শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কওমি মাদরাসার ছুটিতে শিক্ষার্থীদের জন্য একজন উস্তাযের নির্দেশনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আল আমিন বিন সাবের আলী।।

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ৪৬তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষা শেষ হলো আজ। এ পরীক্ষার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটল পুরো একটি বছরের (২০২২-২৩ঈ./১৪৪৩-৪৪হি. শিক্ষাবর্ষের)। পরীক্ষা শেষে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে সারাদেশের মাদরাসা ছাত্ররা। ছুটি কাটাতে সবাই চলে যাচ্ছে নিজ নিজ ঠিকানায়। দীর্ঘ সময় থাকবে এ ছুটি।

ইসলামে আভিধানিক অর্থে যদিও ‘ছুটি’র কোনো ধারণা নেই। যদ্দরুণ নির্ধারিত সময়ে করনীয় ফরজ ইবাদতসমূহে এক ওয়াক্তেরও ছুটি নেই। অনুরুপ সীমিত পর্যায়ের যে ছুটি, তার সময়গুলোও অনর্থক কাজ-কর্মে নষ্ট করার অনুমতি ইসলাম দেয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসাগুলোর বন্ধ-‘ছুটি’র মর্ম হলো, কাজের ধরন ও নিয়ম পরিবর্তন করা।

মাদরাসা খোলা অবস্থায় নিয়মিত কাজের চাপে যে কাজগুলো করার সুযোগ হয়ে ওঠে না ছুটির মধ্যে তা যেন কিছু কিছু করা যায় এবং ছুটির পর যেন নতুন উদ্যমে নির্ধারিত কাজে মনোনিবেশ করা যায়।

এজন্য আমাদের বড়দের অভ্যাস ছিল, তারা ছুটির দিনগুলোর জন্য আলাদা নিজামুল আওকাত রাখতেন এবং তাদের বিশেষ ছাত্রদেরকেও এ নির্দেশনা দিতেন যে, নিজ নিজ তালীমী মুরব্বীর পরামর্শক্রমে ছুটির দিনগুলোর একটি নেজাম সামনে রেখে চল, যাতে ছুটির উদ্দেশ্য হাসিল হয়।

একজন শিক্ষাগুরু তার শিষ্যকে নিজ সন্তানের মতো করে দেখেন বা লালন করতে চান। রাসুলে কারীম সা.-এর বাণী ‘আনা লাকুম মিছলুল ওয়ালিদি লিওয়ালাদিহি’ -আমি তোমাদের সামনে সন্তানের সামনে একজন পিতার মতো - যার অনন্য দৃষ্টান্ত। নিজ ছাত্ররা কিভাবে কাটাবে সামনের দিনগুলো-এ চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠে একজন দায়িত্ব সচেতন ও অভিভাবকমনা শিক্ষকের তনুমন।

সে তাকিদ থেকেই সামনের কথাগুলো তুলে ধরা কোমলমতি প্রিয় শিক্ষার্থীদের সামনে। তাদের কোনো একজনও যদি পেয়ে যায় সঠিক পথের দিশা, সিরাতে মুস্তাকীমের রাহনুমায়ী.. তাহলেই সফল ধরে নিব প্রতিটা শিক্ষাগুরু ব্যাকুল হৃদয়ের আকুলতার। যেমনিভাবে রাসুল সা. তার প্রিয় সাহাবী হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রা. কে ইয়ামানে পাঠানোর সময়ও তার আমল-আখলাকের ব্যাপারে চিন্তান্বিত হতে ভুলেননি।

তাকে নসিহত করে বলেছিলেন, ১. ‘ইত্তাকিল্লাহ’-আল্লাহকে ভয় করে চলবে। ২. ‘ওয়া আতবিয়িস সায়্যিআতল হাসানাহ তামহুহ’- কোনো গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নেক কাজ করে নিবে, তা সেটাকে-গোনাহকে মুছে দিবে। ৩. ওয় খালিকিন নাসা খুলুকান হাসানা’- লোকদের সাথে সদয় আচরণ করে চলবে। মুসনাদে আহমাদ, ৫/২৩৮।

অতএব হযরত মুয়াজ রা.কে রাসুল সা.-এর কৃত নসিহতটি আমাদের প্রত্যেক ছাত্রের প্রতি বন্ধ-ছুটি কাটানোর ক্ষেত্রে হতে পারে আদর্শ মাইলফলক। পাশাপাশি আরো যে বিষয়গুলো তালেবে ইলম ভাইয়েরা খেয়াল করে চললে জীবন আলোকিত হবে নিজেদের, এমনকি সক্ষম হবেন অন্যদেরও আলোকিত করতে, ইনশাআল্লাহ!

১) মাদরাসা থেকে বের হওয়ার সময় সকল উস্তাযের সাথে দেখা-সাক্ষাত ও দোয়া নিয়ে এবং ইসলাহী ও তালীমী মুরব্বীদের দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করত তাদের মোবাইল নাম্বারও সংগ্রহ করে বাড়ির দিকে রওনা করা।

২) বাড়ি গিয়ে বিরতির দিনগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে বিশ্রাম ও তাফরীহ’র জন্য কিছুটা বেশি সময় বরাদ্দ রাখতে পারেন। কেননা এটাও ছুটির একটা বিশেষ উদ্দেশ্য।

৩) অন্য দিনগুলোতে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা ও তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া সম্ভব হয় না, তাই এটিও এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী হতে পারে। তবে তা হতে হবে সম্পূর্ণ পর্দা-পুশিদার দাবী রক্ষা করে এবং সীমিত সময়ের জন্য।

৪) কুরআন মাজিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা। অর্থাৎ কুরআনের নির্দেশনা ও দাবী এবং আয়াতের মর্ম শুদ্ধ ও সাবলীল ভাষায় প্রকাশের যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা ও মুখস্থ অংশটুকুর দাওর করা। বিশেষত রমজান মাসে তেলাওয়াত চালু রাখা ও হিফজ ইয়াদ রক্ষার্থে হাফেজরা তারাবীর নামাজ পড়ানোর প্রতি বেশি মনোযোগী হবেন। আর গায়রে হাফেজরা নিয়ম করে দৈনিক ৩ পারা তেলাওয়াত, পুরো মাসে ৩ খতম তেলাওয়াত সম্পন্ন করার দৃঢ় ও মজবুত ইরাদা রাখা।

৫) দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে সময় দেওয়া। বিরতির মধ্যে ৩ দিন ১০ দিন বা ২০ দিন কিংবা ৪০ দিনের (চিল্লার) জন্য বের হওয়া। আর এভাবে স্বতন্ত্র সময় নিয়ে বের হতে সক্ষম না হলে নিজের মহল্লায় দাওয়াতী কাজের জন্য কিছু সময় বরাদ্দ রাখবে। অর্থাৎ কোনো তাবলীগ জামাত আসলে নুসরত করা, নামাজের পরে মসজিদে এবং দিন-রাতের কোনো এক সময় নিজের ঘরে আজান, ইকামত, নামাজ ও সুন্নতসমূহের মশক করানো। কুরআন তেলাওয়াত বিশুদ্ধ করানো ইত্যাদি।

৬) তালেবে ইলমের সূরত-সীরাতে সুন্নতের ইহতেমাম, জামাতের সাথে নামায আদায় ইত্যাদি বিষয়গুলো বিরতির দিনগুলোতেও তেমন থাকা চাই যেমন মাদরাসার চার দেয়ালের ভেতরে থাকে। বরং তার চেয়েও উন্নত রাখার চেষ্টা করা উচিত। এসব বিষয়ে তালেবে ইলমের কোনো ছুটি নেই। বাহ্যিক বেশভুষা, আচার-ব্যবহার এবং চাল-চলনের দিক থেকেও তালেবে ইলমকে দায়ী এবং অন্যদের জন্য আদর্শ হতে হবে।
৭) কোনো ‘ইলমী’ বা ‘আমলী’ প্রশিক্ষনে অংশ নেওয়া।

৮) মুতালাআ ও পড়াশোনা। অল্প হলেও বিরতির দিনগুলোর কিছু সময় বিভিন্ন কিতাবাদী মুতালাআর জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। নির্ভরযোগ্য কিতাব ও উৎস থেকে মুতালাআর স্বার্থে নিজের তালীমী মুরব্বীর নির্দেশনাক্রমে মুতালাআযোগ্য কিতাব নির্বাচন করে নিবেন।

৯) দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রসমূহ এবং বড় বড় কুতুবখানা পরিদর্শন করা।যথাসাধ্য এ কাজে সময় দিতে পারলে ইলমী ও আমলী ময়দানে অভিজ্ঞতা বাড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ রাসায়েল ও গ্রন্থাদির ব্যাপারে জ্ঞান-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়।

১০) ঘনঘন উস্তায ও মুরব্বীদের সাথে ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা। সপ্তাহে কমপক্ষে একবার অভিভাবকের ফোন দিয়ে কল করে উস্তায ও মুরব্বীদের খোঁজ-খবর নেওয়া। এবং নিজেদের হালাত জানান দেওয়া।

আল্লাহ আমাদের সকল তালেবে ইলমকে উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো পরিপূর্ণ আমল করে তাদের ছুটিগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন, আমীন!

(তথ্যসূত্র : তালিবানে ইলম, পথ ও পাথেয়-অবলম্বনে রচিত)
লেখক: উস্তাযুল ইফতা ওয়াল কিতাব
জামিআতুল আবরার দাওয়াতুস সুন্নাহ কাঁচপুর মাদরাসা

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ