কোন দিকে ঝুঁকছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো?
প্রকাশ: ০১ মে, ২০২৫, ০৫:০৯ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশে ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে মতের ভিন্নতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও এখন নির্বাচন লক্ষ্য করে ‘এক বাক্সে ভোট আনার’ স্লোগান তোলা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক পাঁচটি দল নির্বাচনি জোট করার তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অন্য দলগুলোর মধ্যে। অন্যতম প্রধান দল বিএনপিও ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টায় রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থিদের রাজনীতির মেরুকরণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এই প্রশ্নে এসব দলের মধ্যেই চলছে নানা আলোচনা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে; অনেক ক্ষেত্রেই তা চোখে পড়ার মতো।

এমনকি বিভিন্ন সময় এসব দল ও সংগঠনের শক্তি দেখানোর চেষ্টা ছিল। নির্বাচনের সময় ও সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির বিপরীতে জামায়াতসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েও আলোচনা রয়েছে।

ইসলামী দলগুলোর নেতারা বলছেন, দেশে পট পরিবর্তনের পর রাজনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটা অবস্থান তৈরির সুযোগ এসেছে বলে তারা মনে করছেন। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চান তারা। সেজন্য তারা ইসলামপন্থিদের ঐক্য বা একটি জোট গঠনের তাগিদ অনুভব করছেন।

নির্বাচনি জোট করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটি আসনে তাদের একক প্রার্থী দেওয়ার কথা বলছে ইসলামপন্থি দলগুলো। তা কতটা সম্ভব হবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

যদিও নেতারা বলছেন, তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচন এগিয়ে এলে নানা মেরুকরণ হবে এবং অনিশ্চয়তাও আছে।

বিএনপি ও জামায়াতের কাছে টানার চেষ্টায় অনেক ইসলামি দল দুই বলয়ে ভিড়তে পারে, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করতে পারছেন না ঐক্যের চেষ্টায় থাকা নেতারা। 

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনের শেষদিকে কোণঠাসা জামায়াত অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তাদের সেই চেষ্টা প্রকাশ্যে এসেছে। 

কারণ অন্য দল, বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক ও ধর্মীয় নেতা বা পীরদের নেতৃত্বাধীন দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে জামায়াতের সম্পর্কের দূরত্ব ছিল।

জামায়াতের এই দূরত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দলটির আমির শফিকুর রহমান গত ২১শে জানুয়ারি বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমােনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে দেখা করেন। সেদিন ইসলামি আন্দোলনের নেতার মধ্যাহ্ণভোজেও অংশ নেন জামায়াতের আমির।

দল দুটির শীর্ষ দুই নেতা বরিশালে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। সেদিনই তারা সাংবাদিকদকদের বলেছিলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামি দলগুলো 'একবাক্সে ভোট আনার' চেষ্টা চালাচ্ছে।

এরপর জামায়াত নেতারা ঐক্যের ব্যাপারে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।

তবে ঐক্যের ব্যাপারে দলটির অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে বলে অন্য ইসলামি দলগুলোর নেতারা মনে করছেন। কারণ এখন ঐক্য তৈরি প্রক্রিয়ায় জামায়াত অংশ নিচ্ছে না।

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য দলগুলোর ঐক্য বা জোট করার চেষ্টাকে আমরা সম্মান করি। 

কিন্তু ওই জোট থাকা না থাকার প্রশ্নে স্পষ্ট কোনো জবাব দেননি তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনীতিতেই নানা মেরুকরণ হচ্ছে। নির্বাচন এগিয়ে এলে আরও মেরুকরণ হবে। ফলে আরও পরে দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হবে।

ইসলামপন্থি দলগুলোর রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা জামায়াতের অবস্থানকে দেখছেন ভিন্নভাবে।

তারা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতির মাঠে নেই। এই দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেলে বা ভোটে অংশ না নিলে বিএনপি ও জামায়াতের জোট করার প্রয়োজন হবে না। কারণ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা থেকেই তারা অতীতে নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়েছে।

জোট গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি দল এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সর্বশেষ গত ২৩শে এপ্রিল তারা বৈঠক করেছে। তারা একটি লিঁয়াজো কমিটিও গঠন করেছে। দুই-একদিনের মধ্যে সেই লিঁয়াজো কমিটির বেঠক হতে পারে।

ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে এই ঐক্যের প্রক্রিয়ায় রয়েছে মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম। এই পাঁচটি দলেরই নিবন্ধন আছে।

ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবার নির্বাচনে একটা অবস্থান তৈরির চিন্তা থেকে তারা এই ঐক্যের চেষ্টা করছেন। তবে তিনি উল্লেখ করেন, কোনো স্থায়ী জোট নয়, এটি হবে নির্বাচনি জোট।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহ সভাপতি আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, তারা নির্বাচনি জােট গঠন করলে অন্যান্য দলের জন্যও তাদের জোট উন্মুক্ত থাকবে।

কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ৩ মে ঢাকায় সমাবেশ করছে। সংগঠনটি তেরো দফা দাবি তুলে ২০১৩ সালের পাঁচই মে ঢাকায় শাপলা চত্বরে সমাবেশের মাধ্যমে আলোচনায় আসে।

তাদের সেই সমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রাণহানির ঘটনার ব্যাপারে এবং দমননীতি চালানোর অভিযোগ রয়েছে সে সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে।

এবার সেই ঘটনার স্মরণে এবং সংগঠনটির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সে সময় দায়ের করা পুলিশের সব মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ৩ মে মহাসমাবেশ করার কথা বলছে হেফাজত।

সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব জালালউদ্দীন আহমদ বলেন, তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২৭০টি মামলা রয়েছে। সেগুলোর প্রত্যাহার চান তারা।

এখন সক্রিয় থাকা প্রায় সব দলই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থানে রয়েছে।

নির্বাচন হলে এই দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এই ধারণা তৈরি হয়েছে রাজনীতিতে।

বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এই নির্বাচনে তাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী যেহেতু নেই, সে কারণে তারা এখন কোনো জোট করতে চান না।

দলটি এবার স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে দলগতভাবে নির্বাচন করতে চাইছে। তবে আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করেছে বাম, ডান ও ইসলামপন্থি বিভিন্ন দল। বিএনপির কাছে ওই দলগুলোর একটা চাওয়া রয়েছে।

ফলে এই দলগুলোর জন্য বিএনপি কিছু আসন ছেড়ে দেবে এবং সে ক্ষেত্রে এক ধরনের সমঝোতা হবে।

দলটির নেতারা বলছেন, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর বাইরেও ইসলামপন্থি বিভিন্ন দলকে কাছে রাখতে চাইছে বিএনপি। সেজন্য তারা আলোচনাও চালাচ্ছে।

আর এসব দলকে কাছে রেখে জোটবদ্ধ না হয়ে একটা বলয় তৈরির ক্ষেত্রেও আসন দিতে হবে বিএনপিকে। দলটি সে ধরনের সমঝোতায়ও যেতে পারে বলে মনে হয়েছে।

নির্বাচনে জামায়াত ছাড়া ইসলামপন্থি অন্য দলগুলোর নেতাদের এককভাবে জয়ী হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ফলে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা হলে তাদের জেতার সম্ভবনা থাকে।

এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে দলগুলোর বেশিরভাগই বিএনপির দিকে ঝুঁকবে এবং তাতে ইসলামপন্থিদের ঐক্যের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভোট না থাকলেও ইসলামপন্থি দলগুলো সঙ্গে থাকলে এরও একটা রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। এসব বিবেচনায় এবার বিএনপি ও জামায়াত তাদের পৃথকভাবে কাছে টানার চেষ্টায় রয়েছে।

অতীতেও সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যে সব নির্বাচন হয়েছে, সে সব নির্বাচনে বড় দলগুলোর ইসলামি দলগুলোকে কাছে রাখার চেষ্টা আরও বেশি ছিল।

বিশ্লেষক শরীফ মুহাম্মদ মনে করেন, ইসলামি দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারা কোনো জোট করলে সেই জোটও বড় কোনো দল বা জোটের দিকে ঝুঁকবে না, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। ঐক্য চেষ্টা ও দলগুলোর অবস্থান স্থির হতে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা 

এমএইচ/