নওমুসলিমের হৃদয়ছোঁয়া গল্প : আলোকের পথে আত্মিক যাত্রা (প্রথম পর্ব)
প্রকাশ:
২৭ আগস্ট, ২০২৫, ১১:৫০ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
মুহাম্মদ মিজানুর রহমান [আব্দুল্লাহ আল আহমদ—জীবনের অন্ধকারতম অধ্যায়ে যার নাম ছিল শিশির সাহা। ২০২২ সালে সে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে সেই অন্ধকার জীবনের ইতি টানে, শুরু করে আলোর পথে এক নবযাত্রা। ২০২৪ সালে সে ঘর ছাড়ে, আত্মিক মুক্তির উদ্দেশ্যে। কঠিন বাস্তবতা ও অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যেও সে থেমে থাকেনি। বর্তমানে সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে অনার্সে অধ্যয়নরত। পাশাপাশি কর্মরত আছে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।] শিশির সাহার পরিবারটি ছিল একটি প্রাচীন ধাঁচের একান্নবর্তী পরিবার। বহু চাচাতো ভাইয়ের মাঝে বড় হয়ে ওঠা, যেখানে ছিল পারস্পরিক স্নেহ, সৌহার্দ্য আর আন্তরিকতা। ছোটখাটো ঝগড়া হতো বটে, তবে পরিবারের বন্ধন ছিল অটুট। প্রবীণদের কথা আলাদা, তারা যথেষ্ট ধর্মভিরু, তবে অধিকাংশ তরূণদের বিশ্বাসের জগতে ছিল একধরনের বৈপরীত্য। তারা নিয়মিত আচার-উপাসনা করতো না। তাদের ধর্মীয় অনুশীলন ছিল পরিস্থিতিনির্ভর। যেকোনো বিপদ-আপদে তারা ঈশ্বর বা মূর্তির স্মরণ নিতেন, যেমন—কেউ অসুস্থ হলে বা পরীক্ষার সময়। তাদের ঈশ্বরের প্রতি ভয় ছিল না, ছিল না পরকালের জবাবদিহির অনুভূতি। বারো মাসের তেরো পার্বণ ছিল তাদের কাছে নিছক উৎসব, আনন্দ আর বিনোদনের উপলক্ষ মাত্র। ঈশ্বরের প্রতি যে শ্রদ্ধাভীতিমিশ্রিত ভালোবাসা থাকা উচিত, সেটি তাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। দৈনন্দিন জীবনে স্রষ্টার উপস্থিতি, তাঁর প্রতি নির্ভরতা কিংবা কৃতজ্ঞতা—এসব বিষয় তাদের খুব একটা অনুভূত ছিল না। সেই কারণেই হয়তো ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন কেবল ‘চাওয়া-পাওয়ার’ এক উৎস, হৃদয়ের আস্থা নয়। শিশির যে এলাকায় বড় হয়েছে, সেটি হিন্দু পাড়া হলেও, আশপাশের মানুষ ছিল মূলত মুসলিম। বলা চলে, দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ একসাথেই বেড়ে উঠেছে, শৈশব, কৈশোরের আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গায় কেউ কাউকে ছাড় দিত না। দু’পক্ষের মাঝেই ছিল একধরনের অনমনীয়তা, যা তৈরি হয়েছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত ধারণা আর পূর্বপুরুষদের বয়ানের মাধ্যমে। শিশিরের ধর্মীয় চেতনা গড়ে ওঠার সময়, সে গুরুজনদের মুখে মুসলমানদের নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছে। এসব কথায় ইসলাম বা মুসলমানদের প্রতি এক ধরনের মনোভাব তৈরি হয়েছিল—মূলত সেটি ছিল অনাবিষ্কৃত ধর্মকে দূরে সরিয়ে রাখার এক অলিখিত প্রবণতা। তবে আশেপাশে যারা মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত ছিল, তাদের আচরণ, জীবনযাপন কিংবা ধর্মচর্চাও ইসলামের প্রকৃত পরিচয়কে তুলে ধরার মতো ছিল না। তারা ছিল নামেই মুসলমান, কিন্তু কার্যত তাদের মধ্যে ইসলামের মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ইবাদতের নিয়মিততা—এসবের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মসজিদে আজান হলেও কেউ নামাজের জন্য তাড়াহুড়ো করত না, ইসলামী আদর্শ জীবনে প্রভাব ফেলেছে এমন দৃষ্টান্ত ছিল বিরল। ফলে, ইসলামের সৌন্দর্য, আদর্শিক কাঠামো কিংবা আত্মিক গভীরতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোনো বাস্তব সুযোগ শিশিরের হয়নি। দুই. ছোটবেলা থেকেই টিভির পর্দায় যখন সিরিয়াল চালু হতো, তখন দেবতাদের যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, মারামারি দেখে তার মনে হতো—এ কেমন ঈশ্বরতুল্য সত্তা, যারা নিজেরাই শান্তিতে থাকতে পারে না? প্রশ্ন করত সে, “দেবতারা মারামারি করছে কেন?” গুরুজনেরা তখন বলতেন, “বড় হলে বুঝবি।” কিন্তু বড় হয়ে সে যা দেখল, তাতে উত্তর তো মিলল না—বরং দ্বিধা আরও বেড়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা যদি একজন হন, তাহলে এত দেব-দেবী কোথা থেকে এলেন? কেউ শক্তির দেবতা, কেউ ধ্বংসের, কেউ আবার সৃষ্টির। আবার এদের মধ্যেই চলছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কখনো যুদ্ধ। কেউ কেউ তো অবতারকে স্রষ্টার আসনে বসিয়ে পূজা করছে। তার মনে প্রশ্ন জাগল—এ কেমন ঈশ্বর ধারণা? ঈশ্বরেরা নিজেরাই যদি রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়েন, তবে সাধারণ মানুষ কাকে অনুসরণ করবে? এই বিভ্রান্তির উত্তর সে অনেক বছর পরে পায়, ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময়। লকডাউনে যখন সারা পৃথিবী থেমে যায়, তখন তার নিজের ভাবনার পথ প্রশমিত হয়। সময় পায় গভীরভাবে ভাবার, খোঁজার, জানতে চাওয়ার। তখনই সে বুঝতে শেখে স্রষ্টা, অবতার আর দেবদেবীর পার্থক্য। বুঝে নেয়, সত্যকে জানতে হলে সংস্কৃতির গল্প নয়, প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের, বিশুদ্ধ ভাবনার। সেই সময় থেকে তার চিন্তার জগতে এক নতুন আলো নেমে আসে—যে আলো শুধু প্রশ্ন তোলে না, উত্তরও খুঁজে পেতে শেখায়। তাছাড়া একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনের মাঝেই অনেক নতুন ভাবনার দ্বার খুলে যেতে থাকে। তারা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত—ধর্ম, ধর্মবিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তা, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য। তবে প্রথমদিকে সে লক্ষ্য করত, ইসলাম নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বন্ধুটা কিছুটা সংকোচবোধ করছে। হয়তো ভাবত, শিশির কী মনে করবে, তার ভাবনাগুলো তাকে অপমানিত করবে কি না। শিশির সেটা বুঝতে পেরে, বরং নিজেই তাকে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করে—ইসলাম কী? মুসলমানদের মূল বিশ্বাস কী? নামাজ, রোজা, হজ—এসবের অর্থ কী? এইভাবে প্রশ্ন আর তার ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাদের আলোচনার পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। বন্ধুর ভেতরে যে দ্বিধা ছিল, তা কেটে যেতে থাকে। সে উপলব্ধি করে, সে কেবল জানে না—সে বোঝে। ধর্ম তার কাছে শুধুই আচার বা সংস্কার নয়, বরং চিন্তা, যুক্তি আর বিশ্বাসের সম্মিলন। সেই আলাপের গভীরতায় তার নিজের ভাবনাও ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। এভাবে বন্ধুত্বের আবহে, শ্রদ্ধা আর বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে তারা দুজনেই নিজেদের হৃদয়ের দরজা একটু একটু করে খুলে দেয় সত্য ও আলো খোঁজার জন্য। তিন. একদিন রাতে মোবাইল ফোনে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ করেই ইউটিউবের এক ভিডিও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভিডিওটি ছিল ড. জাকির নায়েকের। সে কৌতূহলবশত প্লে করে। শুরুতে সামান্য আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে সে তন্ময় হয়ে যায়। যুক্তির ভেতর লুকিয়ে থাকা সত্য যেন তার হৃদয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে। প্রতিটি যুক্তি, প্রতিটি উদাহরণ তার মনে জাগিয়ে তোলে নতুন প্রশ্ন, নতুন চিন্তা। সে ভাবতে থাকে—এতদিন যে ধর্মচর্চা করে এসেছে, সেখানে কি আদৌ কোনো উপকার আছে? নাকি শুধুই এক ধারাবাহিকতা, যার পেছনে নেই কোনো ভিত্তি? মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা—কিন্তু কে শুনছে সেই প্রার্থনা? কে দিচ্ছে উত্তর? সেই রাতেই তার মনে এক ভিন্ন উপলব্ধির জন্ম হয়। ধীরে ধীরে মূর্তির প্রতি তার মনে চরম বিতৃষ্ণা তৈরি হতে থাকে। একসময় সে বুঝে যায়, সে হয়তো জন্মসূত্রে সনাতন ধর্মের অনুসারী ছিল, কিন্তু মূর্তি পূজার প্রতি তার কখনোই প্রকৃত কোনো আস্থা ছিল না। সেই বিশ্বাসের জায়গা কখনই হৃদয়জুড়ে দখল নিতে পারেনি। সে রাত ছিল তার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার রাত। সে উপলব্ধি করে, সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয়—তাঁর কাছে পৌঁছাতে কোনো মূর্তি, কোনো মাধ্যমের দরকার নেই। এই উপলব্ধি তাকে সত্যের আরও কাছাকাছি টেনে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে একেশ্বরবাদী চিন্তাধারার জায়গা তৈরি হতে থাকে। আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, আখিরাত—এসব বিষয়ে জানতে ক্রমশ আগ্রহ বাড়ে। যখন মূর্তির প্রতি তার বিতৃষ্ণা চূড়ান্ত রূপ নেয়, তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। সাহস করে একদিন মা-বোনদের সামনেই বলে ফেলে—“আমার তো ইচ্ছে হয়, মূর্তিগুলো একে একে ভেঙে ফেলি!” বাড়ির পরিবেশ থমকে যায়। সবার চোখে বিস্ময়। সে থামে না—একবার সুযোগ পেয়ে সব মহিলাদের একসঙ্গে বসিয়ে বলে, “দেখো, ইসলামে মূর্তির কোনো স্থান নেই। এমনকি ইসলামি শরিয়তে ছবিকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, ছবিই একসময় মূর্তি আর মূর্তিই একসময় উপাসনার রূপ নেয়।” সে বোঝাতে চেষ্টা করে—তাওহিদের বিশুদ্ধতা কতটা গভীর, কতটা নির্ভেজাল। তার কথা তাদের কানে যেত ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ে দাগ কাটতো না। তার যুক্তি তারা শুনতেন, কিন্তু গ্রহণ করতে পারতেন না। এই ছিল সবচেয়ে কষ্টের জায়গা—যার সত্য সে হৃদয়ে ধারণ করতো, তা প্রিয়জনদের দৃষ্টিতে ছিল অচেনা ও অগ্রহণযোগ্য। আরএইচ/ |