আজকের এই দিনে ইন্তেকাল করেছেন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক
প্রকাশ:
০৮ আগস্ট, ২০২৫, ১২:০২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
৮ আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নক্ষত্রপতনের দিন। এদিনই ইন্তেকাল করেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। অসাধারণ গুণের অধিকারী এই আলেম সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় সহীহ বুখারী শরীফের অনুবাদ করেন। দরস ও তাদরীসের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। জন্ম ও শৈশব আনুমানিক ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) জেলার ভিরিচ খাঁ গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম হাজী এরশাদ আলী। মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে নানীর কাছে বড় হন। নানাবাড়ি ছিল একই জেলার কলমা গ্রামে, যেখানে তিনি শৈশবের একটি অংশ কাটান। সাত-আট বছর বয়সে পিতার কাছে আসেন বি.বাড়িয়া শহরে, যেখানে তাঁর পিতা ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় বি.বাড়িয়ায় অবস্থান করতেন বাংলাদেশের তিন শীর্ষ আলেম—হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী রহ. ও হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব পীরজী রহ.। হাজী এরশাদ আলীর সঙ্গে তাঁদের গভীর ভক্তির সম্পর্ক ছিল। তাই পিতা তাঁকে হযরত ফরিদপুরী রহ.-এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে দেন। শিক্ষার সূচনা ও জ্ঞান অর্জন শিক্ষাজীবনের শুরু নানাবাড়ির স্থানীয় মসজিদে, যেখানে তিনি নাজেরায় কুরআন সম্পূর্ণ করেন। এরপর হযরত ফরিদপুরী রহ.-এর নেগরানিতে জামিআ ইউনুসিয়ায় আরবি শিক্ষা শুরু হয়। শুরু থেকেই এমন একজন শায়খের সান্নিধ্য পাওয়া তাঁর জীবনের জন্য ছিল বড় সৌভাগ্য। পরে হযরত ফরিদপুরী রহ. ঢাকার বড় কাটারায় আশরাফুল উলূম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলে তিনিও সেখানে চলে যান এবং সেখান থেকেই দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। এ সময় তিনি আল্লামা রফীক আহমদ কাশ্মীরী রহ.-এরও সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৪০-৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অবস্থানরত শায়খুল ইসলাম যফর আহমদ উসমানী রহ.-এর নিকট তাফসীরে বায়যাবী, জামে তিরমিযী ও সহীহ বুখারী পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। জামিআ ইসলামিয়া তালীমুদ্দীন, ডাভেল আশরাফুল উলূমে দাওরার সময় ‘ফাতহুল মুলহিম’ পাঠ করতে গিয়ে তাঁর অন্তরে আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী রহ.-এর কাছে আবার বুখারী পড়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে। এজন্য তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গুজরাটের ডাভেলে যান এবং ১৩৬২-৬৩ হিজরীতে তাঁর নিকট বুখারী পড়েন। পথে সাহারানপুরে অবস্থানকালে হযরত আসআদুল্লাহ রামপুরী রহ.-এর কাছ থেকে মুসালসালাতের ইজাযত লাভ করেন। দারুল উলূম দেওবন্দ আল্লামা উসমানী রহ. তাঁর বুখারীর তাকরীরসমূহ সম্পাদনার জন্য তাঁকে এক বছর দেওবন্দে রেখে দেন। সেখানে শায়খুত তাফসীর আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী রহ.-এর নিকট দাওরায়ে তাফসীর পড়েন। তাদরীসী জীবন ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আশরাফুল উলূম বড় কাটারা মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। আট বছর সেখানে শিক্ষকতা শেষে ১৯৫২ সালে হযরত ফরিদপুরী রহ. প্রতিষ্ঠিত জামিআ কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগে যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি জামিআ ইসলামিয়া তাতিবাজার, মাদরাসা নূরিয়া ঢাকা, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বুখারীর দরস দেন। পরে মুহাম্মদপুরে ‘জামিআ মুহাম্মদিয়া আরাবিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে সাত মসজিদের পাশে স্থানান্তরিত হয়ে ‘জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া মুহাম্মদপুর’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৮৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এখানেই ছিল তাঁর প্রধান তাদরীসী আসন। পাশাপাশি মালিবাগ, মিরপুর, লালমাটিয়া ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন মাদরাসায়ও বুখারী পড়িয়েছেন। রাজনীতি রাজনৈতিক অঙ্গনেও শায়খুল হাদীস রহ.-এর অবদান ছিল অনন্য। যদিও ইলম ও তালিবে ইলমের খেদমতই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান ক্ষেত্র, তবুও দ্বীনের বিপদে তিনি কখনও নীরব থাকেননি। তাঁর অন্তরে সদা জাগরুক ছিল সেই সিদ্দীকি চেতনা—“দ্বীন ধ্বংস হবে আর আমি বসে থাকব?”। তাই ইলমী খেদমতের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং রাষ্ট্র ও ইসলামবিদ্বেষী মহল থেকে ছড়ানো ফেতনাকে দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে শায়খ শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সদস্য হন। আইয়ুব খানের কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন, ১৯৭১-পরবর্তী ইসলামবিরোধী আক্রমণ—সবক্ষেত্রেই ছিলেন সাহসী মুজাহিদ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি এবং তাহরীকে খেলাফত আন্দোলনে হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর ডানহাত হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৩ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে তাঁর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক অযোধ্যা লংমার্চে লাখো মুসলমান অংশ নেন, যেখানে দুজন শহীদ হন। এ কীর্তি আলেম সমাজ ও মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত হয় এবং শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. তাঁকে “আলমুজাহিদুল কাবীর” উপাধি দেন। দ্বীনের রক্ষায় তিনি কারাবরণ ও নির্যাতন সহ্য করেও কখনো পিছু হটেননি।
১৯ রমযান ১৪৩৩ হিজরী, ৮ আগস্ট ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ বুধবার প্রায় ৯৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জানাযা ও দাফন ২০ রমযান, ৯ আগস্ট জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, ইমামতি করেন তাঁর ছেলে মাওলানা মাহফুযুল হক। পরে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। এসএকে/ |