বিশ্বাসের কবি আল মাহমুদ : টুকরো স্মৃতি
প্রকাশ:
১১ জুলাই, ২০২৫, ১২:০৫ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
||মুনীরুল ইসলাম|| কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘স্মৃতির মেঘলা ভোরে’ কবিতায় এভাবেই মৃত্যুর দৃশ্যপট এঁকেছিলেন। কবির বাসনা মতো শুক্রবারেই তাঁর কাছে মৃত্যুর ফেরেশতা এসেছিলেন। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ভাষার মাসেই বাংলা ভাষার কবি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিলেন। প্রিয় কবির এপিটাফেও অঙ্কিত হয়েছে এই চারটি পঙক্তি। ভক্ত-অনুরক্তরা কবির মৃতদেহ জাতীয় শহীদ মিনারে নিতে চেয়েছিলেন। সেটা হয়নি। শহীদ মিনারে জায়গা না হলেও কবি তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে মানুষের হৃদয় মিনারে জায়গা করে নিয়েছেন। কবির জানাজা হয়েছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। বিশ্বাসী মানুষ মনে করেন, জানাজার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরামের সাবেক সভাপতি জহির উদ্দিন বাবর ফেসবুকে চমৎকার লিখেছেন, দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীরা মারা যাওয়ার পর শহীদ মিনারে তাদের লাশ নিয়ে ‘পূজা’ করা হয়। পরে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘লোকদেখানো’ জানাজা। এতে অংশগ্রহণকারীদের কতজনের ওজু থাকে সেটা বলা মুশকিল। দেশের সেরা কবি আল মাহমুদকে শহীদ মিনারে না নেয়ার সিদ্ধান্তটিও সেরা। তাঁর জানাজা হয়েছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। সেখানে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগ আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহর প্রিয়দের দোয়ার উসিলায় একজন বিশ্বাসী কবিকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেনÑ এটাই সবার বিশ্বাস।... দুই. কুমিল্লায় থাকাকালে কবি আল মাহমুদ ছিলেন আমার স্বপ্নপুরুষ। ২০০৩ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর মাসিক আদর্শ নারী এবং মাদরাসা খাতুনে জান্নাত রা.-এর চাকরির সুবাদে আমার ঢাকায় আসা। এরপর থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সময়টায় ঢাকার বিভিন্ন সাহিত্যসভা ও লেখকদের প্রোগ্রামে অংশ নিতাম। বিশেষত জাতীয় প্রেসক্লাব, পাবলিক লাইব্রেরি, বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র, নজরুল একাডেমি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, কমলকুঁড়ি একাডেমি, স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদে এ জাতীয় প্রোগ্রাম বেশি হতো। কবি সুমন রায়হান, মালেক মাহমুদ, জালাল খান ইউসুফী এবং আমি বেশির ভাগ প্রোগ্রামে একসঙ্গে যেতাম। এজন্য তাদের অঙ্গনেও আমার পরিচিতিটা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ এসব প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি হয়ে আসতেন। আমরা ছিলাম প্রিয় কবির কথা ও কবিতার শ্রোতা, আর প্রিয় কবি ছিলেন আমাদের ছড়া-কবিতার শ্রোতা। কখনো কখনো প্রিয় কবির সামনে কথা বলারও সুযোগ পেতাম। বিষয়টা ভাবতেই মনে শিহরণ জাগে। তখন আমার লেখা কিছু বইও কবির হাতে তুলে দিই। তবে এতো কাছাকাছি গিয়েও আমার জানামতে কবির সঙ্গে কোনো ছবি তোলা হয়নি। কেউ যখন হৃদয়ের ফ্রেমে অঙ্কিত থাকে ছবির ফ্রেমটা তখন গৌণ হয়ে যায়। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তখন মরহুম ছড়াকার রকীবুল ইসলাম, মাসউদুল কাদির, শাহাদাত ফাহিম, রেজা হাসান, জিয়াউল আশরাফ, সায়ীদ উসমান, শামস আরেফিনরা মাঝে মাঝে প্রোগ্রামগুলোতে আসতেন। তারা তখন ঢাকার বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্র। কবির অসুস্থতাকালীন ব্যক্তিগত সহকারী অনুজপ্রতীম সাংবাদিক আবিদ আজম তখন মুহাম্মদ আলী আজম নামে ছড়া ও সঙ্গীত গাইতেন। তার সঙ্গীতগুলো মুগ্ধতা ছড়াত। তিন. কিংবদন্তির এই কবিকে নিয়ে অনেক স্মৃতিই জড়িয়ে আছে। একবার পাবলিক লাইব্রেরি হলে কবিতা পাঠ ও আলোচনা সভা। যথারীতি আল মাহমুদ প্রোগ্রামের প্রধান অতিথি। অনেক বড় কবি-সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত কবিরা একে একে ছড়া-কবিতা পড়লেন। আমিও পড়লাম। প্রোগ্রামের শেষ দিকে প্রধান অতিথির আলোচনার একপর্যায়ে কবি বললেন,...মাদরাসাপড়–য়া মঈন মুরসালিন, মুনীরুল ইসলাম এবং আরো কারো কারো ছড়া-কবিতা শুনলাম। বেশ মানোত্তীর্ণ লেখা। ওদের লেখা আমাকে ছুঁয়েছে। আমি যদ্দুর জানি, মাদরাসার ছেলেরা মেধাবী হয়, ওদের মেধাটা আজেবাজে কাজে ব্যবহৃত হয় না। তাই ওরা একনিষ্ঠভাবে চাষ করলে সোনা ফলাতে পারে। ওরা চমৎকার লেখনির মাধ্যমে ওদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও আলেম লেখকদের অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ভারত পাকিস্তানের আলেমরা তো ছিলেনই, আমাদের বাংলাদেশের মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদীরা লেখালেখি ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির অনুরাগ সৃষ্টি করেছিলেন, এদেশবাসীকে আজাদি পাগল করে তুলেছিলেন। মানুষের অন্তরে ব্রিটিশ সরকারবিরোধী আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানরা এখনো লিখে যাচ্ছেন। তিনি মাসিক মদীনা’র মাধ্যমে বিশ্বাসী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছেন। আলেম-উলামারা অনেক বইপত্র করছেন। মাঝে-মধ্যে সেগুলো আমার হাতে আসে। আমি বুড়ো মানুষ, সবার নাম মনে রাখতে পারি না। তারা ভালো লিখছেন, এগিয়ে যাচ্ছেন। বোরকাপরা একটা মেয়ের কবিতাও শুনলাম। ওর লেখাও আমার ভালো লেগেছে। আমি তো আর সবসময় থাকব না, সাহিত্যের হালটা বিশ্বাসীদের হাতে রাখতে হলে জীবনের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে হবে।... ফাতেমা বিনতে আলী নামের এক বোন বোরকা পরে প্রোগ্রামগুলোতে আসতেন। এখন তিনি ফাতেমা আলী নামে লিখেন। তিনিও কবিতা পড়েছিলেন। বোরকাটা তখন এখনকার মতো এতোটা ফ্যাশনেবল প্রচলন ছিল না। তখন বোরকা পরে সাহিত্যের প্রোগ্রামে আসা একটু কঠিনই ছিল।
কবি বিভিন্ন প্রোগ্রামেই বলতেন, আমি কবিতার জন্য সারাটা জীবন পার করেছি। এখন মানুষ আমাকে ‘কবি আল মাহমুদ’ বলে। সাহিত্যের জন্য কেউ তার জীবনের সবটুকু নিংড়ে দিলে সাহিত্য তাকে নিরাশ করে না। সাহিত্যের এ জগৎটা অনেক কঠিন একটা জগৎ। আগুন এবং গন্ধকের নদী সাঁতরে ওপারে পৌঁছুতে হয়। ‘গন্ধক’ আগুনের চেয়েও কঠিন দাহ্য পদার্থ। সাহিত্যের কোনো নির্ধারিত সিলেবাস নেই। সফলতা ছুঁতে হলে একজন লেখকের পৃথিবীর সব পেশা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। চিকিৎসক-প্রকৌশলী সম্পর্কে যেমন ধারণা থাকতে হবে, আবার গ্রামের একজন খেটে খাওয়া কৃষকের চরিত্র সম্পর্কেও জানতে হবে। মাটির স্বাদ-গন্ধ-রঙ বোঝার শক্তি থাকতে হবে। দেশকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হবে। আর একজন ঈমানদার লেখকের কুরআনের জ্ঞান তো থাকতেই হবে। এটা আমি অনেক পরে বুঝেছি।... চার. প্রোগ্রাম শেষে মাঝে মাঝে কবিকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সুযোগ হতো। তখন তিনি একটু-আধটু ব্যক্তিগত কথা বলতেন। এসব কথায় তাঁর আর্থিক টানাপোড়েন, আক্ষেপ, বেদনার ছায়াছবি ফুটে উঠত। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্নজনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও কবির অর্থকষ্টের কথাগুলো উঠে এসেছে। ২০০৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নাসির আলী মামুনের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেন,... দারিদ্র্য ও বৈরী পরিবেশের ভেতর দিয়ে আমাকে এগোতে হয়েছে, কেউ আমার বন্ধু হয়নি। ছোবল মেরে নিজেই উধাও হয়ে গেছে। আল্লাহ পাক আমাকে এখনো কবিতা লেখার সুযোগ দিচ্ছেন।...আমি একজন দুঃখী মানুষ, কেউ আমাকে দাঁড়াতে সাহায্য করেনি। বাংলাদেশে আমি একমাত্র কবি জেল খেটেছি, এক বছর এক মাস! বঙ্গবন্ধু আমাকে সাধারণ ক্ষমায় জেল থেকে মুক্তি দিলেন। বের হয়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ আমাকে চাকরি দিতে চায় না। তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে আমাকে চাকরি দিলেন। নইলে এতগুলো সন্তান নিয়ে কোথায় যেতাম আমি? আমার সন্তানদের আমি ভালো খাবার, ভালো কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমার স্ত্রী নাদিরা মাঝে-মধ্যে বলে, সন্তানদের দিকে আমি ভালোমতো নজর দিইনি।...[প্রকাশকাল : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, দৈনিক প্রথম আলো] কবি সুমন রায়হান প্রোগ্রাম শেষে প্রিয় কবিকে মাঝে মাঝে রিকশা কিবা সিএনজিতে বাসায় পৌঁছে দিতেন। তখন তার সঙ্গে সুখ-দুখের কিছু কথা হতো। সেই সুযোগটা আমার হয়নি অথবা আগ্রহ দেখাইনি। সুমন রায়হান পরে সেগুলো শেয়ার করতেন। শোনে ঈর্ষা হতো। আমিও যদি সেই সুযোগটা নিতাম, তাহলে কবির কাছ থেকে সুখ-দুখের কিছু কথা শুনতে পারতাম, শুনতে পারতাম কবিতার কথাও, আমার স্মৃতির ডায়েরিটা আরো সমৃদ্ধ হতো। পাঁচ. ২০০৫ সালের ৫ নভেম্বর প্রিয় মাহমুদ ভাই শিরোনামে একটি ছড়া লিখেছিলাম। ছড়াটি তখন একাধিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেটি হলোÑ সবুজ দেশের দুইটি ছেলে গাইছে ভাষার গান একটি ছেলে বামে চলে একটি ছেলের ডান। বামের বাঁকা পথ এড়িয়ে যেই ছেলেটি ডানে দূর আকাশের ঝিলিক পড়ে তাঁর কবিতা গানে। সেই ছেলেটা নতুন কবির মাথা গোঁজার ঠাঁই দুই বাংলার সেরা কবি প্রিয় মাহমুদ ভাই। সেটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্য পরিষদ-এর একটি অনুষ্ঠানে পড়েছিলাম। কবিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ছড়াটি শুনে কবি অনেক খুশি হয়েছিলেন। প্রিয় কবিকে আল্লাহ তায়ালা পরকালেও খুশি রাখুন। লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম [লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত সাময়িকী লেখকপত্রের সৌজন্যে লেখাটি প্রকাশিত] এনএইচ/ |