কওমি মাদরাসার ছাত্রদের প্রতি তিনটি নিবেদন
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ০৮:৪৫ রাত
নিউজ ডেস্ক

|| মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ||

মাদরাসার ছাত্রদের জন্য তিনটি নিবেদন পেশ করছি এবং আশা করছি, এগুলোকেও মনোযোগ সহকারে পড়া হবে। এবং শিক্ষা জীবনের অংশ হিসাবে গ্রহণ করা হবে।

প্রথম নিবেদন: তালিবুল ইলমের জন্য উদাসীনতার যিন্দেগি খুবই ক্ষতিকর। তাই, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে আত্মসচেতন বানানোর প্রতি মনোযোগী হোন। শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক শ্রেণীগুলোই যোগ্যতা তৈরীর মূল সময়।

এসো আরবী শিখি থেকে হেদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত যে জামাতগুলো আছে, ইসতিদাদ (যোগ্যতা) তৈরীর প্রধান ভিত্তি তো এগুলোই। অথচ ব্যাপকভাবে এই জামাতগুলোকেই ছাত্রভাইরা অসচেতনতার ভিতর দিয়ে পার করেন। এসময় না মজবুত কোনো নিয়ত থাকে, আর না কোনো দৃঢ় সংকল্প। ইলমের প্রতি মহববতও গড়ে উঠে না। উদ্যম একাগ্রতা সেগুলোও পর্যন্ত থাকে না। পরিণামে যা হয় তা খুবই দুঃখজনক।

সে জন্য আমি আমার ওইসকল ভাইদের উদ্দেশ্যে বলি, যে যতো দ্রুত নিজের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করতে পারবেন সে ততো বেশি নিজের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। এবং ততো বেশি তারাক্কী ও উন্নতি লাভ করবেন।

এখানে একটি কথা উল্লেখ করে দেওয়া ভালো যে, মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছে যেসকল তালিবুল ইলম ভাইয়েরা কিছুটা হুঁশ ফিরে পান, তারা বুঝে বুঝে পড়া এবং বুঝে বুঝে মুতালাআ করায় অভ্যস্ত হন না। আর অসম্পূর্ণ বুঝ বা ভুল বুঝের উপর ক্ষান্ত থাকেন।

না বুঝে এবং চিন্তা ফিকির না করে কেবল ছরছরী বা কোনো রকম পড়ে যাওয়াটা এখনকার অধিকাংশ জায়্যিদ জিদ্দান, এমনকি মুমতায শ্রেণীর তালিবুল ইলমদেরও অভ্যাস কিংবা বলা যায় প্রতীক। আমার বুঝে আসে না এই দূরাবস্থা থেকে উত্তরণের ব্যপারে আমরা এখনো কেন গুরুত্ব দিচ্ছি না।

দ্বিতীয় নিবেদন: তালিবুল ইলম ভাইয়েরা যেন নিজেদের চিন্তা-মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত না করেন। শিক্ষাজীবনের যে দুয়েকটি মৌলিক উদ্দেশ্য থাকে নিজের পূর্ণ মনোযোগকে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন। একথা ঠিক যে, একজন তালিবুল ইলমের নানামুখী যোগ্যতা দরকার। কর্মজীবনে প্রবেশের পরপরই বিভিন্ন রকম যোগ্যতা প্রয়োজন হবে। তাই বলে তো আর এটা সম্ভব নয় যে, সকল যোগ্যতা আপনি একসাথে অর্জন করে ফেলবেন বরং এক্ষেত্রে আপনাকে প্রাধান্য- রীতি অবলম্বন করতে হবে।

সে হিসেবে মাদরাসায় পড়াশোনাকালীন সময়ে সর্বপ্রথম কিতাবী ইসতিদাদ অর্জন করবেন। সাথে সাথে আল ফিকহুল আম লিদ্দ্বীন হাসিল করার চেষ্টা করবেন। এবং আসাতিযায়ে কেরামের চিন্তা চেতনা আচার আখলাক ও উত্তম আদর্শকে গ্রহণ করবেন। এগুলোর মধ্যেই আপনি আপনার পূর্ণ মনোযোগ সীমাবদ্ধ রাখবেন।

লেখক হওয়া, বক্তা হওয়া, সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা, দেশ বিদেশের খোঁজ খবর রাখা, সময় ও সময়ের চালচিত্র বুঝতে পারা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জন করা এবং বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হওয়া -এ জাতীয় আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলোর উপর সারা জীবন আপনি আপনার তালীমী মুরুববীর পরামর্শে মেহনত চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু কিতাবী ইসতিদাদ বা কিতাব বোঝার যোগ্যতা এমন জিনিস যা এখন অর্জন করতে না পারলে পরে আর কখনো অর্জন কর না সম্ভব নয়। আল্লাহ না করুন এমনটা হলে আপনার পড়াশোনার যিন্দেগী সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলে সাব্যস্ত হবে। এবং ভবিষ্যতের পুরা ইলমী ও আমলী যিন্দেগীতে আপনাকে তার খেসারত দিতে হবে। তখন ঠিকই আফসোস হবে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আর সম্ভব হবে না।

আমি আমার এই নিবেদন প্রথমে ওই সকল তালিবুল ইলম ভাইদের খেদমতে পেশ করছি যারা ‘ভালোছাত্র’ হিসেবে খ্যাত। আশা করছি তারা এই দরখাস্তের কদর করবেন।

তৃতীয় নিবেদন : তালিবুল ইলম ভাইদের জন্য একটা গুণ খুবই জরুরি। সেটা হলো, অন্যের ভালো কিছুতে প্রভাবিত হওয়া। আর মন্দ কিছুতে প্রভাবিত না হওয়া। অন্য কারো থেকে উত্তম স্বভাব ও ভালো অভ্যাস গ্রহণ করা। এবং মন্দ স্বভাব এবং মন্দ অভ্যাস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা।

এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা যদি কোনো উত্তম স্বভাব বা ভালো অভ্যাস দান করে থাকেন সেটা অন্যদের মাঝে বিস্তারের চেষ্টা করা। সাথে সাথে নিজের কোনো বদ অভ্যাস বা মন্দ স্বভাব যেন অন্য কারো মাঝে প্রভাব না ফেলে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

অনেক সময় দেখা যায়, নতুন অনেক তালিবুল ইলম ভাইয়েরা আসেন যাদের কারো মাঝে অনেক ভালো ভালো অভ্যাস থাকে। কিন্তু এখানের সাথী ভাইদেরকে সেই অভ্যাসে অভ্যস্ত না দেখে নিজেরাও সেইসব অভ্যাস ছেড়ে দেন।

যেমন কেউ সব সময় অযুর সাথে থাকার ব্যাপারে যত্নশীল বা কমপক্ষে অযু অবস্থায় রাতে ঘুমানোর ইহতিমাম (গুরুত্বারোপ) করতো। এরপর এখানে এসে কয়েকজনকে দেখলো যে তারা এ ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ জন্য ধীরে ধীরে তিনিও এ বিষয়ে যত্ন নেওয়া ছেড়ে দিলেন বা ইহতিমাম করলেন না। একজন আদর্শ তালিবুল ইলমের কাছ থেকে এমনটি কখনো কাম্য নয়। আদর্শ তালিবুল ইলম তো নিজের ভালো গুণটিকেও অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। হাদিস আছে-

অর্থ : ইসলামে (মুসলমানদের মাঝে) যে ব্যাক্তি কোনো ভালো কাজের সূচনা করবে, তার সওয়াব সে পাবে। সাথে সাথে তাদের সওয়াবও পাবে যারা এরপর সে অনুযায়ী আমল করবে। তবে সে ক্ষেত্রে আমলকারীর সওয়াব থেকে কিছুই কমানো হবে না। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ইসলামে (মুসলমানদের মাঝে) কোনো মন্দ কাজের সূচনা করবে তার পরিণামও সে পাবে। সাথে সাথে যারা এরপর সে অনুযায়ী আমল করবে তাদের পরিণামও। এখানে আমলকারীর পরিণামে মোটেও কম করা হবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০১৭

এটার অর্থ এই নয় যে, দুনিয়াতে সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি এই ভালো কাজটির সূচনা করবে, বরং যেকোনো পরিবেশে যেকোনো ব্যক্তি এই ভালো কাজটি চালু করবে তার জন্য ঐ সওয়াবের ওয়াদা। খেয়াল করলে দেখবেন যে, আজ যদিও মাত্র একজন আপনার কাছ থেকে একটা ভালো অভ্যাস গ্রহণ করলো। কিন্তু এরপর হয়তো তার কাছ থেকে আরো অনেকেই গ্রহণ করবে। এভাবে তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করবে পরবর্তীদের আরো অনেকে। আপনার সওয়াব এভাবে কেবল বাড়তেই থাকবে।

কেউ দেখা যায় আগে তাহাজ্জুদের ইহতিমাম করতো। অথবা ইশরাক বা চাশতের নামাযে অভ্যস্ত ছিলো। আওয়াবীনও পড়তো। এখন নতুন জায়গায় এসে ঐসব নফলের প্রতি যত্নশীল তালিবুল ইলমের সংখ্যা কম হওয়ায় সেও সেটা ছেড়ে দিল। এমনিভাবে কেউ কানুনের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলো অথবা পরিপাটি থাকার ব্যাপারে, নিজের সামানা আসবাব পত্র কিংবা আশপাশ ও পরিবেশ গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে যত্নশীল ছিলো।

কিন্তু এখানে এসে অন্য কারো দ্বারা বিপরীতমুখী প্রভাব গ্রহণ করলো। এবং তার নিজের ভালো গুণগুলো ছেড়ে দিল। এটা কোনো তালিবুল ইলমের তো নয়ই, সাধারণ মুমিনের শানও নয়। আপনি হয়তো জানেন না, অন্য কারো এমন কোনো ওযর থাকতে পারে যার কারণে সে আপনার ঐ ভালো গুণটির ব্যাপারে আপনার মতো যত্ন নিতে পারছে না। তাই বলে আপনি কীভাবে তার কারণে আপনার ভালো গুণকে ছেড়ে দিবেন।

যারা অন্যদের থেকে কেবল খারাপ প্রভাব গ্রহণ করে ভালো কিছু গ্রহণ করতে পারে না তাদের মূল সমস্যা হলো, ঈমানী তারাক্কীর ব্যাপারে উদাসীনতা। আর এই উদাসীনতা কোনোভাবেই মুমিনের শান হতে পারে না।

আর যদি সবাই কেবল পরিবেশের খারাপ প্রভাবটাই গ্রহণ করে তাহলে ভালো পরিবেশ তৈরী হবে কীভাবে? উল্টো বরং ভালো পরিবেশগুলো দিন দিন বিলুপ্ত হতে থাকবে আর সব জায়গায় খারাপ পরিবেশের সৃষ্টি হবে।

তালিবুল ইলম ভাইদের মাঝে অধিকাংশ সময় যে গুণগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-

. ইনতিযামী উসূল-কানুনের ইহতিরাম বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা।

২. মুতালাআয় ইনহিমাক।

৩. সময়ের যত্ন ও মূল্যায়ন।

মানে রাখুন, মুমিনের শান হলো ‘খাইর’ এর মাঝে ‘তাবাদুল’ করা। একে অপরের মাঝে কল্যাণ বিনিময় করা, ‘শার’ বা মন্দ বিনিময় নয়। আর এই কল্যাণ বিনিময়ের মাধ্যমেই সুন্দর থেকে সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে খাইর ও কল্যাণ বিনিময়ের তাওফীক দান করুন। ‘শার’ ও মন্দ থেকে হেফাজত করুন। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন।

লেখক: আমিনুত তালিমাত মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া।

(লেখাটি মাসিক আলকাউসার থেকে নেওয়া হয়েছে)

এনএ/