বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


তাকমিল শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবেন যেভাবে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি লুকমান হাসান
শিক্ষক

শুরুর কথা

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ইমতিহান। পরীক্ষা মানে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ এবং তাতে উত্তীর্ণ হওয়া। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছার অন্যতম উপায় হলো ইমতিহান। জীবনের বাঁকে বাঁকে পরীক্ষার অমসৃণ পথ থাকায় কিছু মানুষ সাধারণ থেকে অসাধারণ হতে পারে, হতে পারে অন্যদের থেকে অনন্য ও ভিন্ন। তাই পরীক্ষাকে বলা হয় একটি শিল্প। এর জন্য দরকার যথাযথ প্রস্তুতি ও গুরুত্বারোপ।

পরীক্ষার প্রস্তুতি বিষয়ে বড় বড় অনেকেই লিখেছেন। যার মধ্যে ড. আব্দুর রহমান রাফাত পাশা রহ. এর فن الامتحان পুস্তিকাটি প্রসিদ্ধ। আগ্রহীগণ পুস্তিকাটি একবার পড়ে নিতে পারেন। অনলাইনে পিডিএফ কপিও পাওয়া যায়। এ বিষয়ে বক্ষমান নিবন্ধটিতে সামান্য ধারণা তুলে ধরা হয়েছে।


ইমতিহানের উদ্দেশ্য কী?

ইমতিহানের কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এক. নিজের যোগ্যতা যাচাই করা। দুই. অল্প সময়ে কিতাব রপ্ত করে নেওয়া। তিন. পরীক্ষা উপায় ও উপকরণের পর্যায়ে একটি জরুরি বিষয়। দীনি খেদমতের বহু সুযোগ তৈরীর জন্য পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা খুবই জরুরি। তাই একথা ভুলে যাওয়া যাবে না যে, পরীক্ষা জীবনের মূল লক্ষ্য নয়; বরং লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হওয়ার কেবলই একটি মাধ্যম। মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো, কুরআন-সুন্নাহয় ব্যুৎপত্তি অর্জনের যোগ্যতা তৈরি হওয়া।

ফিকহ ফিদ্দীন ও দীনি ফাহম অর্জনের পথ সুগম করা। তাই গাইডকেন্দ্রিক কিংবা পরীক্ষা নির্ভর পড়াশোনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। কারণ, এভাবে পরীক্ষা দিলে হয়তো ভালো ফলাফলের সাময়িক আনন্দ পাওয়া যাবে। কিন্তু তা আপনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দিবে এবং সনদভিত্তিক একটি মিথ্যা চেহারার আলগা খোলস তৈরী করে দিবে। বাস্তবতার নির্মম ঘর্ষণে তা একসময় খসে পড়বে। তাছাড়া এভাবে পড়াশোনা মেধা ও প্রতিভাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যা একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারত্মক ক্ষতি। তাই নিজের সাথে ও নিজের প্রতি সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকা একান্ত অপরিহার্য।

অল্প সময়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে সম্পন্ন যাবে?

ভালো পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি থাকতে হবে। কথায় আছে, কঠিন প্রস্তুতি সহজ যুদ্ধ। তবে এজন্য প্রয়োজন কৌশল ও পরিকল্পনা এবং টার্গেট নির্ধারণ ও নিষ্ঠার সাথে তা পুরা করার উদ্যম। পরিকল্পনাবিহীন শ্রম সময়ের অপচয়ের কারণ, আবার উদ্যম ছাড়া পরিকল্পনা কল্পনাবিলাসিতা বৈকি। তাই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।

তালেবে ইলমগণ এ থেকে ভালো একটি আইডিয়া নিতে পারবেন। নিজের মতো করে কৌশল ও পরিকল্পনা করতে পারবেন বলে আশা করছি। ৩টি পর্যায়ে আমাদের ভালো প্রস্তুতি থাকতে হবে। এক. কিতাব ভিত্তিক প্রস্তুতি। দুই বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি। তিন. আরজ ও উপস্থাপনা কেন্দ্রিক প্রস্তুতি।

১. কিতাবভিত্তিক প্রস্তুতি: পরীক্ষা বলতে গেলে একেবারেই সন্নিকটে। দাওরা জামাতে সারা বছরে হাদিস ভাণ্ডারের যে পাহাড় সামনে জমা হয়েছে, তা রপ্ত করার জন্য কিছু টিপস অনুসরণ করা যেতে পারে। এতে অনেক পড়া অল্প সময়ে রপ্ত করা সম্ভব।

দাওরায় পঠিত কিতাবগুলোর কয়েকটি ভাগ আছে। যেমন, সবগুলো কিতাবে কিছু কমন ও কদরে মুশতারাক বিষয় রয়েছে। আবার প্রত্যেক কিতাবের স্বতন্ত্র কিছু বিষয় রয়েছে। কদরে মুশতারাক ও স্বতন্ত্র বিষয়গুলো নির্ণয় করতে হবে। যেমন, সহিহ বুখারীর স্বাতন্ত্র হলো, تراجم الأبواب। এটি সুপ্রসিদ্ধ যে, فقه البخاري في تراجمه। তাই সহিহ বুখারীর তারাজিম ভালো করে হল করতে হবে।

অনুরূপভাবে সহিহ মুসলিম এর মুকাদ্দিমা আলাদাভাবে পড়তে হবে। সুনানে আবু দাউদের জন্য قال أبو داوود আলাদাভাবে পড়তে হবে। ত্বহাবী শরীফের জন্য نظر طحاوي গুলো আলাদাভাবে হল করতে হবে। ইত্যাদি।

আর কমন ও কদরে মুশতারাক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যে কিতাবে যে বাবকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, সে কিতাব থেকে মৌলিকভাবে উক্ত বিষয়কে রপ্ত করতে হবে। যেমন, طهارات، صلاة، صيام، زكاة ইত্যাদি এর বহসগুলো সুনানে তিরমিযি থেকে গুরুত্ব দিয়ে হল করা আর এ বাবগুলোর জন্য অন্যান কিতাবের পড়াকে সহায়ক হিসাবে বিবেচনা করা। অনুরূপ كتاب الإيمان এর আলোচনা সহিহ মুসলিম (১ম) থেকে হল করা। كتاب البيوع সহিহ মুসলিম ২য় থেকে ভালো করে হল করা।

২. বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি: বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতির অর্থ হলো, কোন বিষয়ে কিভাবে প্রস্তুতি নিব, তা ঠিক করে নেওয়া। কোন কোন বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে থাকে তা জানা। যেমন, ইবারতের তাশকিল, তরজমা, তাশরীহ, হল্লে লুগাত ও ইবারত সংশ্লিষ্ট ফিকহী বহস বা তাকরীর। সাধারণত এ বিষয়গুলোতেই প্রশ্ন হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সহজে প্রস্তুতি নেওয়ার উপায় কী? উপায় হলো, তরজমা, তাশকীল, হল্লে লুগাত ও ইবারতের শরাহ হল করা খুবই সহজ।

সবক চলাকালেই উস্তাযের তাকরীরের সময় ইবারতের যে অংশটুকু আপনার হল নেই, কিংবা নতুন শব্দ, অথবা বাড়তি সময় দিয়ে হল করতে হবে এমন অংশগুলো পেন্সিল দিয়ে মার্ক করে নিন। দারসে এমনটি করা না গেলে প্রথমবার মুতলাআর সময় করুন। অনুরূপভাবে হাশিয়ার কোনো অংশবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে মার্ক করে নিন।

দ্বিতীয়বার পরীক্ষার আগে শুধু মার্ক করা অংশ হল্ করলেই আপনার যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। এভাবে আপনার পড়ার পরিমাণ মিনিমাইজ (সীমিত) হয়ে আসবে। যখন খেয়ার শুরু হবে তখন অল্প সময়ে পুরো কিতাবের প্রয়োজনীয় অংশটুকু আপনি অতি অল্প সময়ে পড়ে নিতে পারবেন। স্মরণ রাখার জন্য এ পন্থা অত্যন্ত কার্যকরী।

দ্বিতীয়ত তাকরীর ও ফিকহী বহসগুলো মনে রাখার সহজ উপায় হলো, অতি সংক্ষিপ্তভাবে বয়ানে মাযহাব, দালায়েল ও উজূহে তারজীহ নোট করে নেওয়া। শুরুতেই মুখস্ত করার দিকে গুরুত্ব না দেওয়া। ইমামগণের নাম, তাদের মাযহাব সাংকেতিকভাবে লিখা।

যেমন, আবু হানীফার ক্ষেত্রেحف লেখা হলো। শাফেয়ীর ক্ষেত্রে شف লেখা হলো। দলিল স্মরণ রাখার জন্য মহল্লে ইসতেশহাদ (দলিলের মূল ইবারত) অংশটুকু লিখে রাখা। পরবর্তীতে চলতে ফিরতে উক্ত নোট খাতা সাথে রাখতে পারেন। তখন পুরো পৃষ্ঠার উপর নজর বুলিয়ে পৃষ্টাটিকে ব্রেইনে ছবি আকারে সংরক্ষণ করে নিন। কারণ, বিষেজ্ঞদের মতে, মানুষ যা পড়ে তার চেয়ে শোনা জিনিস বেশি মনে থাকে। আর যা দেখে, তার দৃশ্য ও ছবি সবচেয়ে বেশি স্মরণ থাকে।

৩. উপস্থাপনা কেন্দ্রিক প্রস্তুতি: আপনি কী জানেন বা কতটুকু জানেন, তা যথাযথভাবে বুঝানোর জন্য উপস্থানাগত প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই ঠিক করে নিন, আপনি কোন ভাষায় পরীক্ষা দিলে বিষয়বস্তুকে সহজে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন। আরবীতে হলে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু আরবীতে নিজের কথা স্পষ্ট করতে না পারলে শুধু আরবীতে উত্তর দেওয়ার নাম্বার পাওয়ার আশায় পুরো বিষয়বস্তু ঝুঁকিতে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

দ্বিতীয়ত আপনি যে ভাষায় পরীক্ষা দিতে চাচ্ছেন, সে ভাষায় বিশুদ্ধ বানানে ও সুন্দর হস্তাক্ষরে আপনার কথা প্রকাশ করতে অনুশীলন করুন।

তৃতীয়ত পরীক্ষার খাতায় কিভাব সাজিয়ে লিখবেন, তা অভিজ্ঞ কাউকে মাঝে মধ্যে ২/১টি প্রশ্নের উত্তর লিখে দেখান। পরীক্ষায় যেভাবে লিখেন, ঠিক সেভাবে লিখে নিজের মুমতাহিন নিজেই হয়ে কাটাছেড়া করুন।

চতুর্থত পরীক্ষার কিছু নিজস্ব পরিভাষা আছে। সেগুলো রপ্ত করুন। যেমন, এক নং প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় তার শিরোনাম আরবীতে ও বাংলায় কেমন হবে। অনুরূপভাবে উপশিরোনাম ও প্রত্যেক শেকের আলিফ, বা, জিম ইত্যাদির শিরোনাম কিভাবে লিখবেন- তা সঠিকভাবে শিখতে হবে। একটি অংশের উত্তরে যদি ৩ নাম্বার বরাদ্দ থাকে, তাহলে তার জন্য কতটুকু বিষয়বস্তু লিখতে হবে আর ১০ নাম্বার থাকলে কতটুকু লিখতে হবে- এসব শিখে নেওয়া।

পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক আরো কিছু বিষয়

পরীক্ষার খাতায় কোনোভাবেই লাল, গোলাপি, কমলা কিংবা লালের কাছাকাছি অন্য কোনো কালার ব্যবহার করা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয়, শুধু কালো ও নীল কালির কলম ব্যবহার করা।
দ্বিতীয়ত অতিরিক্ত সজ্জায়ন বিরক্তিকর। তাই রকমারি কালার ব্যবহার করার চেয়ে যত সাদাসিধেভাবে উপস্থাপন করা যায়, ততই উত্তম।

তৃতীয়ত পরীক্ষার খাতায় প্রথম পৃষ্ঠা অত্যন্ত যত্নের সাথে পুরা করা। নিবন্ধন নাম্বার, রোল নাম্বার, কথায় ও অংকে এবং কিতাবের নামসহ সবগুলো খানা বাংলা কিংবা আরবীতে সঠিকভাবে লেখা অত্যন্ত জরুরী। দাওরার সবগুলো হাদিসের নাম সঠিকভাবে লিখা খুবই জরুরী।

খেয়ারে পড়া শুরু করবেন যেভাবে

পরীক্ষার খেয়ার শুরু হওয়ার পর রুটিন মতো পড়তে হবে। যে কিতাবের যে অধ্যায়টি আপনি পড়তে শুরু করবেন, সে অধ্যায়টির উপর প্রথমে সরসরি দৃষ্টি দিয়ে পুরো অধ্যায়ে কয়টি মাসআলা, কি কি বিষয় ও বহস রয়েছে তার উপর সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা নিন। তারপর সে অধ্যায়টি পড়তে থাকুন। এতে পুরো অধ্যায়টি মনে রাখা সহজ হবে এবং তা পড়তে কতটুকু সময় ব্যয় করতে হবে- প্রথমেই তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

শেষকথা

যে কোনো প্রচেষ্টা সফল করার জন্য চেষ্টার সাথে দুআ ও ইনাবত ইলাল্লাহ থাকতে হবে। তাহলে সফলতা ও তার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব। তাই চেষ্টা করুন, প্রতিদিন দুই রাকাত করে নামাজ পড়ে হাদীসের সিলসিলার সবার জন্য দুআ করতে। যারা এ দ্বীনের খেদমতে নিবেদিত ছিলেন এবং রয়েছেন, পাশাপাশি যে নতুন নবীন কর্মবীররা অচিরেই দ্বীনের এ ময়দানে অবতরণ করছে তাদের সবার জন্যে দুই করতে।

লেখক: শিক্ষক, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর