
|
রহস্যময় তালেবান নেতা মোল্লা ওমর, যাকে যুক্তরাষ্ট্র খুঁজে পায়নি
প্রকাশ:
০৮ মে, ২০২৫, ০৮:৩০ সকাল
নিউজ ডেস্ক |
ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়েছিলেন তালেবান প্রধান মোল্লা ওমর। তাও এমন একটা সময়ে যখন পুরো বিশ্বে তার লুকানোর মতো কোনও জায়গা ছিল না। বইয়ে তিনি এ উল্লেখ করেছেন, "সর্বত্র মোল্লা ওমরের একটা মাত্র ছবিই দেখা যায়। সেটাই যে সঠিক সে বিষয়েও ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যায় না। কেউই নিশ্চিত করতে পারেন না যে ছবিটা সত্যিই মোল্লা ওমরের কী না।"
• চুল- কালো সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ডাচ লেখক বেটি ডাম লিখেছেন, "যুদ্ধের সময় তাকে 'রকেটি' বলে ডাকা হতো, কারণ রকেটের বিষয়ে তার নিশানা ছিল অব্যর্থ।" "শুরুর দিকে কিন্তু আফগান যোদ্ধাদের লক্ষ্য এতটা ভালো ছিল না, যে কারণে বহু নিরীহ বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।" মিজ ডামকে তালেবানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ মুতাওয়াক্কিল বলেছিলেন, "সোভিয়েত সৈন্যদের নজর কেড়েছিল ওমর। এমনকি একবার তারা (সোভিয়েতের পক্ষ থেকে) রেডিওতে ঘোষণা করেছিলেন যে লম্বা লোকটাকে (মোল্লা ওমর) হত্যা করা হয়েছে। তবে, এটা মনগড়া কথা ছিল। "কারণ ওই লম্বা লোকটা (মোল্লা ওমর) ততক্ষণে তাদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছে।" যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় নাম থাকা মোল্লা ওমরের ব্যক্তিত্বের বিষয়ে লিখেছেন মিজ ডাম। চোখে গুরুতর আঘাত বেটি ডাম তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "সোভিয়েত সৈন্যরা তাদের ওপর হামলা করবে এই আশঙ্কায় মোল্লা ওমর ও তার সঙ্গীরা লুকিয়ে ছিলেন। তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়।" "তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এমন সময় সোভিয়েত বিমান বাহিনী একটা বোমা ফেলে। সেই বিস্ফোরণে নিকটবর্তী মসজিদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই জায়গায় চিকিৎসকের এসে পৌঁছাতে পুরো একটা দিন সময় লেগেছিল। ধর্ষক কমান্ডারকে ফাঁসি দিয়েছিলেন "তারা শুধু দু'জন মেয়েকে উদ্ধারই করেননি, ওই কমান্ডারকে ট্যাংকের ব্যারেলে ফাঁসিতে ঝোলায়। পরে তিনি (মোল্লা ওমর) বলেন, আমরা সেই মুসলমানদের বিরুদ্ধেও লড়াই করছি যারা পথ হারিয়ে ফেলেছে।" প্রসঙ্গত, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে আনুমানিক ৭৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার আফগানের মৃত্যু হয়েছে। এই যুদ্ধে ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্যেরও মৃত্যু হয়েছে। বিবিসির সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ "কেউ কেউ এমনও জানিয়েছেন যে মোল্লা ওমর খুব কমই তার পোশাক পরিবর্তন করতেন কারণ তাকে সবসময় একই পোশাকে দেখা যেত। তার খাদ্যাভ্যাসও ছিল একেবারে সাধারণ। স্যুপ ও সেদ্ধ আলু খেতেন তিনি। এই খাবার এত দ্রুত খেতেন যে দেখে মনে হতো তিনি খুবই ক্ষুধার্ত।" সাক্ষাৎকার দিতেন না ১৯৯৫ সালে বিবিসির সিনিয়র সাংবাদিক রহিমুল্লাহ ইউসুফজাই মোল্লা ওমরের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে একজন যিনি এই শীর্ষ তালেবান নেতাকে কাছ থেকে দেখেছেন। বেশ কয়েকবার বোঝানোর পর মোল্লা ওমর ইউসুফজাইকে বলেন, তিনি (রহিমুল্লাহ ইউসুফজাই) যেন নিজের প্রশ্নাবলী এবং টেপ রেকর্ডার তার (মোল্লা ওমরের) প্রেস উপদেষ্টা আবদুল রহমান হোতাকির কাছে রেখে যান। পরদিন মোল্লা ওমর সমস্ত প্রশ্নের জবাব রেকর্ড করান। তার উত্তর শুনে মনে হচ্ছিল, যেন জবাব দিতে তার বেশ সমস্যা হয়েছে। আবদুল রহমান হোতাকি জানিয়েছিলেন যে, কিছু প্রশ্নের উত্তর তাকে একাধিকবার রেকর্ড করতে হয়েছে। আসলে বিষয়টা হলো মি. হোতাকি এক টুকরো কাগজে ওই প্রশ্নগুলো লিখে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা পড়তে বেগ পেতে হচ্ছিল মোল্লা ওমরকে। মিজ ডাম জানিয়েছেন, ওই টেপ রেকর্ডারটা পরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কোনও সংরক্ষণাগারেই সেটা আর পাওয়া যায়নি। গাড়ি চালানোর শখ "অনেক সময় দুর্ঘটনার পর অপেক্ষা করতেন কখন গাড়িটা গ্যারাজ থেকে মেরামত হয়ে ফিরবে, যাতে তিনি আবার সেটি চালাতে পারেন।" যুদ্ধ গতি হারালে অন্যান্য তালেবান যোদ্ধাদের মতো তিনি নিজেও লড়াইয়ে যোগ দিতেন। লেখক আহমেদ রশিদ তার বই 'দ্য স্টোরি অফ আফগান ওয়ারলর্ডস'-এ লিখেছেন, "মোল্লাহ ওমর পারলে সবসময় বাংকারে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই করতেন, কিন্তু তার কমান্ডাররা সেটা চাননি।" আধুনিক জীবন থেকে বহু দূরে তালেবানদের প্রশাসনিক বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না এবং তাদের মধ্যে অনেকেই খুব অল্প বয়সী ছিলেন। মোল্লা জাইফ তার বই 'মাই লাইফ উইথ দ্য তালেবান'-এ লিখেছেন, "এদের অনেকেই শুধুমাত্র কুরআন পড়তে এবং যুদ্ধ করতে জানতেন। খুব কষ্ট করে কোনোমতে মতে সই করতে পারতেন।" "তারা কক্ষের চেয়ারগুলো সরিয়ে রেখে মেঝেতে তোশক পেতে মন্ত্রীদের বৈঠকের আয়োজন করতেন যা দেখে অন্যান্য কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান।" তালেবানের শীর্ষ নেতারা গাড়ির বদলে পায়ে হেঁটে কাবুল শহরে যেতেন। পাসপোর্টের ছবি ছাড়া সারা দেশে ছবি তোলা নিষিদ্ধ ছিল। জাতীয় খেলা 'বুজকুশি'ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মোল্লা ওমর এবং ওসামা বিন লাদেনের বন্ধুত্ব ওসামা বিন লাদেনের ছেলে ওমর বিন লাদেন তার বই 'গ্রোয়িং আপ বিন লাদেন' - এ লিখেছেন, "আফগানিস্তান যাওয়ার পথে আমাদের বিমান যখন সৌদি আরবের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, তখন বাবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। ভয় ছিল যে আমাদের বিমানকে রকেট দিয়ে আঘাত করে ধ্বংস না করে দেওয়া হয়।" তিনি জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেনের বিমান যখন জালালাবাদে অবতরণ করে, তখন তাকে স্বাগত জানানোর জন্য মোল্লা ওমর উপস্থিত ছিলেন না। প্রাথমিকভাবে আফগান সম্রাট জাহির শাহের এক প্রাসাদে তাকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর ওসামা তোরা-বোরা পাহাড়ের একটা গুহায় বাস করতে যান। এই 'কথিত' বন্ধুত্বের (মোল্লা ওমর এবং ওসামা বিন লাদেনের) কোনো স্মৃতি আমার নেই।" ৯/১১ হামলার পর "কিন্তু তিনি ওসামা থেকে কিছুটা দূরে বসেন। নিজের জন্য একটা চেয়ার চেয়েছিলেন, যা কিছুটা অদ্ভুত ছিল, কারণ অন্য সবাই মেঝেতে বসেছিল। তিনি আমার বাবাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন - কাজ হচ্ছে না। আপনাকে এখান থেকে বের হতে হবে।" ওমর বিন লাদেন লেখক বেটি ডামকে বলেছিলেন, "মোল্লা ওমর বলেন ইসলামি আইন অনুযায়ী আমি আপনাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারব না। তবে আমি আশা করব আপনি নিজেই চলে যাবেন।" "এর উত্তরে আমার বাবা যখন ওমরকে বলেন যে সুদান তাকে পাঁচ বছর থাকার অনুমতি দিয়েছিল, আর আফগানিস্তানে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর বাস করেছেন, তখন তিনি (মোল্লা ওমর) উঠে দাঁড়ান এবং চলে যান। এমনকি তিনি ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে করমর্দনও করেনি।" ৯/১১ হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে বলেছিল ওসামা বিন লাদেনকে যেন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু মোল্লা ওমরের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া পায়নি তারা। এরপর যুক্তরাষ্ট্র তোরা-বোরাতে বোমা হামলা শুরু করে দেয়। বামিয়ানে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস ২০০১ সালের দোসরা মার্চ বিস্ফোরক দিয়ে ওই ঐতিহ্যবাহী মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন তিনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। মোল্লা ওমরকে হত্যার চেষ্টা 'দ্য আটলান্টিক' ম্যাগাজিনের ২০১৫ সালের ৩০শে মে-র সংখ্যায় 'দ্য স্টোরি অফ আমেরিকাস ফার্স্ট ড্রোন স্ট্রাইক' শিরোনামের এক প্রবন্ধে ক্রিস উড লিখেছেন, "হাজার হাজার মাইল দূরে ল্যাংলিতে সিআইএ-র সদর দফতরে সিআইএর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ড্রোনের ছবি দেখছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল যে দফতরে ওই বোমাটা ফেলা হলে অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যু হবে। তাই তারা মোল্লা ওমরের বাইরে বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করছিলেন।" ক্রিস উড লিখেছেন, "যখন সশস্ত্র ব্যক্তি বোঝাই তিনটে ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি ওই ভবন থেকে বেরিয়ে আসে, তখন সিআইএ কর্মকর্তারা নিশ্চিত ছিলেন যে ওই গাড়ির মধ্যে একটাতে মোল্লা ওমর রয়েছেন।" "কিন্তু তাদের হামলার টাইমিং নিয়ে দু'জন জেনারেলের মধ্যে মতপার্থক্যের ফলে হেলফায়ার রকেট নিক্ষেপ করা হয়নি। ভিড়ে ঠাঁসা রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় ওই তিনটে ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি।" দীর্ঘ রোগভোগের পর মৃত্যু ২০১৫ সালের জুলাই মাসে আফগান সরকার ঘোষণা করে যে তার মৃত্যু হয়েছে। যদিও অনেকে বলেন, এর দুই বছর আগে ২০১৩ সালের ২৩শে এপ্রিল তার মৃত্যু হয়। লেখক বেটি ডাম লিখেছেন, "মোল্লা ওমরের সহযোগী আবদুল জব্বার ওমারি আমাকে বলেছিলেন যে, সেদিন কান্দাহারে প্রচুর শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। মোল্লা ওমরের তিন মাস ধরে কাশি হচ্ছিল। তিনি বমিও করছিলেন। ওমারি তাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু মোল্লা ওমর তার কথা শোনেননি।" মি. ওমারি তাকে বলেছেন, "অনেক কষ্টে তিনি স্থানীয় একটা দোকান থেকে কেনা ইনজেকশন নিতে রাজি হন। তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।" এনএইচ/ |