শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আলেম উদ্যোক্তাদের সোনালি অতীত; ইতিহাসের আয়নায় আলেমদের ব্যবসা বাণিজ্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক:।। একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। গল্পটি একজন নারী ব্যবসায়ীর। ইতিহাসের খোলা আয়নায় ফুটে উঠবে আমাদের দেড় হাজার বছরের যাপিত জীবনের স্বনির্ভরতার এক অব্যক্ত ছায়া। আত্মনির্ভরশীলতার অজানা ইতিহাস।

নারী উদ্যোক্তা মাখ বিনতে হারেস রহ.। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও মুহাদ্দিস। প্রখ্যাত বুযুর্গ বিশিরহাফি বাগদাদি রহ. এর আপন বোন। তাকওয়া ও দুনিয়াবিমুখতা এতটাই ছিল যে, খোদ বিশিরহাফি বলেন- আমি তাকওয়া ও দিয়ানতদারিতা আমার এ বোন থেকেই শিখেছি। এ বোন সূতা কেটে হালাল রিযিক উপার্জন করতেন। ইমাম বিশিরহাফির তিন বোন ছিল। মিদগা, মাখ ও যুবদাহ। সবার বড় মাখ। এ মহীয়সী নারী তার ভাইর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর ছেলে আবদুল্লাহ বলেন, এক মহিলা একদিন আমার বাবার কাছে এসে বলল, হে আবু আবদুল্লাহ! আমি রাতে প্রদীপের আলোতে সূতা কাঁটি। কখনো প্রদীপ নিভে গেলে চাঁদের আলোতে কাটি। এমতাবস্থায় প্রদীপে কাটা সূতা ও চাঁদের আলোতে কাটা সূতা কি আলাদা করে বিক্রি করবো? তখন বাবা বললেন- তোমার দেখার মধ্যে পার্থক্য অনুভব হলে তা বলে দিবে। এরপর মহিলা আরেকটি প্রশ্ন করলেন, অসুস্থ ব্যক্তি প্রচন্ড অসুস্থতায় ‘হায় হায়’ করা কিংবা আহ ধ্বনি প্রকাশ করা কি অবান্তর ‘অভিযোগ’ হবে? আল্লাহর সিদ্ধান্তে ভরসা না করে অভিযোগ করার নামান্তর হবে?

আমার পিতা বললেন, আমার দৃষ্টিতে এমনটি করা অভিযোগ না বরং আল্লাহর কাছে রুগির ফরিয়াদ প্রকাশ পাচ্ছে। এ জবাব শুনে মহিলা চলে গেল। এরপর পিতা আমাকে বললেন, এ ধরণের প্রশ্ন করতে আমি আমার জীবনে কাউকে দেখিনি। তুমি এ মহিলার ঠিকানা খোঁজ কর। যাইহোক, আমি মহিলার পেছনে পেছনে চললাম। মহিলা বিশিরহাফির ঘরে প্রবেশ করায় বুঝতে পারলাম তিনি বিশিরহাফির বোন হবেন হয়তো। আমার বাবাকে বিষয়টি বললে তিনি বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। বিশিরহাফির বোন মাখ ছাড়া ও প্রশ্ন কেউ করতে পারে না।

হৃদয় নাড়া দেয়া আরেকটি গল্প আমাদের পাশের। শায়েখ আহমদ নহরওয়ালি (পাটনা, গুজরাট, ভারত)। এ মনীষী কাযি হামিদুদ্দীন ঘুরির মুরিদ ছিলেন। কাযি হামিদুদ্দিন তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তার সাথে দেখা করার জন্য তার বাসায় নিয়মিত যেতেন। এ শায়েখ আহমদ হালাল উপার্জনের জন্য কাপড় বুননের কাজ করতেন। টেক্সটাইল কারখানার পাশাপাশি নিজ ঘরেও কাপড় বুনতেন।

একদিন কাযি হামিদুদ্দিন তাঁর এ মুরিদের ঘরে মুলাকাতের জন্য গিয়ে তাকে বললেন- আহমদ! তুমি কতদিন একাজ করবে? দ্বিতীয় দিন শায়েখ আহমদ কাপড় বুনার জন্য চরকি ঠিক করছিলেন। এমন সময় হাতে প্রচন্ড চোঁট পেলেন এবং সে দিন থেকে কাপড় বুননের কাজ বাদ দিয়ে ইবাদত সাধানায় আত্মনিয়োগ করেন। একরাত এক চোর তার ঘরে প্রবেশ করে কিছু না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে গেল। চোরের এ আসহায়ত্ব অনুভব করে তিনি একটি কাপড় রাস্তায় রেখে দিলেন যেন কোন চোর কাপড় থেকে বঞ্চিত না হয়। এ দৃশ্য দেখে চোর সকাল বেলা তার সন্তানাদিসহ শায়খের খেদমতে এসে তওবা করলেন এবং শায়খের হাতে বাইয়াত হয়ে পাক্কা আবেদ বনে গেলেন। বাদায়ুনে এ মনীষীকে দাফন করা হয়। পাটনার নহরওয়ালা এলাকায় তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

ব্যবসা বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও আমানতহীনতার এ সময়ে ইতিহাসের ছোট ছোট এ গল্পগুলো আশাজাগানিয়া। এমন অসংখ্য গল্প রয়েছে আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসে। মুয়ামালাত ও মুয়াশারাত তথা সামাজিক শিষ্টাচার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের আদর্শের চরিত্রগুলো হারিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা কারো অজানা নয়। অথচ এখনও উলামায়ে কেরামের ব্যবসা বাণিজ্যে যুক্ত হওয়া নিজ বেরাদরীতে অচ্ছ্যুত অস্পৃশ্য হয়ে থাকার মত। এ দায় কার?

২. উলামায়ে কেরাম কুরআন হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী ইলমে দীনের হেফাজত, আত্মনির্ভরশীলতা ও স্বাধীনভাবে দীনের কাজ করার জন্য যুগে যুগে উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন করেছেন। দুনিয়াদারদের প্রতি অমুখাপেক্ষিতা, নিজেদের পরিবার পরিজনের চাহিদা পূরণ করে তারা নিশ্চিন্তে দীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।
হযরত উমর রা. উলামায়ে কেরামদের বলতেন, হে উলামায়ে কেরাম! দীনি কাজে সংযুক্ত থেকে আল্লাহর দেয়া রুজি তালাশ করতে থাক। পরনির্ভরশীল হয়ো না। আবু যিবইয়ান বলেন, হযরত উমর রা. একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু যিবইয়ান! তোমার আয় কত? আমি বললাম, আমার বেতন আড়াই হাজার। জবাব শুনে হযরত উমর বললেন, চাকরির সাথে সাথে তুমি কিছু গবাদি পশুও লালন পালন কর।

হতে পারে, কুরাইশের অনভিজ্ঞ যুবক পর্যায়ের কেউ খেলাফতের দায়িত্বে আসলে তোমার বেতন বন্ধ করে দিতে পারে। প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইমাম আবু কিলাবা তার শিস্য আইয়ুব সাখতিয়ানিকে বলেছেন, তুমি বাজারে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য কর। ব্যবসা বাণিজ্য করলে মানুষের কাছে হাত পাতা লাগে না। অমুখাপেক্ষি থাকা যায়। দীনদারিও ভালোভাবে আদায় হয়। আইয়ুব সাখতিয়ানি উস্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ট্যানারি ব্যবসা শুরু করেন। এবং এ ব্যবসার লাভ দিয়ে পরিবার পরিজনের চাহিদা পূরণ করতেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, আমার পরিবার যদি এক মুষ্ঠি সবজির মুখাপেক্ষি হত তাহলে আমি তোমাদের সামনে বসে দরস দিতাম না।

এমন উক্তি একটি দুটি নয় অসংখ্য। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দায়রায় না গিয়ে সরল বাক্যে বলি, এমন হাজারো ঘটনা রয়েছে আমাদের হারানো সোনালী ইতিহাসে। আত্মনির্ভরশীলতায় উন্নীত হওয়ার গল্প। হালাল, বৈধ সমস্ত পেশায় দীনের আলো নিয়ে ছড়িয়ে দেয়ার গল্প।

৩. ইতিহাসের ইতিহাস সৃষ্টি করা এ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় প্রথম। উর্দু ভাষাতেও আমাদের জানামতে প্রথম। আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব ও নতুনত্ব নিয়ে বিদগ্ধ মনীষীগণ যে অভিব্যক্তি পেশ করেছেন তা সময়ের বিদ্যানদের চোখ আরো খুলে দিবে। কাযি আতহার মুবারকপরি রহ.’র জীবনের সেরা রচনাকর্ম হিসেবে এ গ্রন্থ হাজার বছর প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।

হাজার হাজার আলেম উলামা, মুহাদ্দিস, ফকিহ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবি, চাকুরিজীবি, ইতিহাসের ছাত্র শিক্ষক ও গবেষকসহ সবার জন্য এক অমূল্য পাথেয় এ গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশের সাথে যারা যেভাবে যুক্ত ছিলেন সবার কর্মফলকে আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। উলামায়ে কেরামের ব্যবসা বাণিজ্যের পথকে আল্লাহ তাআলা আরো সুগম করুন। এ গ্রন্থ পড়ে আলেম উলামা ও দীনদার ব্যবসায়ীসহ পাঠকের মধ্যে নতুন চেতনা জাগ্রত করবে। মূল গ্রন্থটি ভারতের প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবীদ মাওলানা কাজি আতহার মুবারকপুরির। গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন লেখক, অনুবাদক আবুল ফাতাহ কাসেমি।

ধরন: ব্যবসা-বাণিজ্য, উদ্যোক্তা। পৃষ্ঠা: ২৭২। মুদ্রিত মূল্য: -৪৮০ টাকা। প্রি অর্ডার মূল্য: ৩১০ টাকা। ডেলিভারি চার্জ: ৪০ টাকা। গ্রন্থটি নন্দন প্রকাশনী ও কওমি উদ্যোক্তার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হচ্ছে। অনলাইন বুকশপ রকমারিসহ সব ই প্লাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে ইতোমধ্যে। ইসলামে জীবিকা অন্বেষণে ব্যবসার তাগিদ এসেছে সর্বাগ্রে। সৎ ব্যবসায়ীদের হাশর নবি-সাহাবিদের সঙ্গে হবে বলেও প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন স্বয়ং আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

নবি, সাহাবি, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ থেকে নিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসে সোনালি একটা অধ্যায় ছিল। যেখানে ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের সাফল্যের গল্প ছিল। তবে কালের পরিক্রমায় বলি কিংবা সামাজিক বিস্মৃতিতে আমরা সেই ইতিহাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। এ বইটি আমাদের সেই হারানো ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার একটি সূত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। বইটি সম্পর্কে ভারতের প্রখ্যাত লেখক, বিদগ্ধ মনীষী মাওলানা আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদি বলেন, ‘এ বইটি সব মানুষের চোখ খুলে দেবে।’ আশা করি গ্রন্থটি উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখবে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ