ফকীহুদ্দীন আল্লামা হাফেজ মুফতি আহমদুল্লাহ রহ.-এর জীবন ও কর্ম 
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:৩৩ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

সলিমুদ্দীন মাহদী কাসেমী

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সদরে মুহতামিম, শায়খুল হাদিস ও প্রধান মুফতি ফকীহুদ্দীন আল্লামা হাফেজ মুফতি আহমদুল্লাহ রহ.। তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব; ইলমের মশাল, তাকওয়ার প্রতিচ্ছবি আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ এবং একইসাথে এক অনন্য রাহবর। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বিনয় ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে গড়া এক বিরল চরিত্র, আর প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে ছিলেন আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় আসীন; সদরে মুহতামিম, শায়খুল হাদিস ও প্রধান মুফতি। জাতীয় পর্যায়ে তিনি শুধু একজন শিক্ষাবিদ নন, ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, পীরে কামেল, যিনি অগণিত ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-উলামা এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে দ্বীনের প্রতি প্রেম, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন জুড়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দ্বীনের খেদমত ও সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার এক অনন্য সাধনা। নিম্নে তাঁর 

সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম আলোচনা করা হলো:-
তাঁর শুভাগমন যেভাবে হলো : 
আল্লাহর অশেষ রহমতে এক প্রভাতের আলো ফুটেছিল ১৪ই রবিউস সানি ১৩৬১ হিজরী, মোতাবেক ১২ই মে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত নাইখাইন গ্রামের মুন্সি বাড়ি। সেখানেই মাওলানা ঈসা সাহেব (رح.)–এর ঘরে জন্ম নিলেন এক নূরানী শিশু, যিনি পরবর্তীকালে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার দীপশিখা হয়ে উঠবেন সমগ্র বাংলার জন্য। সেই নূরানী শিশু ছিলেন আল্লামা হাফেজ মুফতি আহমদুল্লাহ সাহেব রহ.।

শৈশব ও শিক্ষার আলো : 
শিশুকালেই প্রকাশ পায় তাঁর বিরল প্রতিভা। মাত্র দশ বছর বয়সেই জামিয়া আরবিয়া জিরিতে হিফজ সম্পন্ন করে হয়ে ওঠেন "হাফেজ সাহেব" এক নামেই আজীবন পরিচিত। প্রাথমিক শিক্ষার ধাপ অতিক্রম করে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন প্রথম স্থান নিয়ে। জ্ঞানের প্রতি তাঁর তৃষ্ণা এতটাই গভীর ছিল যে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমান।

লাহোরের জামিয়া আশরাফিয়া, মুলতানের খায়রুল মাদারিস এবং করাচির দারুল উলূম; প্রতিটি বিদ্যাপীঠ তাঁর জ্ঞানের সমুদ্রপিপাসা মেটানোর ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি একে একে ইলমের নানা শাখায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন, প্রথম স্থান অর্জন করেন, এবং উস্তাদদের ভালোবাসা ও সম্মান লাভ করেন। দারুল উলূম করাচিতে মুফতি আজম আল্লামা শফি রহ. এর তত্ত্বাবধানে ইফতা সম্পন্নের মাধ্যমে শেষ হয় তাঁর ছাত্রজীবনের দীর্ঘ যাত্রা।

কর্মজীবন ও আলোকিত পথচলা : 
১৩৮৮ হিজরীর শাওয়ালে মাতৃভূমিতে ফিরে তিনি আবারও আঁকড়ে ধরলেন শিক্ষার মশাল। জামিয়া আরবিয়া জিরিতে সুদীর্ঘ ২৩ বছর শিক্ষকতা করেন, শেষে হন শায়খুল হাদিস। এরপর ১৪১১ হিজরীতে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় শায়খুল আরব ওয়াল আজম হজরত শাহ ইউনুস রহ.–এর আহ্বানে মুহাদ্দিস ও মুফতি হিসেবে যোগ দেন। তারপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় চার দশক তিনি ছিলেন জামিয়া পটিয়ার প্রাণস্পন্দন সদরে মুহতামিম, শায়খুল হাদিস ও প্রধান মুফতি এবং আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ এর সভাপতির আসনে বসে ইলমের আলো বিতরণ করেছেন নিরলসভাবে।

আধ্যাত্মিক যাত্রা : 
ইলমের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার অঙ্গনেও তিনি উজ্জ্বল ছিলেন। করাচিতে অবস্থানকালে মুফতি আজম আল্লামা শফি রহ.–এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে বাংলার অলি-আল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.–এর হাতে পুনরায় বাইআত গ্রহণ করে ১৪০১ হিজরীতে খেলাফত প্রাপ্ত হন। তাঁর অন্তরে ছিল ইলম ও আধ্যাত্মিকতার এক অপরূপ সমন্বয়।

রচনাবলি ও সাহিত্যকীর্তি
অসংখ্য ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি রেখে গেছেন একগুচ্ছ অমূল্য গ্রন্থ:-
• সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা ও হানাফি মাযহাবের যুক্তিসমৃদ্ধ জবাব
• চট্টগ্রামের মাশায়েখগণ (বাংলা ও উর্দু সংস্করণ)
• তাজকেরাতুন নূর
• তাসকীনুল খাওয়াতির ফী শরহিল আশবাহি ওয়ান্নাযায়ির
• ইসলামের দৃষ্টিতে শেয়ার বাজার
• আহমদী সুবাসিত খুতবা
• এক এর ভিতর সাত
• হায়াতে আহমদী (আত্মজীবনী)

এছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ, পুস্তিকা ও ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে রচনা তাঁর কলমকে করেছে অমর।

ইন্তেকাল: আজ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, সকাল ৭ ঘটিকায় এই যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, হাদিসের উঁচু সনদধারী, ইলম ও আমলের নক্ষত্র আল্লামা আহমদুল্লাহ সাহেব রহ. ইন্তেকাল করেছেন,  إنا لله وإنا إليه راجعون। আজ রাত ৯ ঘটিকায় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রাঙ্গণে জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হবে, ইনশা আল্লাহ।

সমাপনী: তিনি ছিলেন দীপ্তিমান প্রদীপ, যিনি হাজারো ছাত্র-শিক্ষকের অন্তরে জ্বালিয়েছেন জ্ঞানের আলো, আধ্যাত্মিকতার উষ্ণতা, এবং দ্বীনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁর চলে যাওয়া বাংলার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝরে পড়ার নামান্তর। তবে তাঁর রেখে যাওয়া ইলমের ভাণ্ডার, আধ্যাত্মিকতার স্রোতধারা এবং ছাত্রদের অন্তরে জাগ্রত আলোর শিখা তাকে চিরজীবী করে রাখবে।

আল্লাহ তাআলা হযরতের কবরকে নূরানী করুন, জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চতম মর্যাদা দান করুন, এবং তাঁর রেখে যাওয়া ইলম ও আমলকে কিয়ামত পর্যন্ত সজীব রাখুন। আমীন।

লেখক: তত্ত্বাবধায়ক, তাফসির বিভাগ, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

এমএইচ/