সিলেটের এক রত্নের গল্প শোনো
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট, ২০২৫, ০২:৫৮ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| মাওলানা আলী হাসান উসামা ||

আলেমদের ওপর লীগের জুলুমের আলোচনা করতে গেলে শুধু ১৩ ও ২১ সালে আমাদের ওপর বা ২০০০ সালের দিকে শায়খুল হাদিস ও মুফতি আমিনী রহ. প্রমুখ আকাবিরের ওপর সংঘটিত ঘটনার আলোচনা করাই যথেষ্ট নয়, বরং ফিরে যেতে হবে সত্তরের দশকে। ৭২ থেকে ৭৫ কওমি আলেমদের ওপর কী অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছে, তা স্মরণ না করা বড় বেইনসাফি হবে। সেই মজলুমদের মধ্যেই অন্যতম আল্লামা আতহার আলী রাহ.।

তিনি ছিলেন মূলত সিলেটেরই সন্তান। ১৮৯১ সালে বিয়ানীবাজারে তাঁর জন্ম। ইলম শিখেছেন যাদের থেকে, তাদের মধ্যে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, শাব্বির আহমদ উসমানি, জফর আহমদ উসমানি রাহ. অন্যতম। তিনি ছিলেন হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লত শাহ আশরাফ আলী থানবি রাহ.-এর খলিফা। কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদরাসার নামকরণও করেছিলেন মূলত তাঁর দাদাপীর হাজী ইমদাদুল্লাহ মাক্কি রাহ.-এর নামে।

বর্তমানে দেওবন্দি ধারার সব রাজনৈতিক দল মিলিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে যত প্রভাব রাখে, তাঁর ও তাঁর সংগঠনের প্রভাব ছিল এরচেয়েও বেশি। শেরে বাংলার ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব প্রণয়নে তাঁর অবদান ছিল সিংহভাগ আর তিনি তা করেছিলেন থানবি রাহ.-এর ইঙ্গিতে। ৪৭ এর স্বাধীনতার পেছনেও রেখেছিলেন ব্যাপক অবদান। 

স্বাধীন দেশে ১৯৫০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। তাতে শর্ষিনার পীর হজরত নেসার উদ্দীন রাহ.-কে সভাপতি, আল্লামা আতহার আলী রাহ.-কে কার্যকরী সভাপতি, মাওলানা আব্দুর রহিম রাহ.-কে মহাসচিব করে ৫২ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম কমিটি গঠন করা হয়।

সেই যে শুরু হলো গণজাগরণ, যা পরবর্তীতে আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভায় রূপ নেয়। প্রণীত হয় ২২ দফার ই স লা মি সংবিধান। ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জে ডাকা হয় জমিয়তের কনফারেন্স। সেখানে সবার কণ্ঠে ছিল একই সুর, 'আমরা চাই নেজামে ইসলাম'। ইসলামি নেজাম চাওয়া থেকেই একপর্যায়ে তা-ই হয়ে যায় দলীয় নাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে থাকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পাশাপাশি নেজামে ইসলাম। 

১৯৫৪ সালে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ব্যাপক জাগরণ ঘটিয়ে পরাজিত করেন মুসলিম লীগকে। সে নির্বাচনে নেজামে ইসলাম পার্টি প্রাদেশিক পরিষদে লাভ করে ৩৬টি আসন এবং কেন্দ্রে পায় ৪টি আসন। কোয়ালিশন সরকারে কয়েকজন মন্ত্রীও হয় তাঁদের থেকে। নিজে মন্ত্রীর চেয়ারে না বসেও সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখতে থাকেন আল্লামা আতহার আলী রাহ.। 

একপর্যায়ে তাঁর আস্থাভাজন চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে এবং ১৯৫৬ সালে ইসলামি শাসনতন্ত্র বিল পাস ও অনুমোদন করায়। এটা ছিল তাঁর অনন্য সাধারণ কৃতিত্ব। এর অপেক্ষায়ই যেন ছিল গোটা জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। যদিও সেটাকে স্থায়ী হতে দেওয়া হয়নি। আইয়ুব বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল নিয়ে তা বাতিল করে দেয় ১৯৫৮ সালে।

এতকিছুর পরও নেজামে ইসলাম রাজনৈতিক প্রভাব জারি রাখে। এত অধিক পরিমাণ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী তারা বানাতে পেরেছে, এখন যেকোনো ইসলামি দলের জন্য যা আকাশকুসুম কল্পনা। এমনকি আমাদের (খেলাফত মজলিসের) সাবেক আমির অধ্যক্ষ ইসহাক সাহেব হাফি.-ও ছিলেন একসময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সদস্য এবং পরবর্তীতে নেজামে ইসলাম থেকে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী।

অর্থাৎ বলা যায়, বর্তমান খেলাফত মজলিসও আল্লামা আতহার আলী রাহ. এবং তার জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম এবং পরবর্তীতে থানবি সিলসিলারই আরেক নক্ষত্র আল্লামা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রাহ.-এর চলমান কীর্তিরই অবদান। এভাবেই গুণীরা মরেও অমর হয়ে থাকেন জারি থাকা কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে।

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও চিন্তক

এমএম/