রপ্তানি সত্ত্বেও ভারতে পাচার হচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৯:১১ সকাল
নিউজ ডেস্ক

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে দরদাম করে চলে মাছ বেচাকেনা।

কুমিল্লা জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ১০৬ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্তের ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রাতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পাচার করা হচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ। এ কাজে সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের কমপক্ষে ছয়টি চক্র।

এদিকে ভারতে রপ্তানির বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে দেশের স্থানীয় বাজারে ইলিশের দামে আরো উত্তাপ বেড়েছে। এই দাম শুনে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতাদের ঘাম ঝরছে।

তারা ভয়ে ভয়ে ইলিশ ছুঁলেও কিনতে পারছে না। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিবেশী ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরুর পরপরই দেশের বাজারে ইলিশের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভারতে রপ্তানি হওয়া ইলিশের দাম স্থানীয় বাজারের তুলনায় অনেক কম। ভারতে প্রতি কেজি ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে ১২ মার্কিন ডলার দরে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক হাজার ৫২৫ টাকা।

কিন্তু বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য বন্দরে রপ্তানিযোগ্য ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি এক হাজার ৮০০ টাকায়। এমনকি ছোট আকারের রপ্তানির অযোগ্য ইলিশও বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকার ওপরে।

জানা গেছে, আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে মোট এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই রপ্তানি চলবে আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে,  আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে শুরু হবে ২২ দিনের ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা। আর তার আগেই চালান শেষ করতে হবে।

মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ ঘাটতির দরুন আগে থেকেই বাজারে ইলিশের দাম বেশি ছিল। রপ্তানির ঘোষণা আসার পর দাম আরো বেড়েছে। বরিশালে পাইকারি বাজারে ইলিশের কেজি সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা ও খুচরা বাজারে ২০০ টাকা দাম বেড়েছে।

এতে সাধারণ ভোক্তারা কার্যত বঞ্চিত হচ্ছেন মৌসুমের এই মাছের স্বাদ থেকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘কূটনৈতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বার্থে ইলিশ রপ্তানি জরুরি। যখন দেশীয় ভোক্তা ইলিশ এক হাজার ৮০০ টাকায় কিনছেন, তখন ভারতীয় ভোক্তা তা পাচ্ছেন এক হাজার ৫২৫ টাকায়।

বরিশালের রপ্তানিকারক নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজের মালিক বাবর শিকদার বলেন, ‘যে ইলিশ আমি স্থানীয় বাজার থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় কিনেছি, সেটি প্যাকেজিং ও পরিবহন খরচসহ দুই হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। অথচ রপ্তানি করতে হচ্ছে কেজিপ্রতি এক হাজার ৫২৫ টাকায়। এতে প্রতি কেজিতে লোকসান হয়েছে। তবু লাইসেন্স বজায় রাখার জন্য রপ্তানি করছি।

 

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বরিশালের সম্পাদক রনজিৎ দত্ত বলছেন, ২০১০ সালে এক কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছিল ৪১৭ টাকায়, ২০১৯ সালে ৭৮৯ টাকায় এবং এ বছর তা এসে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫০০ টাকায়।

মৎস্য আড়তদার জহির শিকদার বলেন, শুক্রবার (গতকাল) বরিশালের পোর্ট রোডে দেড় মণ ইলিশ এসেছে। তার মধ্যে মাত্র ৫০ মণ রপ্তানিযোগ্য ইলিশ। গত বছর একই সময় প্রতিদিন গড়ে হাজার মণ ইলিশ পোর্ট রোডে বিকিকিনি হয়েছিল।

আরআর এন্টারপ্রাইজের এনামুল কবির বলেন, বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে এরই মধ্যে ভারতে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশি ইলিশ। প্রথম দিনই ঢুকেছে চার টন ইলিশ। তবে কম দামে কেন ইলিশ রপ্তানি করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এনামুল কবির ও তাঁর মতো অন্য রপ্তানিকারকরা প্রকাশ্যে জবাব দিচ্ছেন না। দেশের বাজারে প্রায় এক হাজার ৮০০ টাকার ইলিশ ভারতে যাচ্ছে এক হাজার ৫২৫ টাকায়। তার নেপথ্যের কারণ কেউ বলতে চাইছেন না প্রকাশ্যে।

চাঁদপুরেও দাম বেশি : এদিকে ভারতে রপ্তানির খবরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তর উপজেলার মাছ বাজারে গত বুধবার থেকে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদর, মুন্সিরহাট ও বরদিয়া আড়ত, মতলব উত্তর উপজেলার আমিরাবাদ, সুজাতপুর ও ছেংগারচর বাজারে গিয়ে ক্রেতারা দাম বাড়ার এই তথ্য পান। মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদর মাছ বাজারের ইলিশ বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিষয়টি জানাজানির পর ইলিশের দাম বেড়েছে। পাইকারি বিক্রেতারা বাজার থেকে বেশি করে ইলিশ কিনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছেন।

চট্টগ্রাম মহানগরেও দামে আগুন : চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায়। ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশের কেজি দুই হাজার টাকা। ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজির কম ওজনের ইলিশের কেজি দুই হাজার ২০০ টাকা। আবার এক কেজি থেকে এক কেজি ২০০ গ্রামের ইলিশ দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। দেড় কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ দুই হাজার ৬০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। নগরীর ইসলামিয়া কলেজ মোড়ে ফিস পার্ক থেকে দুটি ইলিশ কিনেছেন শিপিং ব্যবসায়ী কাজী আবুল মনসুর। তিনি বলেন, ‘দুটি ইলিশ কিনলাম। দাম আসছে আট হাজার ৬০০ টাকা। এবার দাম অনেক বেশি। তার পরও খেতে তো হবে। চট্টগ্রাম নগরের ফইল্যাতলী বাজারের ব্যবসায়ী নুর হোসাইন বলেন, বড় সাইজের দুটি ইলিশের দামে ছোটখাটো একটা ছাগল কেনা যাবে। আড়ত থেকেই ইলিশ কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। বড় ইলিশ কিনে লসে আছি। যে দামে কিনছি সে দামে বিক্রি করতেও পারছি না। কারণ আড়তেই দেড় কেজি ওজনের ইলিশ কেনা পড়ছে প্রায় তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই বছর আগেও দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা ছিল। এক কেজি ওজনের ইলিশ হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা ছিল। গত তিন মাস ধরে বিপুল পরিমাণ ইলিশ আহরণ করেন জেলেরা। তার পরও দাম গরিব-মধ্যবিত্তের নাগালে আসেনি।

কুমিল্লার ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে পাচার : কুমিল্লা জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ১০৬ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্তের অধিকাংশই পাহাড় এবং গহিন অরণ্যে ঘেরা। সীমান্ত এলাকার ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিরাতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পাচার হচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ। এ কাজে সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের কমপক্ষে ছয়টি চক্র। কয়েক বছর আগেও চাঁদপুর, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার আশপাশের অঞ্চলের পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে প্রচুর ইলিশ আহরণ করতেন জেলেরা। একসময় চাঁদপুরকে বলা হতো ইলিশের জন্মভূমি। ভরা মৌসুমে বিভিন্ন আড়ত থাকত ইলিশে ভরপুর। মধ্যরাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ইলিশ ঘাটের আড়তে হাঁকডাক করে নিলামে বিক্রি করা হতো ইলিশ। এসব ইলিশ চাঁদপুর জেলার চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হতো। সম্প্রতি ইলিশের জন্মভূমি চাঁদপুরেই দেখা দিয়েছে ইলিশের সংকট। ভারত ও বাংলাদেশের কয়েকটি সক্রিয় পাচারচক্রের সদস্যরা ইলিশ চাঁদপুরের আড়তগুলোতে সরবরাহের আগেই রাতের আঁধারে ট্রলার থেকে ইলিশ কিনে পিকআপে ভরে রাতেই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারতে তা পাচার করছে। জানা গেছে, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার মথুরাপুর, যশপুর, মুড়াপাড়া, দলকিয়া, আদর্শ সদর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর, বড়জ্বালা, খাড়েরা, বুড়িচং উপজেলার তেলকুপি বাজার, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল, সংকুচাইল, আশাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ইলিশ পাচারচক্রের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আশাবাড়ী সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ও আলী আজগর জানান, প্রতি রাতে বরফে ঢাকা সাদা বস্তা ও ককসিটে মোড়ানো পিকআপ ভ্যানে ইলিশ আনা হয়। পরে সীমানার ওপারে ত্রিপুরায় তা পাঠানো হচ্ছে।

কুমিল্লা ডিবির ওসি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘সীমান্তপথে ইলিশ পাচার হচ্ছে এমন তথ্য আমরা পেয়েছি। এই চক্রটি ধরতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। সীমান্তমুখী সড়কগুলোতে টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’ কুমিল্লা-১০ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মীর আলী এজাজ বলেন, ‘আমরা সীমান্তে তৎপরতা বাড়িয়েছি। ইলিশ যাতে পাচার না হয় সে জন্য আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।

আরএইচ/