ট্রেনে ঝুলানো সেই মতিউরের পরিবার দিলেন ভয়ঙ্কয় বর্ণনা
প্রকাশ: ২০ মে, ২০২৫, ০৮:০০ সকাল
নিউজ ডেস্ক

বাড়ির গেটে বাবার ছেঁড়া ও রক্তমাখা প্যান্ট হাতে নিয়ে কাঁদছে মেয়ে মুনিকা খাতুন। বাবা বেঁচে থাকায় বারবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন তিনি। এ সময় গণমাধ্যমের কাছে বাবার রক্তমাখা প্যান্টটি দেখিয়ে ভয়ংকর সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মেয়ে মুনিকা খাতুন।

বলছিলাম নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় পারইল ইউনিয়নের পারইল গ্রামের মৃত হবিবর রহমানের ছেলে মতিউরের কথা। দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করা ট্রেনের দরজায় ঝুলে থাকার পর এক পর্যায়ে ট্রেনের নিচে পড়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে আছেন তিনি।

বগুড়ার আদমদীঘিতে চলন্ত ট্রেনের দরজার বাহির থেকে ঝুলিয়ে ফেলে দেওয়া হয় মতিউরকে। তিনি ট্রেনের নিচে পড়লেও প্রাণে বেঁচে যান। এরপর মুহূর্তেই ৩৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান একজন আদম ব্যবসায়ী। তার মাধ্যমে দুই বছর আগে সজীব নামের এক যুবক সৌদি আরবে যান। কিন্তু সৌদি আরবে যাওয়ার পর কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় ইকামা (কাজের সুপারিশ সনদ) না পাওয়ায় সজীবের পরিবারের সঙ্গে মতিউর রহমানের বিরোধ চলছিল। ওই বিরোধের জেরে সজীবের নির্দেশে কয়েকজন যুবক মতিউর রহমানকে চোরের অপবাদ দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় সজীবের শ্যালক সুমনের নাম উল্লেখ করে সান্তাহার রেলওয়ে থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন।

 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার এক এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কাজ করছেন। গত ৪০ দিন আগে বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার তালশন গ্রামের হেলাল প্রামাণিকের ছেলে সজীব প্রামাণিককে একটা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। 

সৌদি আরবে গিয়ে সজীবের বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় তার পরিবারের সদস্যরা ৭-৮ দিন আগে মতিউরের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চায়।

এ নিয়ে সেখানে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে বগুড়া থেকে ট্রেনে মতিউরকে একা পেয়ে সজীবের ছোট ভাই রাকিব এবং সজীবের শ্যালকরা মিলে মোবাইল চোর এবং ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তার কাছে থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন বলে অভিযোগ মতিউরের পরিবারের।

ভুক্তভোগী মতিউর রহমান বলেন, সৌদি আরবে ভালোভাবেই সজীবকে পাঠিয়েছি। কিন্তু সেখানে চাকরি না পাওয়ার কারণে তাদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে বগুড়া থেকে ট্রেনে বাড়িতে ফেরার পথে সজীবের শ্যালক সুমনসহ ৭/৮ জন চোরের অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। মোবাইল চোর বলে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় খুব কষ্ট করে প্রায় ৪-৫ মিনিট ট্রেনের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম।

 
তিনি আরও বলেন, এক পর্যায়ে ট্রেনটি আদমদিঘী উপজেলার নশরতপুর স্টেশনে এলে সেখানকার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে যাই। এরপর কি হয়েছিল আর বলতে পারব না। আমার কাছে ব্যবসায়িক কাজের ৫০ হাজার টাকা ছিল- সেটিও তারা কেড়ে নেয়। আমি তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।

প্রতিবেশী নাজমা খাতুন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, মতিউরের বাবা ছিল একজন স্বনামধন্য চেয়ারম্যান। মতিউর দাদন ব্যবসায়ী এটা ঠিক আছে। কিন্তু সে চোর বা ছিনতাইকারী ছিল এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।

মতিউরের বাবা হাবিবর এক সময় সুনামের সঙ্গে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন জানিয়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, মতিউর আদম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সে চোর বা ছিনতাইকারী না। আর সে যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে আইনের মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত। তাই এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের বিচার হওয়া উচিত।

মতিউরের মেয়ে মুনিকা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবার সঙ্গে যারা এ রকম করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।

ভুক্তভোগী মতিউর রহমানের ছেলে আহসান হাবিব বলেন, আমার বাবার মুঠোফোন থেকে ফোন আসে। এরপর জানানো হয় আমার বাবার অবস্থা খুব খারাপ। 

সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনে গেলে একজন জানান, আমার বাবা চোর। চুরি করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে এ রকম অবস্থা হয়েছে। আমার বাবার সঙ্গে যারা এ রকম করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই। তবে আমার বাবা সত্য পথে থাকার জন্য আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

 
ছেলে আহসান হাবিব বলেন, আমার বাবা বেঁচে ছিল এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না। কারণ এই অবস্থা থেকে বেঁচে ফেরার কথা না। বাবার নসিবে ছিল তাই এখনো বেঁচে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য স্থানীয় একজন টাকা দিয়েছিলেন মতিউরকে। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় টাকা ফেরত চায় সেই যুবক। ৪০ হাজার টাকা দিতে টালবাহানা করলে স্থানীয় ইউনিয়ন জামায়াতের অফিসে বিচার দেওয়ার পর ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় জামায়াতের নেতারা। আর এ দায়িত্ব পালন করেছেন পারইল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক আমির মো. সিরাজুল ইসলাম।

পারইল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক আমির মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মতিউর চোর বা ছিনতাইকারী না। আর তার এ বেঁচে ফেরা অলৌকিক।

পারাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান মতিউরের আদম ব্যবসার কথা স্বীকার করে বলেন, হয়তো সে দু-একজনকে বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হতে পারে। তবে সে চোর বা ছিনতাইকারী না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদেশে অবস্থানরত সজীবের বাবা হেলাল প্রামাণিক মুঠোফোনে  বলেন, আমার ছেলে প্রায় এক মাস ১০ দিন আগে কোম্পানির ভিসায় বিদেশ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে জানা যাচ্ছে সাপ্লাই ভিসায়। এখনো কোনো কাজ দেয়নি আমার ছেলেকে। তাই মতিউরকে একদিন বাড়িতে ডেকে এনে প্রমাণ হিসেবে স্ট্যাম্প করে নেওয়া হয়েছে। আর ট্রেনের ঘটনা কি সেটা আমার জানা নেই। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

সান্তাহার রেলওয়ে থানার ওসি হাবিবুর রহমান অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে তাকে ধরার জন্য অভিযান শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া মূল ঘটনা উদঘাটনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।