক্ষোভকারীরা রাজ্যের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছিলেন। যা প্রেসিডেন্ট মুদি ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে রাজ্যটির বিশেষ মর্যাদা রহিত করে দিয়েছে। স্থানীয় মিডিয়ার তথ্যমতে, লেহ এপেক্স বডি (LAB) ডাকা ধর্মঘট সহিংসতায় রূপ নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। লেহসহ কারগিল, জান্সকার, নুব্রা, পদম, চাংথাং, দ্ৰাস ও লামায়ুরুতে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এইসব এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। লাদাখের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কবিন্দর গুপ্তা বলেন, “আরও হতাহতের ঘটনা এড়াতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কারফিউ জারি করা হয়েছে।” কারগিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকেশ কুমার ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (BNSS)-এর ১৬৩ ধারার অধীনে আদেশ জারি করে পাঁচজনের বেশি মানুষের জমায়েত, মিছিল কিংবা অনুমতি ছাড়া যে কোনো বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছেন। এছাড়া লাউডস্পিকার, সাউন্ড অ্যাম্পলিফায়ার বা গাড়ি-মাউন্ট করা মাইক ব্যবহারেও বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। কোনো ব্যক্তি লিখিত, মৌখিক বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন বক্তব্য দিতে পারবেন না যা জনশান্তি নষ্ট করতে পারে বা বিদ্বেষ উসকে দিতে পারে। মোটকথা, আন্দোলন দমন করার জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিক্ষোভ চলাকালে বিজেপি কার্যালয় এবং কয়েকটি পুলিশ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে চলমান ৩৫ দিনের অনশন থেকে। মঙ্গলবার অনশনে অংশগ্রহণকারী দুজনের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনশন ভেঙে সোনম ওয়াংচুক হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, “গত পাঁচ বছর আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছি, কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যে ৬ অক্টোবর আলোচনার দিন ধার্য করেছে, সেটিই তরুণদের অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে দেয়।” তিনি আরও বলেন, যে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে অন্তত তিন থেকে চারজন যুবক নিহত হয়েছেন। লেহ এপেক্স বডি (LAB) এবং কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (KDA)–এর নেতৃত্বে লাদাখে সাংবিধানিক অধিকার ও রাজনৈতিক দাবি আদায়ের এই বৃহত্তর আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯ সালে ভারত সরকার যখন অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে এবং জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করে, তখন স্থানীয়দের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বৃহত্তর স্বশাসন ও উন্নয়নের। কিন্তু ছয় বছর পর আজ লাদাখবাসী মনে করে যে, তারা প্রতারিত ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। তাদের রাজ্যের মর্যাদা, ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তি এবং জমি ও চাকরির উপর সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবি কোনো প্রান্তিক আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং বেঁচে থাকার লড়াই। হিন্দুস্তান টাইমস এবং দ্য ফেডারাল—উভয় পত্রিকাই জানিয়েছে, লাদাখের প্রতিবাদের মূল কারণ জমি ও পরিচয় হারানোর ভয়ের মধ্যে রয়েছে। যেহেতু বাইরের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। েএর মাধ্যমে তাদের জমি ও পরিচয় হুমকির মধ্যে পড়েছে। আজকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো লেহ-র বৌদ্ধ ও কারগিলের মুসলিমদের মধ্যে পুরোনো বিভাজন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ঐক্যের অনুভূতি। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উভয় অঞ্চলের নেতারা এখন একটি অভিন্ন লাদাখি পরিচয়ের সংগ্রামের কথা বলছেন। যেখানে অনুপ্রবেশ, পরিবেশগত ক্ষতি ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তনই এখনই প্রধান উদ্বেগের কারণ। গত কয়েক দশক ধরে যেখানে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে প্রাধান্য দেওয়া হতো, আজ সেখানে এক নতুন ঐক্যের সঞ্চার হয়েছে। সর্বশেষ বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে দুজন অনশনরত আন্দোলনকারীর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। ন্যাশনাল হেরাল্ড জানায়, এই বিক্ষোভ ছিল জলবায়ু কর্মী সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অংশ। তিনি ১০ সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্তির দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াংচুকের মতে লাদাখের নাজুক পরিবেশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা অপরিহার্য। প্রতিবাদকারীদের দাবিগুলো কোনো ফেলে দেয়ার মতো বিষয় নয়। ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল উপজাতি ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোকে জমি, বন এবং স্থানীয় শাসনের উপর বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দেয়। বিধানসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত লাদাখের জন্য এই সুরক্ষাই একমাত্র ভরসা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্য ফেডারাল ব্যাখ্যা করেছে, এই সুরক্ষা ছাড়া লাদাখের পরিণতি জম্মু-কাশ্মীরের মতো হতে পারে, যেখানে স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার পর জনসংখ্যাগত ও রাজনৈতিক প্রকৌশল চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদের তীব্রতাই এই ভয়ের প্রতিফলন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানায়, বিক্ষোভ যখন পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগে রূপ নেয়, তখন বিক্ষোভকারীরা শাসক দলের প্রতীকে আঘাত হানে—যা বিজেপি ও তার শাসন ব্যবস্থার প্রতি গভীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এর জবাবে সরকার ওয়াংচুককে উসকানির অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং আরও বিধিনিষেধ জারি করে। এই ধারা কাশ্মীরিদের কাছে পরিচিত—যেখানে প্রতিবাদের পর ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ আর গণগ্রেফতারের নজির রয়েছে। এই আন্দোলন কাশ্মীরের বৃহত্তর গল্পকেও প্রতিফলিত করে। কাশ্মীরে স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর বাইরের লোকদের জন্য ডোমিসাইল সার্টিফিকেট, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপক আটক করতে দেখা গেছে। লাদাখিরা এখন তাদের ভূমিতেও সেই একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন। উভয় অঞ্চলই একই শিক্ষা দেয়: যখন পরিচয়, অধিকার ও জীবিকার ওপর হস্তক্ষেপ হয়, তখন ক্ষোভ প্রতিরোধে রূপ নেয়। লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের ঐক্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে যে সংগ্রামটি ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং অস্তিত্বের প্রশ্ন। সব সম্প্রদায়ের মানুষের আশঙ্কা, তারা যেন নিজেদের ভূমিতেই সংখ্যালঘুতে পরিণত না হন। আল জাজিরা এ বছরের শুরুতে জানিয়েছিল, এই ধরনের ঐক্য অভূতপূর্ব এবং লাদাখি পরিচয় রক্ষায় এক যৌথ সংকল্পকে প্রতিফলিত করে। যদি নয়াদিল্লি এই দাবিগুলো উপেক্ষা করে, তবে হিমালয় অঞ্চলে আরেক দফা অস্থিরতা শুরু হতে পারে। লেহ-তে প্রাণহানিকে কেবল ‘অপ্রত্যাশিত ক্ষতি’ হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে হবে। এই বিক্ষোভ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং স্বীকৃতির জন্য গভীর আকুতি। গুলি নয়, লাদাখের দরকার সাংবিধানিক সততা, আন্তরিক সংলাপ এবং এমন সুরক্ষা, যা তার মানুষ ও ভৌগোলিক বাস্তবতাকে সম্মান জানায়। এমএইচ/ |