দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আলেম ও জেনারেল শিক্ষিতদের মাঝে বিরোধ প্রসঙ্গ
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর, ২০২৩, ০৪:৩৭ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন || 

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد  :
মসজিদ মাদরাসা প্রভৃতি দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে উলামায়ে কেরামের সঙ্গে জেনারেল শিক্ষিত লোকজন থাকলে তাদের সঙ্গে অনেক ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মিল হয় না, বিরোধ দেখা দেয়। এই অমিল ও বিরোধের মূল কারণ প্রধানত চারটা। যথা: 

এক. জেনারেল শিক্ষিতগণ উলামায়ে কেরামের আত্মমর্যাদা ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মেজাযের সাথে পরিচিত না হওয়ার কারণে অনেক সময় তারা কোন সমস্যা নিরসনের জন্য যে পন্থায় অগ্রসর হতে চান উলামায়ে কেরাম তার সঙ্গে একমত হতে পারেন না। যেমন একটা উদাহরণ: কোন আলেমের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি দেখা দিলে বা কোন অপরাধ ধরা পড়লে জেনারেল শিক্ষিতরা দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠানের ন্যায় শোকজ করা, তদন্ত কমিটি গঠন করা, প্রকাশ্যে হেনস্থা করে তাকে বিদায় দেওয়া ইত্যাদি পন্থা অবলম্বন করতে চান, কিন্তু উলামায়ে কেরামের মেজাযের সাথে পরিচিত আলেমগণ বোঝেন এতে সংশ্লিষ্ট আলেম নির্দোষ হলে আত্মমর্যাদায় আঘাত অনুভব করবেন এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আন্তরিকতা হারাবেন। কারণ উলামায়ে কেরাম অত্যন্ত গায়রতমান্দ তথা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেজাযের হয়ে থাকেন। আর প্রকাশ্যে হেনস্থা করে কাউকে বিদায় দিলে দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার ব্যাপারও রয়েছে। এটা মসজিদ মাদরাসা প্রভৃতি দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মেজাযের সাথে যায় না। তাই আলেম পরিচালকগণ এরূপ ক্ষেত্রে প্রথমে সাধারণ মজলিসে সংশ্লিষ্ট আলেমের নাম উল্লেখ না করেই সংশ্লিষ্ট ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে সতর্ক করেন। তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংশোধন না হলে তাকে একাকী ডেকে সতর্ক করেন। তারপরও কাজ না হলে তাকে গোপনে অব্যাহতি প্রদান করেন। জেনারেল শিক্ষিতগণ উলামা ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মেজাযের সাথে সংগতিপূর্ণ এসব পদক্ষেপের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে না পারায় তারা মনে করেন হুজুররা হুজুরদের দোষ অপরাধ হালকা করে দেখে। এভাবে আলেম ও গর আলেম পরিচালকদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

দুই. সাধারণ মানুষ দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নিয়ম-নীতি ও মাসায়েল সম্বন্ধে অবগত থাকেন না। তারা তাদের মর্জি মোতাবেক এমনসব নীতিতে প্রতিষ্ঠান চালাতে চান যা দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নিয়ম-নীতি ও মাসায়েল সম্বন্ধে অবগত উলামায়ে কেরাম মেনে নিতে পারেন না। যেমন একটা উদাহরণ: স্টাফের বেতন-ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মাসআলা হল- স্টাফের প্রয়োজন পূর্ণ হয় এতটুকু বেতন-ভাতা অবশ্যই তাদেরকে দিতে হবে, নতুবা পরিচালকদের পাপ হবে, তারা দায়ী থাকবে। কিন্তু দেখা যায় জেনারেল শিক্ষিত পরিচালকদের অনেকেই এ মাসআলার তোয়াক্কা না করে সাধ্য থাকা সত্ত্বেও স্টাফের বেতন-ভাতায় অবিচার করেই যেতে থাকে। কোনোমতেই তারা স্টাফের ন্যায্য বেতন-ভাতা প্রদানে ব্রতী হয় না।

তিন. উলামায়ে কেরাম তাওয়াক্কুল ও আল্লাহর প্রতি আশা রাখার যে শক্তিশালী স্তরে উন্নীত থাকেন সাধারণ শিক্ষিত মানুষ প্রায়শই সে স্তরে উন্নীত থাকেন না। এর কারণেও আলেম ও গর আলেম পরিচালকদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।যেমন একটা উদাহরণ: উলামায়ে কেরাম একটা কাজের পরিকল্পনা করে প্রাথমিক পর্যায়ে যতটুকু সম্ভব ফান্ড সংগ্রহ করে বাকি ফান্ডের ব্যাপারে চেষ্টা-চরিত্র অব্যাহত রেখে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে কাজ শুরু করে দিতে চান, আর জেনারেল শিক্ষিতরা পুরো ফান্ড সংগ্রহের নিশ্চয়তা পাওয়ার আগে কাজ শুরু করতে সাহস করেন না।

চার. উলামায়ে কেরামের মধ্যে তাকওয়া ও লিল্লাহিয়াত প্রবল থাকার কারণে তারা যে ধারায় সবকিছু সম্পন্ন করতে চান সাধারণ মানুষ সেই পর্যায়ের তাকওয়া ও লিল্লাহিয়াত না থাকার কারণে সেই ধারায় এগোনোর তাগীদ অনুভব করতে সক্ষম হন না। যেমন একটা উদাহরণ: প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মাহফিল বা বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে প্রফেশনাল বক্তাদের আনার ব্যাপারে তাকওয়া ও লিল্লাহিয়াতের চেতনায় উজ্জীবিত আলেমগণ সম্মত হন না, কিন্তু সাধারণ মানুষ এটা বোঝে না। বরং তারা উল্টো বদগোমানী করে যে, হুজুররা নিজেদের নাম ছোট হয়ে যাওয়ার ভয় পায়, হিংসা করে ইত্যাদি।

অতএব দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কেবল সেসব সাধারণ মানুষকেই অন্তর্ভুক্ত করা চাই যারা উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মেজাযের সাথে পরিচিত এবং দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নিয়ম-নীতি ও মাসায়েল সম্বন্ধে অবগত কিংবা ন্যূনতম উলামায়ে কেরামের কথা মানতে প্রস্তুত। সেই সাথে সাথে তাওয়াক্কুল, তাকওয়া ও লিল্লাহিয়াতের উঁচু স্তরে উন্নীত। যারা এই পর্যায়ের নয়, তাদের মসজিদ মাদরাসা প্রভৃতি দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে না আসা উচিত। এরূপ কমিটিতে এসে দুনিয়াবী মর্যাদা অর্জনের চিন্তা মাথায় না এনে দ্বীনের ক্ষতি করে আযাব কামানো হয়ে যায় কি না সেটাই তাদের মাথায় রাখা চাই।

লেখক: মুহাদ্দিস ও গবেষক

টিএ/