কাশ্মীরকে ‘নতুন গাজা’ বানানোর ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
প্রকাশ:
৩০ জুন, ২০২৫, ১২:৫২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| হামিদ মীর || কেউ কি জানেন পঞ্চাশ বছর পর তিনি জীবিত থাকবেন কি না? ডোনাল্ড ট্রাম্প, নেতানিয়াহু এবং খামেনি সম্পর্কে লেখার আগে আমার নিজের কথাও বলা উচিত যে, পঞ্চাশ বছর পর আমিও জীবিত থাকবো না। আজ আমরা আমাদের পদ, ক্ষমতা এবং দুনিয়ার মর্যাদার ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা আমাদের এই মর্যাদা বজায় রাখতে সবকিছুই করি, কিন্তু ভাবি না যে পঞ্চাশ বছর পর পৃথিবী আমাদের কিসের জন্য মনে রাখবে। আমি ভাবছিলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মে ২০২৫-এ পাকিস্তান এবং ভারতজুড়ে যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন। জুন ২০২৫-এ ইসরায়েল ও ইরানে যুদ্ধবিরতি স্থাপন করিয়েছেন। এই দুটি যুদ্ধবিরতি করিয়ে তিনি শান্তির নোবেল পুরস্কার পেতে চান, কিন্তু যতক্ষণ না ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান হয়, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থায়ী হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প দুটি যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন, কিন্তু কাশ্মীরে যথারীতি ভারতের অত্যাচার চলছে এবং গাজায় ইসরায়েল প্রতিদিন বোমাবর্ষণ করছে, ত্রাণের লাইনে থাকা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। এই গণহত্যা অক্টোবর ২০২৩ থেকে চলছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য– আন্তর্জাতিক মিডিয়া বলে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৫০-৬০ হাজার, কিন্তু কিছু ইসরায়েলি সংবাদপত্র সংখ্যাটি এক লাখ পর্যন্ত বলে দিয়েছে। পঞ্চাশ বছর পর ইহুদিবাদীরা নেতানিয়াহুকে একজন নায়ক হিসেবে মনে করবে, যিনি গাজায় এক লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি হত্যা করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও নেতানিয়াহুর বন্ধু ও ফিলিস্তিনিদের শত্রু হিসেবে মনে করবে। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের কথা কেউ ভাববেন? যারা ‘গাজা হলোকাস্ট’ চুপচাপ দেখেছেন, মাঝে মাঝে এই গণহত্যার নিন্দায় একটি বিবৃতি দিয়েছেন, অথবা ওআইসির মাধ্যমে একটি প্রস্তাব পাস করিয়েছেন। মুসলিম দেশের অধিকাংশ শাসক ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হিসেবে দুই-রাষ্ট্র সমাধান পছন্দ করেন, যা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন ১৮১-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু কোনো মুসলিম শাসক বলেন না যে, ইসরায়েল এই রেজোলিউশনের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত এবং তারপর এটিই সবসময় ভেঙে দিয়েছে। ইসরায়েল ‘গাজা হলোকাস্ট’ এর কারণ হিসেবে অক্টোবর ২০২৩-এ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের ইসরায়েলের ওপর হামলাকে উল্লেখ করেছে। কিন্তু কোনো মুসলিম শাসক বলেননি যে, হামাস এই হামলা ইসরায়েলের ওপর নয়, বরং সেই অঞ্চলে অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য করা হয়েছিল, যেখানে ইসরায়েল ১৯৪৮-এর পরে রেজোলিউশন ১৮১ ভঙ্গ করে অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছিল। কারণ এই এলাকার কিছু অংশ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। মনে রাখবেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৭৪-এ রেজোলিউশন ৩৩১৪-এ নির্ধারণ করেছে যে, অবৈধ ও দখলদারী বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম বৈধ গণ্য হবে। আমি হামাসের পক্ষ থেকে এই হামলায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের লক্ষ্যভাগে নেওয়া সমর্থন করি না, কিন্তু হামাসের অবস্থান হলো তারা হামলা করেছে সেই সব ইহুদী বসতি বা অনুপ্রবেশকারীর ওপর যারা অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি অঞ্চল দখল করেছিল। কারণ ইসরায়েলি বাহিনী গাজাকে কেন্দ্র করে আমাদের পানি ও খাবার বন্ধ করে রেখেছিল। হামাস দাবি করে, ইসরায়েল ও আমেরিকা ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে তাড়িয়ে সেখানেই ইহুদিদের বসতি স্থাপন করতে চায়। একজন ফরাসি সাংবাদিক ‘জাঁ পিয়েরে ফ্ল্যাঁ’ গাজার ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যেখানে উল্লেখ করেছেন, ১৯৬৫ সাল থেকেই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার পরিকল্পনা চলছে। প্রথম দিকে ইরাক বা লিবিয়ায় পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল। ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ গাজার ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের জন্য একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করে এবং ফিলিস্তিনিদের জর্ডানের দিকে ঠেলে দেয়। এগুলোর ফলে গাজায় প্রতিরোধ তীব্র হয় এবং ১৯৭০ সালে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্যা লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (PFLP) তিনটি বিমান অপহরণ করে। কিছু পশ্চিমা পর্যবেক্ষক আজ হামাসকে ইরানের প্রক্সি হিসেবে মনে করেন। পঞ্চাশ বছর আগে পিএলও ও আয়াতুল্লাহ খামেনির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, কারণ খামেনির সমর্থকরা পিএলও থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ পেত। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর পিএলওর নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীক হয়েছিলেন। তারপর মুসলিম দেশগুলোর শাসকেরা তাদের আমেরিকার সহায়তায় ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি অনুযায়ী ইয়াসির আরাফাতকে একটি দুর্বল ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র দিয়ে পিএলওকে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়া হয়, পিএলওর সুনাম খর্ব হওয়াতে হামাস সামনে আসে। হামাসের বেশির ভাগ নেতার আবেগীয় বা পারিবারিক সম্পর্ক সেই অঞ্চলগুলোর সঙ্গে যেগুলো ইসরায়েল দখল করেছিল। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন অ্যাল-জোরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইসমাইল হানিয়ার পরিবারও জোরার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গ্রামটি মজদেল শহরের কাছে অবস্থিত। ১৯৪৮ সালে জোরা ও মজদেল ফিলিস্তিনের অংশ হয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েল সেখানে দখল করে ‘আশকলন’ নামে নতুন শহর গড়েছিল। গাজায় বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থী বাস করছিলেন, যারা তাদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা। বর্তমানে ইসরায়েল ১৮১ রেজুলেশনের মাধ্যমে তাদের দেওয়া ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ অঞ্চলে দখলদারিত্ব করছে। এর মধ্যে জাফা ও আন-জিলিল (বাইরা এল সবাসহ)-সহ অন্যান্য বড় আরব অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত, যাদের নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে। জাফা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে ‘কুরইয়াত সালমা’ নামে একটি প্রাচীন বসতি ছিল। এখানে বিশিষ্ট সাহাবি সালমা ইবনে হিশাম রা. শহীদ হন এবং এই পল্লী তাদের নামে স্থাপিত হয়েছিল; এখানে তাদের কবরও ছিল। ইসরায়েল সেখানে বুলডোজার চালিয়ে দেয় এবং এই জায়গাটিকে ‘কাফর শালিম’ নামে পরিচিত করে। এক সময় আশকলন ও সালমা উভয়ই গাজার অন্তর্ভুক্ত ছিল। গাজায় ‘সাঈদ হাশিম ইবনে আব্দুল মনাফ’ নামে একটি মসজিদ রয়েছে। এটি সেই সাঈদ হাশিম ইবনে আব্দুল মনাফ – যিনি নবী করিম সা.-এর পূর্বপুরুষ – তাদের নামে নির্মিত এবং ‘বনু হাশিম’ নামে পরিচিত গোত্রের নামের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ব্যবসায়িক কাজে গাজায় আসেন, এখানে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তিনি গাজায় সমাহিত হন। ইমাম শাফেয়ি রা-এরও ‘বনু হাশিম’ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তাঁর পিতা ইদ্রিস গাজায় বসবাস করতেন। ইমাম শাফেয়ি নিজেও গাজায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর পিতা ইদ্রিসের কবর গাজায় অবস্থিত। ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বহিষ্কার করতে চান। ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে বহিষ্কারের পরিকল্পনা ৫০ বছর আগের এবং আগামী ৫০ বছর ধরে এটি কার্যকর হবে না বলা হচ্ছে। যে মুসলিম শাসকরা ফিলিস্তিন ইস্যুর সমাধান হিসেবে ‘দ্বি রাষ্ট্র সমাধান’ ঘোষণা করেন, তারা কি বলতে পারবেন– ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো থেকে দখল উঠে না গেলে এই সমাধান কার্যকর হতে পারে? দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবাদিক আজাদ ঈসা, যিনি ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরে রিপোর্ট করেন, তার বই Hostile Homelands-এ নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদির গোপন জোটের কথা লেখেন। তিনি বলেছেন, মোদি ইসরায়েলের সহায়তায় কাশ্মীরে ‘নতুন’ গাজা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদি আমরা গাজার মানুষদের রক্ষা করতে না পারি, তবে কাশ্মীরের মানুষদের রক্ষা করা কঠিন হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে– ৫০ বছর পর আমাদের উত্তরসূরিরা আমাদের কী নামে স্মরণ করবে? [হামিদ মীর পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক। পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক জং থেকে লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা] এসএকে/ |