শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সরকার কঠোর হলে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: সরকার যদি তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগকে কঠোর হাতে সামলাতে পারে তাহলে ক্যাম্পাসে নৈরাজ্যের তাণ্ডব বন্ধ করা সম্ভব। এটা সরকারের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এটি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আন্তরিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। ছাত্রলীগকে বেপরোয়া ছেড়ে দিলে তাদের অপকর্মের দায়ভার সরকার ও দল এড়াতে পারবে না। দেশের কমবেশি প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নির্যাতন, উন্নয়নকাজের দরপত্রে চাঁদাবাজি, সিটবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও নানা দুষ্কর্মের কারণে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় আছে। কিছ কিছু ঘটনার পরই সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হলেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ছাত্রলীগকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন ছাত্রলীগের হাতে। এটি রীতিমতো ভয়ঙ্কর উদ্বেগের বিষয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক স্বাধীনতা ও নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো বিশেষত প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু দিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হাতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভিন্নমতের ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্যাতনসংক্রান্ত অভিযোগগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের শুধু জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের প্রায় প্রধান গণমাধ্যমে ৩০টিরও বেশি চাঁদাবাজি, ছাত্রনির্যাতন, আবাসিক হলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরিসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে।

একাডেমিক স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে শারীরিক নির্যাতনের মতো বিভিন্ন দুর্বৃত্তপনার অভিযোগের ব্যাপারে দেশের ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সুষ্ঠু বিচারবিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কিছু অভিযোগ হলো-

১. মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে ‘হলে না জানিয়ে উঠার কারণে’ বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতন (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)।
২. চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চার ছাত্রকে ‘শিবির সন্দেহে’ সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ব্যাপক মারধর করে আইসিইউতে পাঠানো (১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)।
৩. বুয়েটের এক দম্পতির কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিনতাই (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)।
৪. ২৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে দুই ছাত্রকে রাতভর নির্যাতন (২৪ জানুয়ারি ২০২৩, আজকের পত্রিকা)।
৫. ১৯ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মাখদুম হলের ‘কৃষ্ণ রায়’ নামে এক আবাসিক ছাত্রকে বেদম পেটানো (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)।
৬. রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা সাধারণ এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)।
৭. জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাবির অমর একুশে হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ কর্মীর। ‘চাঁদা না দেয়ায়’ রাজধানীর বঙ্গবাজারের এক ব্যবসায়ীর দোকান ভেঙে দেয়া (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো)।
৮. ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলায় পরিষদের অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)।
৯. ২১ ফেব্রুয়ারি অশোভন আচরণের প্রতিবাদ করায় ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে স্টাম্প দিয়ে প্রহার, চুল ছিঁড়ে ফেলা ও বঁটি নিয়ে ধাওয়া করার অভিযোগ উঠেছে কলেজ ছাত্রলীগের এক সহসভাপতির বিরুদ্ধে (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো)।
১০. ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে সংগঠনের ৯ কর্মীর বিরুদ্ধে (দেশ রূপান্তর, ২৬ ফেব্রুয়ারি)।

এ ছাড়াও আরো ডজনের অধিক চাঁদাবাজি, হামলা, অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের অভিযোগ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা এসব ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত, শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ। এই শঙ্কা ক্রমেই বাড়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসম্ভব নির্লিপ্ততার অভিযোগও গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়। তাই তারা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নির্লিপ্ততা ভেঙে তদন্তসাপেক্ষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম, অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, অধ্যাপক মো: লুৎফর রহমান, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান; অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক, অধ্যাপক কামরুন্নেসা খন্দকার, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কান্ট্রি স্পেশালিস্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএ; সায়েন্টিফিক বাংলাদেশের এডিটর ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ, টেকসই উন্নয়ন-বিষয়ক লেখক প্রকৌশলী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব; সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবুল কালাম মানিক, লেখক ও গবেষক জিয়া হাসান, মো: সাইমুম রেজা তালুকদার, আইনজীবী ও সদস্য, বাংলাদেশ ইন্টারনেট ফ্রিডম ইনিশিয়াটিভ ওয়ার্কিং গ্রুপ; নাগরিক বিকাশ ও কল্যাণের (নাবিক) আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান; জলবায়ু গবেষক ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ; আইনজীবী অধিকার পরিষদের সমন্বয়ক ব্যারিস্টার মো: জীশান মহসীন, নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, সিভিল রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (সিআরআইবি) এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট আহসান হাবীব; পেশাজীবী অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নিজাম উদ্দীন, লেখক জাকারিয়া পলাশ, মানবাধিকারকর্মী ইজাজুল ইসলাম এবং লেখক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সোহেল রানা (বিভিনিউজ২৪ডটকম)।

সারা দেশে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের ‘নৈরাজ্য ও নিপীড়ন’-এর প্রতিবাদে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে জোহা চত্বরে অনশনে বসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান।

ছাত্রলীগ দেশের বৃহত্তম ছাত্রসংগঠন। জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৭৫ বছরে ভাষাসংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ সংগঠন। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে পারে এমন শক্তিশালী লোকবল তৈরি হয়েছে ছাত্রলীগের প্ল্যাটফর্ম থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক ধারাবাহিক নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠনের নৈতিক মানদণ্ড নেতিয়ে পড়ছে, মূল্যবোধের সজীবতা হারাতে বসেছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, আসনবাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নিয়োগবাণিজ্য, শৃঙ্খলাভঙ্গসহ নানা অপরাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৫ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০ জন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের টানা ১৪ বছরের শাসনের সময়ে ছাত্রলীগের একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড খবরের শিরোনাম হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংগঠনটি যেসব কারণে আলোচনায় এসেছে, এর মধ্যে রয়েছে ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি। এ ধরনের নানা অভিযোগের পরও আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন, ছাত্রলীগের নেতিবাচক কিছু ঘটনা বেশি প্রচার পাচ্ছে। তবে দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকেই সঙ্কটে ফেলছে। আওয়ামী লীগ থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের, নেতাকর্মীদের কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে- কোনো অভিযোগ উঠলে সাথে সাথে খোঁজ নিতে হবে এবং সত্যতা পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনোভাবেই অভিযুক্তের পক্ষে অবস্থান নেয়া যাবে না। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে হবে। ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘সংগঠনের নামে যে-ই অপরাধ করছে, আমরা কোনো ছাড় দিচ্ছি না। অপরাধীর পক্ষে কোনো রকম সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে না। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করছি। ভবিষ্যতেও এই নীতি অব্যাহত থাকবে (প্রথম আলো, ৩ মার্চ ২০২৩)।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রধান লক্ষ্য জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেদের পরিশীলিত এবং বিকশিত করা, সেখানে পড়ালেখার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, সেটি বজায় রাখা ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড়, প্রধান কাজ। একটি মহল দিনের পর দিন নৈরাজ্য চালিয়ে যাবে আর প্রশাসনের ‘মিউচুয়াল’ নীতি অবলম্বন করে সব কিছু হিমঘরে পাঠিয়ে দেবে- এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই প্রশাসনিক অনৈতিক চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় চরিত্রের সাথে মানায় না। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রলীগ মানেই আতঙ্ক, এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটি ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের জন্য কোনোভাবেই সম্মানের নয়। যে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদেরসহ আরো বহু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব, সেই ছাত্র সংগঠনের বছরের পর বছর ধরে নানা অপকর্ম, অপরাধমূলক ও অসম্মানজনক ঘটনায় জড়িয়ে দুর্নাম কামানো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছাত্রলীগের অপকর্মে বিরক্ত হয়ে একসময় এর অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন। তার এই অভিব্যক্তি সংগঠনটি উপলব্ধি করতে পারেনি। একের পর এক বাধাহীনভাবে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সংগঠনটি নিয়ন্ত্রণের যেন কোনো উপায় নেই। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। এ সংগঠনের বেপরোয়া আচরণ থেকে বের করে সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। অন্য দিকে সংগঠনটির যেসব নেতাকর্মী অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে (ইনকিলাব, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

জিঘাংসার অপরাজনীতি আরো কতজনের প্রাণ কেড়ে নেয় কে জানে? এক বুক আশা নিয়ে মা-বাবা সন্তানদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। অথচ শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই প্রিয় সন্তানের লাশ কবরস্থ করতে হয়। এই অপার বেদনা প্রকাশের ভাষা নেই; এই দুঃখ রাখার জায়গা নেই। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে র‌্যাগিং ও টর্চার সেল স্থাপন এবং ক্যাম্পাসে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ না থাকা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে দীক্ষা পান না; সেটি পান রাজনৈতিক উৎস থেকে। ঘাতক ও নিহত সবাই আমাদের সন্তান। এই অসুস্থ প্রবণতার অবশ্যই পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিপক্ষের হাতে বারবার প্রাণ হারাচ্ছেন। যেসব দলীয় নেতা শিক্ষার্থীদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন, তারা এসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না কিছুতেই। হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই হতে হবে। যাতে হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যবস্থা নেয়া সর্বাধিক জরুরি। এগুলো উপসর্গ মাত্র, রোগের স্থায়ী চিকিৎসা জরুরি। এই রোগ কিন্তু ক্রনিক।

বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় স্বার্থে ও ক্ষমতার মোহে ছাত্রদের রাজনীতিতে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ফলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ‘মিনি ক্যান্টনমেন্টে’ পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত; সেশনজট লেগেই আছে; যেকোনো মুহূর্তে আপন সন্তান লাশ হয়ে ঘরে ফেরার অজানা আশঙ্কায় অভিভাবকরা প্রহর গোনেন। কত মেধাবী ছাত্র অকালে ঝরে পড়েছে, তার হিসাব নেই। ছাত্ররাজনীতি আমাদের যা দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে তার শতগুণ। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। আইন অনুযায়ী মামলা ও কিছু অভিযুক্তকে আটকও করা হয়। তবে মামলাগুলো বিচারের মুখ দেখে না। ছাত্ররাজনীতি আমাদের জন্য আদৌ প্রয়োজনীয় কি-না, এটি তর্কসাপেক্ষ। কেউ কেউ মনে করেন, জাতীয় নেতা তৈরির জন্য ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। উন্নত দেশগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ওই চিন্তার অসারতা উপলব্ধি করা সম্ভব। পৃথিবীর বহু প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ছাত্রজীবনে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। আমাদের দেশের বহু রাজনীতিবিদের ছাত্ররাজনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা কর্মসূচি, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল অবদান রয়েছে। তবে সে আদর্শবাদী ছাত্ররাজনীতির আদর্শবোধ ও ঐতিহ্য অবশিষ্ট নেই। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অবশ্যই থাকবে; কিন্তু ছাত্ররাজনীতির কলুষতাময় আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্ররাজনীতি একসময় ছিল শ্রদ্ধা ও সম্মানের বিষয়, এখন তা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তদবিরবাণিজ্যের নিরাপদ আশ্রয়। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে এটি এখন অপ্রয়োজনীয়, নিন্দনীয় ও গর্হিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভির মতো মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ক্রিমিনাল বানিয়েছেন দেশের রাজনীতিকরা। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের সংঘর্ষে মারা গেছেন ২৯ জন। আর এ সময়ে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্য সংগঠনের ১৫ জন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণের বাজেট থেকে ছাত্রনেতারা যে বিপুল চাঁদা নিয়েছেন তা টক অব দ্য কান্ট্রি। কমবেশি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই নোংরা চিত্র।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বহু দেশে সেশনজট নেই এবং নির্দিষ্ট সময়ে সেমিস্টার শেষ করা বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ান, যাতে ওরা নিরাপদে থাকতে পারে। হতদরিদ্র, প্রান্তিক কৃষক ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা দলীয় রাজনীতির বলি। কারণ তাদের পক্ষে বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করা সম্ভব হয় না। একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার নিরবচ্ছিন্ন কেন্দ্র। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতেন এবং এই সুযোগ পেতেন। সে ঐতিহ্য এখন আর নেই। এখন সব ধরনের নিয়োগ হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। ভিসি, ডিন, প্রোভিসি, প্রভোস্ট নিয়োগে শিক্ষকদের ভোটের প্রভাব আছে। তাই শিক্ষক নিয়োগের চেয়ে ভোটার নিয়োগের প্রয়াস পায় প্রাধান্য। নিরপেক্ষ অথবা প্রতিপক্ষের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্রছাত্রীকে ফার্স্ট ক্লাস না দিয়ে নিজের দলের শিক্ষার্থীকে ফার্স্ট ক্লাস দেয়ার নজির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূরি ভূরি। এরাই দলীয় ছত্রছায়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। আর এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। সরকার বা বিরোধী দল ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার উদ্যোগ নেবে কি-না সন্দেহ আছে। কারণ তাদের দলীয় স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবহার করতে হবে। তাদের কাছে ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি হচ্ছে ছাত্ররাজনীতি।

সবার মনে রাখা দরকার, দেশের ছাত্র-জনগোষ্ঠী আমাদের সন্তান, ভাই ও আপনজন। তাদের জীবন নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলতে পারি না। মানবজীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় ছাত্রজীবন। জ্ঞানার্জনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ছাড়া তা অর্থহীন। অর্জিত জ্ঞানের আলো নিয়েই তাকে সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে হবে। একজন ছাত্র ভবিষ্যৎ জীবনে কী ধরনের ব্যক্তিরূপে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার প্রস্তুতির ওপর। আদর্শ মানুষরূপে গড়ে ওঠার সাধনা চলে ছাত্রজীবনে। অধ্যয়ন ও নিয়মানুবর্তিতা ছাত্রজীবনের দু’টি প্রধান কর্তব্য। অধ্যয়ন, সৎ গুণাবলি ও কর্তব্যনিষ্ঠা ছাড়া মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না। তাই আমাদের উচিত ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেয়া এবং অধ্যয়নে মনোযোগী করা। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন, ঔদ্ধত্য, দুর্বৃত্তপনা ও খুনাখুনি বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই।

টিএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ