ইসলামি দলগুলোর ঐক্য-সমঝোতা কতদূর?
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট, ২০২৫, ০৯:২৯ রাত
নিউজ ডেস্ক

বিশেষ প্রতিনিধি

ইসলামি সব দলের সমন্বয়ে একটি জোট কিংবা সমঝোতার আলোচনা শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েক মাস ধরে। ইসলামি দলগুলো মিলে আগামী নির্বাচনে ‘একটি বাক্স’ দেবে এমন পরিকল্পনার কথাও বারবার বলে আসছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। তবে এই জোট বা সমঝোতার বিষয়টি এখনো টেবিলের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। এর কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখার কথা কেউই বলতে পারছেন না। দিন যত গড়াচ্ছে এই বৃহৎ জোট বা সমঝোতা আদৌ হবে কি না সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্দেহ ও সংশয়। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একটা ঐক্যের প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় বসাও হয়েছে। তবে এই জোট বা সমঝোতার ভিত্তি ও রূপরেখা সম্পর্কে নেতাকর্মীরা এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না, এই জোট বা সমঝোতা চূড়ান্তভাবে কাদের মধ্যে হবে এবং কবে নাগাদ এর ঘোষণা আসতে পারে। 

কয়েক দিন আগে একটি ইসলামি দলের ডাকসাইটে একজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি গল্পচ্ছলে জোট-সমঝোতা নিয়েও অনেক কথা বলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত এই ঐক্য হবে না সেটা আমরাও বুঝি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের চাহিদা এবং জনসাধারণের দাবির মুখে আমাদেরকে ঐক্যের ব্যাপারে আন্তরিকতার অভিনয় করতে হয়। আমরা সেটাই করে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ঐক্য হলে তো ভালো, না হলে যেন অন্তত আমাদেরকে কেউ দায়ী করতে না পারে যে, আমরা ঐক্য চাইনি। 

শুধু এই নেতা নন, বেশির ভাগ ইসলামি দলের নেতাদের মধ্যে একই মনোভাব রয়েছে। তারা প্রকাশ্যে ঐক্যের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে ঐক্যের জন্য যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কিংবা অন্যকে মূল্যায়নের যে মনোভাব সেটা তারা পোষণ করেন না। এমনকি ঐক্যের মিটিংয়ে কে কোথায় বসবেন, প্রেস ব্রিফিংয়ে কে নিজেকে কতটা উপস্থাপন করতে পারবেন- সেটা নিয়েও তাদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা হয়।

এজন্য শেষ পর্যন্ত সব ইসলামি দল মিলে ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রক্রিয়ায় সব ইসলামি দল যে থাকছে না সেটা অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামী থাকলে সেই জোট বা সমঝোতায় যাবে না বলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইঙ্গিত দিয়েছে। ইতোমধ্যে দলটি নিজেদের সমমনা দলগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করছে। এর অংশ হিসেবে এবি পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জমিয়তের নেতারা। এ ধরনের বৈঠক অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানা গেছে। 

অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটের ব্যাপারে বেশ সক্রিয় চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। অতীতের বৈরিতা ভুলে দল দুটির মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পিআর ইস্যুতে দল দুটিকে অভিন্ন সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন ইস্যুতে দুটি দলের অবস্থান দুই মেরুতে। এটা ঐক্য প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে কারও কারও ধারণা। 

অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর অবস্থান মাঝামাঝি পর্যায়ে। মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে শুরু থেকেই আছে। তবে দলটিকে নিজেদের জোটে চাচ্ছে বিএনপিও। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কারও কারও বিএনপির সঙ্গে যাওয়ার আগ্রহ থাকলেও তৃণমূলের দাবি হলো বৃহৎ ইসলামি জোটে যাওয়ার। একই অবস্থা খেলাফত মজলিসেরও। দলটি বিএনপির সাবেক জোটসঙ্গী হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে মিলে নির্বাচন করতে পারে বলে আলোচনা আছে। তবে ইসলামি জোট বা সমঝোতার সঙ্গেও খেলাফত মজলিস রয়েছে। এর বাইরে ইসলামী ঐক্যজোট, কয়েক ভাগে বিভক্ত নেজামে ইসলাম পার্টি, দুই ভাগে বিভক্ত খেলাফত আন্দোলন ভোটের মাঠে তেমন একটা প্রভাব না রাখায় তেমন আলোচনায় নেই। তবে বৃহৎ ইসলামি জোট হলে এসব দলকেও রাখা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বা সমঝোতা সুদূরপরাহত। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। একজন আরেকজনকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। আর ছাড় দেওয়ার মানসিকতা না থাকলে ঐক্য কখনো সম্ভব নয়। তাদের মতে, এখন পরস্পরে একসঙ্গে বসলেও যখন দেনা-পাওয়ার হিসাব আসবে তখন তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে যখন আসন ভাগাভাগির সময় হবে তখন সবাইকে নিয়ে ঐক্য টিকিয়ে রাখা অনেক কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, এবার ইসলামি দলগুলোর সামনে বড় একটি সুযোগ এসেছে। এমন সুযোগ অতীতে আর কখনো আসেনি। এবার তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য বা সমঝোতা গড়ে তুলতে পারলে এদেশের রাজনীতিতে তারা অনেক বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। তাদেরকে সমীহ করতে সব রাজনৈতিক শক্তি বাধ্য থাকবে। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঐক্য প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে অনেক বড় সম্ভাবনা তারা গলা টিপে হত্যা করবেন। এজন্য যেকোনো মূল্যে ঐক্য গড়ে তোলার ওপর তাদের জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এমএইচ/