আশুরার ফজিলত
প্রকাশ: ০২ জুলাই, ২০২৫, ০৭:৩০ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

মুফতি যুবাইর মাহমুদ রাহমানি 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যেখানে বছরের প্রতিটি দিনেই লুকিয়ে আছে ইবাদতের সুযোগ এবং আত্মশুদ্ধির পথ। তবুও কিছু বিশেষ দিন এমন রয়েছে, যেগুলোর মর্যাদা ও ফজিলত অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। মুহাররম মাসের দশম দিন — ‘আশুরা’ — তেমনই এক দিন, যা ইতিহাস, তাকওয়া, আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর করুণা দ্বারা পরিপূর্ণ। এই দিনে প্রথিবীর ইতিহাসে ঘটে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন নবী মুসা (আ.)-এর ফেরাউন থেকে মুক্তি, এবং রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে নফল রোজা পালন। আশুরার ফজিলত শুধু অতীত স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি এক আত্মিক পরিশুদ্ধির ও আমলের সুবর্ণ সুযোগ, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে।

এখানে আমরা হাদিসে বর্ণিত আশুরার কিছু আমল সম্পর্কে আলোচনা করব।

এক. সর্বোত্তম নফল রোজা

أَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ، وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ»

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, রমজানের পরে সর্বোত্তম রোযা হলো আল্লাহর মাস মুহাররমে রোযা রাখা, আর ফরজ নামাজের পরে সর্বোত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদ (রাত্রির নামাজ)। (নাসাঈ: ১৩১৪)

দুই. পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয়

  عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ

আবু কাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, আশুরার রোযা আগের এক বছরের গোনাহ মাফ করবে। (সহীহ মুসলিম, ১৯৬, ইবনে মাজাহ, ১৭৩৮)

তিন. আদম (আ.)-এর তওবা কবুলের দিন

وفى يومِ عاشُوراء تابِ اللهُ علَى آدمَ وعلَى مدينةِ يُونسَ، وفيهِ ولدَ إبراهيمُ

আশরার দিনেই আল্লাহ্‌ আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল করেছিলেন এবং ইউনুস (আ.)-এর কওমের তাওবাও কবুল করেছিলেন। এই দিনেই ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্ম হয়েছিল। (মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান আল-মাগরিবী, জামি‘উল ফাওয়াইদ মিন জামি‘ইল উসূল ও মুজমা‘উয্-যাওয়াইদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫০৬।)

চার. হজরত নুহ (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়ের মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি লাভ

وفى رَجَب حَمل اللهُ نوحاً في السفينةِ، فَصام رَجب وأمرَ مَن معهُ أن يصُومُوه، فجرتْ بهمُ السفينةُ سَبْعة أشْهرِ آخر ذلك يَوْمُ عاشُوراء أُهبطَ علَى الجودِى، فصامَ نوحٌ ومَن معهُ والوحشُ شُكراً لله تَعالى،

আর রজব মাসে আল্লাহ্ নূহ (আঃ)-কে নৌকার মাধ্যমে ভাসমান রেখেছিলেন। তখন তিনি রজব মাসে রোযা রেখেছিলেন এবং তাঁর সাথিদেরও রোযা রাখতে আদেশ করেছিলেন। তারপর নৌকাটি সাত মাস ভেসে ছিল। শেষে আশুরার দিন তারা জুদি পাহাড়ে নেমে এসেছিলেন। তখন নূহ (আ.), তাঁর সাথিরা এবং বন্য পশুরাও আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ রোযা রেখেছিল। (প্রাগুক্ত)

পাঁচ. হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়ের ফেরআউনের কবল থেকে মুক্তি

  عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدِمَ الْمَدِينَةَ فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ؟» فَقَالُوا: هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ، وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ»

ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিন রোযা রাখছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা এই দিনটিতে রোযা রাখছো কেন?’ তারা বলল, ‘এটি এক মহৎ দিন। এই দিনে আল্লাহ মূসা (আ.) ও তাঁর কওমকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার কওমকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তাই মূসা (আ.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ দিনে রোযা রেখেছিলেন, আমরাও তাই রোযা রাখি।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমরাই মূসা আ. কে অনুসরণ করার তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার ও ঘনিষ্ঠ।’ অতঃপর তিনি (সা.) নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদেরও এই দিনে রোযা রাখার আদেশ দিলেন। (সহীহ মুসলিম, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৭৯৬, হাদীস: ১২৮, ১১৩০

ছয়. আশুরার দিন পরিবারে খরচ ও স্বচ্ছলতা 

- عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ فِي يَوْمِ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ سَنَتَهُ كُلَّهَا».

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন: “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবার-পরিজনের ওপর খরচ বাড়াবে, আল্লাহ তা'আলা পুরো বছর তার রিজিক বাড়িয়ে দেবেন।” (আল-মুআজাম আল-আওসাত, হায়ছামী: মাজমাউ যাওয়ায়েদ ৩/১৮৯)

সাত.  আশুরার রোজা পূর্বে ফরজ ছিল

  عَنِ الزُّهْرِيِّ، قَالَ: أَخْبَرَنِي عُرْوَةُ بْنُ الزُّبَيْرِ، أَنَّ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ بِصِيَامِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ كَانَ مَنْ شَاءَ صَامَ وَمَنْ شَاءَ أَفْطَرَ»

হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, “আল্লাহর রাসুল (সা.) আশুরার দিনে রোযা রাখতে আদেশ করেছিলেন। পরে রমযান মাসের রোযা ফরজ করা হলে, আশুরার রোজা ইচ্ছাধীন করে দেওয়া হয়।”

আট. হজরত হোসাইন রা.-এর শাহাদাত 

১০ই মুহাররম বা আশুরার দিন নবি দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। 

আশুরা শুধু একটি তারিখ নয়, এটি একটি শিক্ষা, একটি উপলক্ষ, একটি আত্মশুদ্ধির দিন। এই দিনের রোজা আমাদের গুনাহ মাফের সুযোগ দেয়, দান ও ইবাদতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি। অতএব, মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত আশুরার প্রকৃত ফজিলত বোঝা, বিদআত ও বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থেকে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আশুরার ফজিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন — আমিন।

এমএইচ/