বৈরিতা ভুলে কাছাকাছি জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন!
প্রকাশ:
০২ জুলাই, ২০২৫, ০৫:৪২ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| বিশেষ প্রতিনিধি || দেশে ইসলামি ধারার যে কয়টি দল রয়েছে সেগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সবার শীর্ষে এটা মোটামুটি সবাই স্বীকার করেন। জামায়াতের পরই যে দলটি গত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে সেটি হচ্ছে পীর সাহেব চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তবে দল দুটি ইসলামি নীতি ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও পরস্পরের মধ্যে কখনোই সুসম্পর্ক ছিল না। বরাবরই দল দুটির মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক দেখা গেছে। এক দলের নেতারা আরেক দলের বিরুদ্ধে নানা সময় বক্তব্য দিয়েছেন। তবে দীর্ঘদিনের সেই বৈরিতা ভুলে ইসলামি ধারার শীর্ষ দুটি দল অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি দলের মধ্যে একটা সমঝোতার গুঞ্জন জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে। বিএনপির বিপরীতে বৃহৎ যে জোট বা নির্বাচনী মোর্চা গড়ার প্রক্রিয়া চলছে সেখানে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শক্তি-সামর্থে্যর বিচারে দল দুটি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকায় তারা অনেকটা সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। সবশেষ গত ২৮ জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন আয়োজিত মহাসমাবেশে দলটি অন্যান্য দলের বিভিন্ন নেতাদের আমন্ত্রণ জানায়। বিভিন্ন দলের একজন করে প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর চারজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা তাতে অংশ নেন। এর মধ্যে দলের একজন নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল এবং দুইজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রয়েছেন। আরেকটি দলের মহাসমাবেশে কোনো সংগঠনের চারজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার অংশগ্রহণই প্রমাণ করে দল দুটির মধ্যে কতটা সুসম্পর্ক বিরাজ করছে। আগামী ১৯ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেও ইসলামী আন্দোলনকে দাওয়াত করা হবে এবং দলটির একাধিক নেতা তাতে অংশ নিতে পারেন। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন অতীতের বৈরিতা ভুলে কাছাকাছি আসা শুরু হয় মূলত গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপর জামায়াতের মগবাজার কার্যালয়ে একটি মতবিনিময় সভায় কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক বেশ কিছু দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামি দলগুলোর একটি জোটের কথা আলোচনায় আসে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বরিশাল সফরের গিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে দেখা করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। সেখানে দলের নেতাদের নিয়ে মধ্যাহ্নভোজেও অংশ নেন জামায়াত আমির। গত ৩০ এপ্রিল জামায়াত আমির রাজধানীর একটি সেমিনারে ইসলামি দলগুলো নিয়ে একটি জোট করার আগ্রহের কথা জানান। সেই মঞ্চে পীর সাহেব চরমোনাইও ছিলেন। যদিও তিনি তখন জোটের ব্যাপারে কিছু বলেননি। মূলত এভাবেই দল দুটি অতীতের বৈরিতা ভুলে কাছাকাছি আসতে শুরু করে। রাজনীতির মাঠে গুঞ্জন রয়েছে, আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামি দলগুলো এবং এনসিপি ও ডানপন্থী আরও কিছু দল নিয়ে একটি বৃহৎ নির্বাচনী মোর্চা হচ্ছে। নীতি ও আদর্শগতভাবে দলগুলো কাছাকাছি না গেলেও একক প্রার্থী দেওয়ার প্রশ্নে একসঙ্গে কাজ করবে। তবে বিষয়টি এখনো আলোচনা পর্যায়েই রয়েছে। দলগুলোর নেতারা এ ব্যাপারে আশাবাদী হলেও আদৌ তা বাস্তবায়ন হবে কি না তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির ও শায়খে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের পুরনো কিছু বক্তব্য নতুন করে ভাইরাল হচ্ছে। সেখানে তিনি জামায়াত ও শিবির সম্পর্কে কড়া সমালোচনা করেছেন। বিষয়টি ঐক্যপ্রয়াসী দুটি দলের জন্যই বিব্রতকর। তবে তারা বলছেন, নতুন যে ঐক্যের আলোচনা হচ্ছে সেটা কোনো জোট নয়, একটি নির্বাচনী সমঝোতা। গতকাল মঙ্গলবার (১ জুলাই) নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের টকশোতে অংশ নেন মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। সেখানেই তিনি প্রথমেই জামায়াতের সঙ্গে জোটের ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি হন। জামায়াত-শিবির সম্পর্কে তাঁর অতীতের কিছু বক্তব্যও নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। জবাবে তিনি জানিয়েছেন, তাঁরা জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে আগে যে ধারণা পোষণ করতেন কিংবা দলটিকে যেভাবে দেখতেন এখনো সেভাবেই দেখেন। এতে একচুলও হেরফের হয়নি। জামায়াতও তাদেরকে যেভাবে দেখত এখনো সেভাবেই দেখে। তবে দেশ, জাতি ও মানবতার স্বার্থে তারা কিছু ছাড় দিয়েছেন। এটা আদর্শিক কোনো জোট নয়, নিছক নির্বাচনী সমঝোতা। এক্ষেত্রে তিনি আমেরিকা ও ইরানের উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, চির বৈরী দুটি দেশ যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৮৭ সালে। চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীমের হাত ধরে যাত্রা করা দলটির সূচনালগ্নের নাম ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। যদিও পরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামে নিবন্ধিত হয়। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন মূলত ছিল বিভিন্ন ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের যৌথ প্লাটফর্ম। সেই প্লাটফর্মে জামায়াতের মরহুম নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীরও থাকার কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি এই প্লাটফর্মে যোগ দেননি। পরে পীর সাহেব চরমোনাই এই নামে স্বতন্ত্র দল হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। মূলত সেই ঐক্যপ্রয়াসী প্লাটফর্ম বানচাল হওয়ার পেছনে দায়ী করা হয় জামায়াতকে। সে কারণে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু থেকেই জামায়াতের ঘোর বিরোধী। নব্বইয়ের দশকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে এই জোট যখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয় তখন পীর সাহেব চরমোনাই মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যান। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল নারী নেতৃত্ব। এছাড়া এই জোটে জামায়াতে ইসলামী থাকায় তিনি সেখানে যেতে আগ্রহ বোধ করেননি। ২০০১ সালে পীর সাহেব চরমোনাই এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ২০০৬ সালে মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম ইন্তেকাল করলে তাঁর ছেলে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম ইসলামী আন্দোলনের আমির নির্বাচিত হন। তবে জামায়াতের সঙ্গে দলটির যে দূরত্ব ছিল তা আর ঘোচেনি। প্রতিষ্ঠার তিন যুগেরও বেশি সময় পর অবশেষে জামায়াতের অনেকটা কাছাকাছি যাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এমএইচ/ |