গাজায় ইসরায়েলি ব্যর্থতা ও প্রতিরোধ আন্দোলনের কৌশলগত উত্থান
প্রকাশ: ১২ জুলাই, ২০২৫, ০৭:০৬ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

মুহাম্মাদ শোয়াইব

গাজা যুদ্ধ একটি সামরিক সংঘাতের নামমাত্র নয়—এটি এক জটিল রাজনৈতিক ও কৌশলগত লড়াইয়ের নাম, যেখানে প্রতিরোধ আন্দোলন দিনের পর দিন নিজেকে আরও সংগঠিত, অভিযোজিত ও কৌশলগতভাবে দক্ষ করে তুলছে। ইসরায়েলের হাজারো ড্রোন, সেনা, ট্যাংক, ও প্রযুক্তিগত সুবিধার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছোট্ট ভূখণ্ডের গেরিলা যোদ্ধারা যেভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তা আজকের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বাগদাদ থেকে ইরাকি সামরিক ও কৌশলগত বিশ্লেষক ড. আহমদ আল-শরীফি সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেন, গাজায় প্রতিরোধ আন্দোলনের কৌশলগত অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে তারা এখন শুধু রক্ষার নয়, বরং আক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তারা এখন জীবিত ইসরায়েলি সৈন্যদের বন্দি করারও পরিকল্পনা করছে। এটি নিছক একটি নতুন রণকৌশল নয়, বরং এক শক্ত বার্তা যে প্রতিরোধ এখন চাপের শিকার নয়, বরং নিজের শর্তে লড়াই করছে।

ইসরায়েল গেরিলা যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য যে 'পৃথকীকরণ ও ঘেরাও' (containment and isolation) কৌশল নিয়েছিল, তা মাঠে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সব আধুনিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তারা গাজায় একটি সুসংগঠিত প্রতিরোধ কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে পারেনি। ফলে এখন তারা সামরিক বিকল্পের বদলে ‘মানবিক শহর’ নামে রাজনৈতিক পরিকল্পনার দিকে ঝুঁকেছে—যার উদ্দেশ্য, বেসামরিক নাগরিকদের প্রতিরোধ থেকে আলাদা করা এবং জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়া।

কিন্তু ড. শরীফির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই রাজনৈতিক উদ্যোগও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মনোবল ও সংগঠনের সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। বরং যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলের পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতা মানসিকভাবে তাদের বাহিনীকেই বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। সেনারা যুদ্ধ করে অস্ত্রে নয়, করে মনোবলে—আর সেই মনোবল যখন ভাঙতে শুরু করে, তখন আর অস্ত্রের গুরুত্ব থাকে না।

আরও গভীরভাবে দেখলে, প্রতিরোধ আন্দোলন এখন গেরিলা যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে: গোয়েন্দা তৎপরতা। এখন প্রতিটি আক্রমণ, প্রতিটি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম একটি উন্নত তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের ফল। এমনকি ইসরায়েলি বাহিনী কোথায় পুনরায় মোতায়েন হচ্ছে, তারা কোন পথ দিয়ে প্রবেশ করছে—এইসব তথ্য মাঠেই সংগৃহীত হচ্ছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে অভিযানে রূপ পাচ্ছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জীবিত সৈন্য বন্দি করার প্রচেষ্টা কেবল কৌশলগত লাভ নয়; এটি তথ্যের ভাণ্ডারও খুলে দিচ্ছে। বন্দিদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়, অভ্যন্তরীণ অবস্থানের মানচিত্র পাওয়া—এসব কিছু প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে অগ্রাধিকার তৈরি করে দিচ্ছে।

যুদ্ধক্ষেত্র এখন আর স্থির নয়। লক্ষ্যবস্তু সবসময় চলমান। কিন্তু চলমান লক্ষ্যেও হামলা চালানো সম্ভব—যদি প্রতিরোধ আন্দোলন জানে তারা কোথা থেকে এসেছে, কোথায় অবস্থান নিচ্ছে এবং কীভাবে তারা সরে যাচ্ছে। এই গোয়েন্দা-নির্ভর প্রক্রিয়া এখন প্রতিরোধকে এমন এক স্থানে পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা শুধু প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং নিজ থেকেই আক্রমণের পথ নির্ধারণ করতে পারছে। কখনও তারা অ্যামবুশে অপেক্ষা করছে, কখনও বা হঠাৎ আক্রমণে ধাক্কা দিচ্ছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, গাজা এখন একটি সামরিক পরীক্ষাগার নয়—এটি এক বাস্তবতার ময়দান, যেখানে প্রযুক্তি, মনোবল ও কৌশল একসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং এই সমীকরণে, যেসব বাহিনী গায়ে অস্ত্রের জোরে জয়ী হতে চায়, তারা যদি তথ্য, মনোবল ও জনগণের সমর্থনের মানে না বোঝে—তাদের পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার।

এমএইচ/