গাজা ইস্যুতে কোনো ঐকমত্য ছাড়াই শেষ হল কায়রো শান্তি সম্মেলন
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর, ২০২৩, ০২:৫৭ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টায় মিশরের কায়রোতে গতকাল (শনিবার) একদিনের শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে গাজায় ইসরায়েলের বোমা বর্ষণের তীব্র নিন্দা জানায় আরব বিশ্বের নেতারা।

তবে এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কোনো জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিল না। যোগ দেয়নি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের কোনো প্রতিনিধিও। তাই চলমান সহিংসতা বন্ধে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করাও সম্ভব হয়নি।

মূলত মিশরের আহ্বানে ও তত্ত্বাবধানে শান্তি সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়। সেক্ষেত্রে আয়োজক দেশটির ছিল, অংশগ্রহণকারী দেশগুলো চলমান যুদ্ধ বন্ধে সর্বাত্মকভাবে শান্তির আহ্বান জানাবে। একইসাপ্রত্যাশা থে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদার কয়েক দশকের যে দীর্ঘ সংগ্রাম; সেটি বাস্তবায়নে পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলোর সরকার-প্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু দেশগুলো সেখানে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে কোনো ধরণের যৌথ বিবৃতিতে সম্মত না হয়েই সম্মেলনটি শেষ করতে হয়।

দুই সপ্তাহ ধরে চলমান যুদ্ধে ইসরায়ালের বিমান হামলায় গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত গাজার প্রায় ৪,৩৮৫ জন মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ গাজাবাসী। একইসাথে ইসরায়েলের খাদ্য, পানি ও জ্বালানির নিষেধাজ্ঞায় উপত্যকাটিতে বসবাসকৃত প্রায় ২৩ লাখ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুঃখ, কষ্ট ও দুর্ভোগ। 

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আচমকা হামলা চালায়। এতে প্রায় ১৪০০ ইসরায়েলি নিহত হয়।

এমতাবস্থায় সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কূটনীতিকরা চলমান যুদ্ধ নিয়ে বড় ধরণের কোনো অগ্রগতির ব্যাপারে ততটা আশাবাদী ছিলেন না। আর অন্যদিকে হামাসকে নির্মূলে গাজায় স্থল অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে তেল আবিব। 

শান্তি সম্মেলনে আরব ও মুসলিম দেশগুলি অবিলম্বে গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশই বোমা হামলা বন্ধের কথা না বলে বরং বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মানবিক ত্রাণ প্রাপ্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছে।

জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহ ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের নীরব থাকায় কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন। একইসাথে চলমান সংঘাতে উভয় পক্ষকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।

আব্দুল্লাহ বলেন, "ফিলিস্তিনিদের জীবন হয়তো ইসরায়েলিদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ; বিশ্বের প্রতিক্রিয়া আরব বিশ্বের কাছে অনেকটা এমনই মনে হচ্ছে!" একইসাথে গাজায়, ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে চালানো সহিংসতায় তিনি ক্ষোভ ও শোক প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, "ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত বা বিতাড়িত করতে পারবে না।"

আর ফ্রান্সের পক্ষ থেকে গাজায় মানবিক করিডোরের আহ্বান জানানো হয়েছে। যার ফলে আকাঙ্খিত যুদ্ধবিরতি সম্ভবনা তৈরি হতে পারে বলে দেশটি আশা করছে।

যুক্তরাজ্য ও জার্মানি উভয়ই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। আর ইতালি মনে করে যে, চলমান পরিস্থিতিতে উত্তেজনা এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে চলমান সংঘাতে ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এই সম্মেলনে শুধু কায়রোতে থাকা নিজেদের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্সকে পাঠিয়েছে। তিনি সেখানে জনসম্মুখে কোনো বক্তৃতা প্রদান করেননি। 

আর ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল মনে করেন, এই সামিটের মূল লক্ষ্য ছিল 'একে অপরের কথা শোনা'। তিনি বলেন, "আমরা বুঝতে পারছি যে, মানবিক পরিস্থিতি রক্ষায়, আঞ্চলিক উত্তেজনা এড়াতে এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে একসাথে আরও কাজ করতে হবে।"

ইসরায়েলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে গত ৭ অক্টোবরের হামলাকেই মনে করা হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক হামলা। তাই ভবিষ্যতের বিপদ বিবেচনায় এবার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে চিরতরে ধ্বংস করতে চায় দেশটি। 

স্থল আক্রমণের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যদিও উপত্যকাটি মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর ইসরায়েলি বিমান হামলা গাজার দক্ষিণাঞ্চলেও আঘাত হেনেছে।

কায়রো সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চলমান সহিংসতাকে কীভাবে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হওয়া থেকে বন্ধ করা যায়। তবে কূটনীতিকরা এটাও জানতেন যে, নানা ফ্যাক্টরের কারণেই যুদ্ধবিরতির আহ্বানে একটি চুক্তি করা কঠিন হবে। কেননা সেখানে হামাসের আক্রমণের যথার্থতা কিংবা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের যুক্তি ইত্যাদি নানা বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।

এদিকে আরব দেশগুলো আশঙ্কা করছে যে, গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণের ফলে বাসিন্দারা স্থায়ীভাবে তাদের বাড়িঘর হারাতে পারে। এমনকি পূর্বের ন্যায় প্রতিবেশী দেশগুলিতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের সময়। 

অন্যদিকে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বৃহত্তর সিনাই মরুভূমিতে ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রদানের সম্ভবনা নাকচ করে দেন। একইসাথে চলমান সংকটের সমাধানে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান।

উত্তর-পূর্ব সিনাইয়ের গাজার সীমান্তের কাছে এমনিতেই মিশর জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা করে। কেননা দেশটি ২০১৩ সালের দিকে এই অঞ্চলে বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিল; যা এখন অনেকাংশে দমন করা হয়েছে।

অন্যদিকে জর্ডানে ইতিমধ্যেই অনেক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু এবং তাদের বংশধররা বসবাস করছে। দেশটির শঙ্কা এই যে, চলমান সহিংসতার ফলে পশ্চিম তীর থেকে আরও ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হতে পারে।

রাজা আব্দুল্লাহ বলেন, "জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি যুদ্ধাপরাধ এবং আমাদের সকলের জন্য একটি বিপদ সংকেত।"

সম্মেলন শুরুর কিছুক্ষণ আগে অবশ্য ত্রাণবাহী ২০ টি ট্রাক রাফাহ সীমান্ত খুলে গাজায় প্রবেশ করে। মিশর বেশ কয়েকদিন ধরেই ক্রসিংটির মাধ্যমে গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কেননা গাজার জন্য এটিই একমাত্র অ্যাক্সেস পয়েন্ট যা ইসরায়েল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।

তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এতটা মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে এই প্রাথমিক সহায়তা 'সমুদ্রের মধ্যে একটি বিন্দুর সমান'। আর ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক কিন্ডি ম্যাককেইন ২০ ট্রাক ত্রাণকে স্বাগত জানান তবে এতটুকু যথেষ্ট নয় বলে সতর্ক করেন তিনি। 

ম্যাককেইন বলেন, গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ। খাবার, পানি, বিদ্যুৎ কিচ্ছু নেই। যা পরবর্তীতে আরো বিপর্যয়ের, অনাহারের এবং আরো বহু রোগের কারণ হতে পারে। আমাদের আরো ট্রাক প্রয়োজন। নিরাপদ এবং টেকসই উপায়ে সঠিক সুবিধাভোগীদের জন্য সাহায্য পৌঁছানো নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এনএ/