ক্যারিয়ার নিয়ে আপনি কতোটা সচেতন?
প্রকাশ: ১৪ জুন, ২০২৫, ০৬:২৫ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

আরিফ আজাদ

চিকিৎসার জন্য আমি একবার চেন্নাই গিয়েছিলাম। সেই টানা দুই মাসের সফরে, চেন্নাই শহরটাকে একটু আধটু খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, চেন্নাই শহরের অলিতেগলিতে সব স্টার্টাপ। একটা সামান্য চায়ের দোকান (টি-শপ) যে এত চমকপ্রদ হতে পারে, একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকানকে যে এত চমৎকারভাবে সাজানো যায়, চেন্নাই শহরে এসব না দেখলে হয়ত বুঝতে পারতাম না।

ইন্ডিয়ানদের প্রতি আমার আলাদা কোনো অনুরাগ নেই। তবে, চেন্নাই শহরের সেই স্বল্প কয়েকটা দিন থাকার পর মনে হয়েছে—ওখানকার মানুষগুলো প্রচণ্ডরকম কর্মতৎপর।

মধ্যপ্রাচ্যে যারা থাকেন, বিশেষ করে সৌদি আরব, দুবাই ইত্যাদি জায়গায়, তারা হয়ত অকপটে স্বীকার করবেন যে—এসব দেশে ইন্ডিয়ানদের রাজত্ব ঠিক কীরকম। আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ আমি সৌদিতেও ছিলাম, দুবাইতেও কিছুদিন থেকেছি। সেখানে যে সুপারশপটা সবচেয়ে গোছানো আর পরিপাটি, খোঁজ নিয়ে জেনেছি সেটার মালিক ইন্ডিয়ান। যে ফার্মেসিটা দেখে চমৎকৃত হতে হয়, সেটার মালিক থেকে শুরু করে কর্মচারী—সকলে ইন্ডিয়ান। ভালো ভালো ব্যবসাগুলোর অধিকাংশ জায়গাতে ইন্ডিয়ানদের দখলদারিত্ব চোখে পড়ার মতো।

ইন্ডিয়ানদের প্রশংসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে, ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা করে আমার মনে হয়েছে—তাদের বড় একটা অংশ ভীষণরকম কর্ম-মুখী এবং সৃজনশীল। ঠিক একই ঘটনা আপনি টেক দুনিয়াতেও দেখবেন। গুগলের সিইও থেকে শুরু করে জায়ান্ট সব টেক কোম্পানিগুলোতে ইন্ডিয়ানদের জয়জয়কার। সিলিকনভ্যালি যেন একটুকরো ইন্ডিয়া।

দুই.

গ্রামে এলে আমার প্রচুর মন খারাপ হয়। রাস্তাঘাটে সব ছেলেপিলের হাতে হাতে মোবাইল। মোবাইলের মাঝে তারা চোখমুখ ডুবিয়ে রাখে। বাইরে বেরুলে তো হোঁচটই খেতে হয় আজকাল—জায়গায় জায়গায় চলে মোবাইলে ভিডিও ধারণের দৃশ্য। শার্টের কলার উঁচা করে দিয়ে একজন হেঁটে আসছে নায়কের ভঙ্গিতে—ফিল্মি স্টাইলে হাত নেড়ে নেড়ে। তার পাশে আরও দুজন—শক্ত চোখমুখ। একজন সেসব মোবাইলে ধারণ করছে।

বলিউড বা ঢালিউডের একটা মিউজিক ব্যাকগ্রাউন্ডে লাগিয়ে, এই ভিডিও টিকটকে ছাড়বে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তাদের দুরন্ত কৈশোর।

তারই বয়েসি একটা ছেলে দুনিয়ার অন্যপ্রান্তে যেখানে রাতদিন এক করে কোডিং শিখছে, ডিজিটাল মার্কেটিং শিখছে, এআই দিয়ে বিজনেস মডেল তৈরির কলাকৌশল শিখছে, সেখানে আমাদের দেশের অধিকাংশ কিশোরের দিন কাটছে টিকটক করে আর ভিডিও গেইমস খেলে।

এসব করতে করতে পড়াশোনারও বারোটা বাজায়। বাপ মায়ের উপর বোঝা হয়ে উঠে এবং বাপের টাকা খরচ করে একপর্যায়ে বিদেশ চলে যায় শ্রমিক ভিসায়।

এক বিশাল জনশক্তির এত বিপুল অপচয় দুনিয়ার আর কোথাও হয় কী না আমার জানা নেই।

তিন.

আপনারা যারা আমার এই লেখাটা পড়বেন, যারা এখনও ক্যারিয়ার গড়ার দ্বারপ্রান্তে আছেন এবং এখনও যাদের মাঝে বিপুল তারুণ্য মজুদ আছে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই বলি—Time is the best currency. সময়টাকে আপনি যেভাবে কাজে লাগাবেন, আপনার জীবনটা সেরকমই আকৃতি পাবে।

আপনি যদি মনে করেন যে, দিনের বেশিরভাগ সময় আপনি ফেইসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম স্ক্রল করে কাটাবেন, তাহলে দিনশেষে ফলাফলও তেমনটাই হবে। একটা সময়ে গিয়ে আপনার মনে হবে—আপনার জীবনটা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। কনস্ট্রাকটিভ কিছু তো করতে পারলেনই না, একটা ভালো ক্যারিয়ারের জন্য ভালো কোনো স্কিল শেখার পেছনেও আপনি সময় ব্যয় করেননি৷ তখন পেছনে তাকিয়ে এই অনবরত, সীমাহীন স্ক্রলিংয়ের কথা মনে পড়লেই বিষণ্ণতায় ভেঙে পড়তে হবে৷ আপনি তখন ভাববেন—‘আহা, এই সময়গুলোকে কী দুর্দান্তভাবেই না কাজে লাগানো যেত!’

এই আফসোস আর হতাশা যেন আপনাকে ধ্বংস না করে, তাই আমি বলব—একটু হিশেবনিকেষ করুন জীবনটাকে নিয়ে৷ প্রতিদিনের ২৪টা ঘণ্টা কী কাজে ব্যয় করছেন তার একটা টোটাল চিত্র তৈরি করে, নিজে নিজের কৈফিয়ত নিন।

এই উত্তর আধুনিক যামানায়, স্কিল শেখার কোনো দ্বিতীয় বিকল্প নেই। সত্যিকার অর্থেই নেই। এখন তো এআইয়ের যুগ, এই যুগে স্কিল শেখেই যেখানে টিকে থাকা মুশকিল, সেখানে স্কিল-বিহীন মানুষগুলোকে আগামীর দুনিয়াতে গণনা করা হবে ‘অথর্ব’হিশেবে। শুনতে একটু কেমন লাগলেও এটাই সত্য।

ফেইসবুকে, টিকটকে অনবরত সময় ব্যয় না করে, প্রোগ্রামিং শিখেন, কোডিং শিখেন। কীভাবে এআই দিয়ে যেকোনো কাজকে সিম্পলিফাই করা যায়, কীভাবে ত্রিশ দিনের কাজকে তিন মিনিটে করে ফেলা যায়—এই সমস্ত টেকনিক রপ্ত করুন। ‘What is the longest Bridge of the world’ লিখে সার্চ করার জন্য চ্যাটজিপিটি জাতীয় এআইগুলো বানানো হয়নি। প্রত্যেকটা সেক্টরের কাজকে অভিনব উপায়ে সিম্পলিফাই করার জন্যই এসব তৈরি। আপনার আগ্রহের বিষয়ে কীভাবে এআইকে আপনার সহচর বানাবেন, সেইসব স্কিল রপ্ত করতে পারলেই এই সময়ে টিকে থাকা সহজ হবে।

চার.

যারা আইটিতে ক্যারিয়ার করতে চান, তাদের জন্য বেস্ট একটা সেক্টর হতে পারে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখা। কারণ, AI, SaaS, EdTech, FinTech ইত্যাদি সবকিছুর ভবিষ্যৎ কেন্দ্র হবে ওয়েবপ্লাটফর্ম। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখার সুবিধে হলো—সারা দুনিয়াজুড়ে এটার ব্যাপক চাহিদা আছে। ২০২৪ সালেই গ্লোবাল ওয়েব ডেভেলপমেন্ট মার্কেট ছিল প্রায় ৭৬.৫+ বিলিয়ন ডলারের।


আগেকার সময়ে, ট্রেনিং সেন্টার বা লার্নিং সেন্টারে গিয়ে কোনোকিছু শেখা লাগত৷ কিন্তু এখন, একটা ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট লাইন থাকলে ঘরে বসেই দুনিয়ার যাবতীয় স্কিল শেখা যায়।

বাংলাদেশে প্রচুর ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান আছে যারা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে Programming Hero সম্পর্কে জানি, কারণ আমার খুব কাছের একজন ছোট ভাই প্রোগ্রামিং হিরোতে মেন্টরশিপের কাজে আছে। একজন লার্নারের পেছনে কী পরিমাণ সময় তারা দেয়, কীভাবে জোঁকের মতো লেগে থাকে, সেসব গল্প মাঝে মাঝেই শুনি তার কাছে। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখিয়ে একেবারে জবের ইন্টারভিউ টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার আগ মুহূর্ত অবধি তারা সাপোর্ট দেয়। তবে, যদি লার্নার ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে পারেন, তবেই।

যেহেতু স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যাপার নিয়ে আলাপ, অনেকে ভালো প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চাইবেন। আমি ব্যক্তিগত জানাশোনার জায়গা থেকে, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখার জন্য ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম হিশেবে প্রোগ্রামিং হিরোকে রেফার করব।

৫.

সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটানো এইসব ঘুমহীন রাত আর কাজ-হীন দিনগুলোর কথা স্মরণ করে একদিন না একদিন আপনি প্রচণ্ডভাবে হতাশ হবেন। সেই হতাশা থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারে দুটো জিনিস—
১. গোছালো রুটিন জীবন।
২. একটা সম্ভাবনায় ক্যারিয়ার।
Think again, where you are spending most of your time.

লেখক: বিশিষ্ট লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট

এমএইচ/