ফজরের নামাজ: নিঃসঙ্গ ভোরের প্রহর ও আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা
প্রকাশ: ০২ জুলাই, ২০২৫, ০২:২২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| মুহাম্মদ মিজানুর রহমান ||

ফজর—যা দিনের প্রথম আলো, আত্মশুদ্ধির এক অপূর্ব সূচনা। অথচ এই নামাজটিই আজ মসজিদগুলোতে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ। ইকামতের ধ্বনি বেজে উঠে, কিন্তু কাতারে কাতারে মুসল্লির বদলে দেখা যায় ফাঁকা জায়গা। ঘুম, ক্লান্তি, কিংবা গাফেলতির যুপকাষ্ঠে বলি হচ্ছে দিনের সবচেয়ে বরকতময় মুহূর্তটি।

একসময় গ্রামের মসজিদগুলোয় ফজরের জামাতে ভিড় থাকত চোখে পড়ার মতো। শহরেও ছিল সাড়া। কিন্তু এখন? আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, স্মার্টফোন-নির্ভর রাতজাগা জীবনধারা ধীরে ধীরে আমাদের এই মৌলিক কর্তব্য থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। অথচ রাসূল (সা.) ফজরের জামাতকে দিয়েছেন অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা—যার তুলনা আর কোনো নামাজে নেই। এই ক্রমহ্রাসমান চিত্র শুধু একেকটি মসজিদের নয়, বরং একটি জাতির আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য হ্রাসেরও ইঙ্গিত। তাই প্রশ্ন জাগে—আমরা কি আবার জাগবো ফজরের আলোতে? নাকি আমাদের মসজিদগুলো ভোরে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠবে? 

অথচ ইসলামে ফজরের নামাজ এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “ফজরের কুরআন পাঠ নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষ হয়।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৭৮)।

অন্যদিকে হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজর ও আসরের নামাজ আদায় করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়ে ঘর থেকে বের হয় তার হাতে ইমানের ঝান্ডা থাকে। আল্লাহ তাযালা তার জিম্মদার হয়ে যান। কেউ তার সাথে শত্রুতা করলে স্বয়ং আল্লাহ তার মোকাবেলা করেন। ফজরের নামাজ জামাতের সহিত আদায় করলে অর্ধ রাত্রি ইবাদত করার সওয়াব পাওয়া যায়। আর অন্ধকারে যারা মসজিদে যায় তাদের জন্য পূর্ণ নুরের সুসংবাদও এসেছে।

এছাড়াও ফজরের নামাজের ব্যাপারে এসেছে আরও অনেক খোশখবর। এই নামাজ মানুষের আত্মিক ও শারীরিক শক্তির সূচনা করে। এটি আলস্যকে দূর করে, হৃদয়ে প্রশান্তি আনে এবং সারাদিনের জন্য বরকত ও নিরাপত্তার হাতছানি দেয়।


কিন্তু কেন কমে যাচ্ছে ফজরের মুসল্লি? 

দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ অধিকাংশ মসজিদেই ফজরের জামাতে মুসল্লির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে এর পেছনে রয়েছে কিছু সুস্পষ্ট কারণ।

প্রথমত: রাতজাগা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্মার্টফোন, টেলিভিশন বা সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে মানুষ রাতে ঘুমাতে দেরি করে। ফলে ফজরে উঠতে কষ্ট হয়। অথচ এশার নামাজের পরপরই ঘুমিয়ে যাওয়া ছিল নবীজির নিয়মিত অভ্যাস, ইসলামের বড় একটি সুন্নাহ। সেই সুন্নাহ আমরা আজ ছেড়ে দিয়েছি অবলীলায়।

মুসলিম স্টুডেন্ট কমিউনিটির উপদেষ্টা আজিম চৌধুরী বলেন,‘বর্তমানে মানুষ ঘুমাতে যায় দেরি করে, ঘুমাতে গেলে সাথে মোবাইলও নিয়ে যায়, তারপর মোবাইলে ওয়াজও দেখে, টিকটকও দেখে।’

দ্বিতীয়ত: আধ্যাত্মিক উদাসীনতা। অনেকের মধ্যেই ফজরের নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি নেই।

দন্ত চিকিৎসক এনামুল কবীর ‘ফজরের নামাজে উপস্থিত হতে না পারার ব্যাথা দিলে অনুভব না করা ও এটাকে অপরাধ মনে না করাকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’

তৃতীয়ত: ফজরের নামাজের ক্ষেত্রে রয়েছে পারিবারিক অবহেলা। বেশির ভাগ পরিবারে নামাজের গুরুত্ব বা পরিপার্শ্বিক আলোচনা, চর্চা না থাকায় নতুন প্রজন্ম মসজিদ বিমুখ হয়ে পড়ছে।

একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত রাহাতুল রহমান নাহিন বলেন, `ফজরের নামাজে উপস্থিত হতে না পারার পেছনে রয়েছে আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব, পরিবারের সদস্যদের অনীহা, কাজের চাপ এবং দেরি করে ঘুমানো।’ দি এডুকেটরস-এর প্রিন্সিপাল, দাওয়াত ও তাবলিগের জিম্মাদার সাথি তানভীর হায়দার বলেন, ‘বিশ্লেষণ করলে বিস্তারিত বিষয় সামনে আসবে যেমন লাইফ স্টাইল, বিভিন্ন ডিভাইস মোবাইল, ল্যাপটপ এর কারণে দেরিতে ঘুমোতে যাওয়া এবং সকালে উঠতে না পারা এটা একটা সাধারণ কারণ। মূল কারণ হিসেবে আমার মনে হয় ঈমানের স্তর বা ঈমানের দুর্বলতা।’ আহমদবাগ জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মুফতি ফাহিম মাহমুদ বলেন, ‘দিন দিন মানুষের ঈমান-আমল কমে যাওয়ার কারণেই ফজরে মুসল্লি কমে যাচ্ছে।
এজন্য আমাদের নামাজকেন্দ্রিক একটা মেহনত চালু করা দরকার।’ 

সমাধানে সম্ভাব্য উদ্যোগ
বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণে কিছু উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এলাকাভেদে একেক ধরনের উদ্যোগ ফলপ্রসু হতে পারে।

‘আল-ফজর টি’ টাইপ আয়োজন: সপ্তাহে এক বা দুইদিন বা প্রতিদিন ফজরের পর মুসল্লিদের নিয়ে চা, হালকা নাশতা ও ইসলাহী আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে তৈরি হবে সামাজিক বন্ধন। ইতিমধ্যে দুয়েকটা মসজিদের এই আয়োজন ইতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে।

ঘরে ঘরে তাবলিগি ধাঁচে দাওয়াত: মসজিদের দায়িত্বশীলরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফজরের গুরুত্ব বুঝাতে পারেন। ফজরের আগেও তরুণ-প্রবীনদের সমন্বয়ে চলতে পারে দাওয়াতি কারযক্রম। তানভীর হায়দার  বলেন, প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক ও মসজিদ ভিত্তিক সেটা হতে পারে। ভিন্ন এলাকায় সফর করার কারণে এই উদ্যোগের ইতিবাচক ফলাফল দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এমনও মসজিদ আছে জুমায় যত মুসল্লি হয় তারচেয়েও ফজরে বেশি দেখেছি। ফাহিম মাহমুদ  বলেন, ’ নবীজির জমানায় আজানের পরে ডাকাডাকির একটা রেওয়াজ ছিল সেটা চালু করা যেতে পারে।’

বাচ্চাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার চালু: নিয়মিত ফজরের জামাতে অংশগ্রহণ করা শিশুদের জন্য পুরস্কার বা উৎসাহমূলক ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে। এ উদ্যোগটিও দুয়েকটি মসজিদ গ্রহণ করে বেশ সফল হয়েছে। এ পুরস্কারের আওতায় তরুণদের নিয়ে আসতে পারেলে ব্যাপক একটা প্রভাব পড়তে পারে।

পরিবারে ইসলামী পরিবেশ গঠন: ফজরের আগে ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব অভিভাবকের। মা-বাবাদের এ ক্ষেত্রে নিতে হবে প্রধান ভূমিকা। ঘর থেকেই ফজরের জন্য প্রস্তুতি নিতে শেখানো জরুরি। ঘর থেকেই ফজরের জামাত তৈরি হতে পারে। ফাহিম মাহমুদ বলেন, ‘পরিবারের যারা কর্তা আছেন তাদেরকে বুঝানো যেতে পারে আপনার ছেলে, ভাই , ভাতিজাদেরও নিয়ে আসেন। সব মুরুব্বিরা যদি তাদের সন্তানদের ফজরে নামাজে নিয়ে আসেন তাহলে অবশ্যই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এজন্যই পারিবারিক সচেতনতা প্রয়োজন।’

আলেম-ওলামা ও তাবলিগের সাথিদের দায়বদ্ধতা : আল্লাহর ঘর পূর্ণ রাখতে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব আলেমদের কাঁধে। ফজরের গুরুত্ব ও ফজিলত মানুষ জানে না—এটা বড় কারণ। তাই সচেতনতার কাজটিই তারা করতে পারেন।এনামুল কবীর বলেন, ‘ইমাম সাহেব বিভিন্ন নামাজের পরে এবং জুম্মায়ও এই ব্যাপারে কিছু তারগীবমূলক কথাবার্তা বলতে পারেন।’ ফাহিম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা যারা খেদমতে আছি বয়ানে আমাদের নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি। শুক্রবারে অল্প সময় বয়ান হয়, যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে না তারা পরে আসার কারণে সেই বয়ান শুনেও না। এজন্য প্রত্যেক নামাজের পরে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরা যেতে পারে।’ 

আর তাবলিগ জামাত মানুষকে মসজিদমুখী করার জন্যই যাত্রা করে। তাদের মূল মেহনতই নামাজ কায়েম করা। সুতরাং ফজরে উপস্থিতি কমে যাওয়া তাদের জন্যও আত্মবিশ্লেষণের বিষয়। তাবলিগের ভাইয়েরা নতুন করে যুবসমাজকে টার্গেট করে অনুপ্রেরণামূলক ভাষায় ফজরের গুরুত্ব বুঝাতে পারেন।  তানভীর হায়দার  বলেন, ফজরের আগে ডাকাডাকির কাজটা তাবলীগের সাথীরা প্রথমে শুরু করতে পারেন। পরবর্তিতে সাধারণ মুসল্লিদেরকে সাথে নিয়ে করলে হয়তো আশানুরূপভাবে ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আজিম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দাওয়াতি পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করতে হবে। তাকওয়াবান মুসলিম অবশ্যই জামাতে শরিক হবে।’ 

ফজরের নামাজ শুধু একটি ইবাদত নয়—এটি একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব গঠনের সময়। আমরা যদি সমাজ, পরিবার ও মসজিদকে কেন্দ্র করে সামান্য কিছু উদ্যোগ নিই, তাহলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া এই ভোর আবারও হয়ে উঠতে পারে দীনের আলোকময় সূচনা। আসুন, জেগে উঠি ফজরের আলোয়, জাগিয়ে তুলি হৃদয়ের ঈমান।

এসএকে/