শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কে ওয়াজ করার অধিকার রাখে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আল্লামা সুলতান যওক নদভী।।

আমি যখন (গত খ্রিষ্টীয় শতেকর ষাটের দশকে) বশরত নগর মাদ্রাসায় (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) শিক্ষকতা শুরু করি, তখন এলাকার বিভিন্ন মাহফিলে ওয়াজ করার জন্য দাওয়াত আসতে লাগল। কোরআন-হাদীসের আলোকে আমি কিছু কিছু বয়ান করতে লাগলাম।

মানুষ আগ্রহ ভরে আমার বয়ান শুনত। মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মফজাল সাহেবও (রহ.) বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন। কিন্তু আমি কি জানতাম যে, এর মধ্যে আমার আত্মিক ব্যাধি লুকিয়ে আছে, যার যথার্থ চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল?

একবার বোয়ালিয়া হোসাইনিয়া নতুন মাদরাসায় (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম) জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতী আযীযুল হক হুজুর (রহ.) এর দাওয়াত ছিল। মাদরাসা হোসাইনিয়ার মুহতামিম ছিলেন আমার শ্বশুর মাওলানা আলী আহমদ সাহেব (রহ.)। তখন মাদরাসার বার্ষিক সভা ছিল। আমিও সেখানে উপস্থিত হই।

আমার শাদী হয়েছে তখন বেশি দিন হয়নি। মাদ্রাসার প্রতিবেশী মরহুম হাজী আজিজুর রহমানের ঘরে প্রায়ই বড় বড় আলেমদের ওয়াজ মাহফিল হতো। সেখানে হযরত মুফতি সাহেব হুজুরের বয়ানের ঘোষণা দেয়া হলো।

উল্লেখ্য, এই প্রোগ্রামটি ছিল মাদ্রাসার সভার দিন সকালে। আমার শ্বশুরালয়ের মুরুব্বিদের দাবী ছিল, মুফতি সাহেবের বয়ানের পূর্বে আমিও যেন সংক্ষিপ্ত বয়ান করি। ভয়ে তখন আমার অবস্থা তো কাহিল, মুফতি সাহেব হুজুরের সামনে আমি মুখ খুলব কিভাবে?

এদিকে জলসার সব আয়োজন সম্পন্ন। মাইক্রোফোনও প্রস্তুত। এখন যা-ই বলব, হযরতের কানে পৌছে যাবে। অবশেষে তারা তাদের অবেদনটি হুজুরের সামনে পেশ করলেন। হুজুর সম্মতি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে।

কিন্তু এই সম্মতি খুব বেশি আগ্রহ ও সন্তুষ্টচিত্তে ছিল না। কিন্তু তারা কি আর এত কিছু খেয়াল করে? সামান্য সম্মতি পাওয়ার সাথে সাথেই তারা আমাকে টেনে হেঁচড়ে স্টেজে পৌঁছিয়ে দিলো। আমার অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। ভয়ে ভয়ে কয়েকটি কথা বলে নেমে এলাম।

দুপুরে মাদ্রাসার সভায়ও তাদের পীড়াপীড়িতে কিছু বলতে হলো। সন্ধ্যার দিকে হুজুরের তাকরীর শুরু হয়। বিষয় ছিল আত্মশুদ্ধি। আলেম সমাজের আত্মশুদ্ধি প্রসঙ্গে সারগর্ভ আলোচনা করছিলেন। এক পর্যায়ে বললেন, আলেম সমাজের নিজেদের আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। নিছক বাগাড়ম্বরতা ও কথার ফুলঝুরি নয়। অন্যকে উপদেশ দেয়ার পরিবর্তে গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে জ্ঞানগত দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত।

তিনি আরো বলেন, 'ওয়াজ কে করবে? যে আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে বান্দাদের বিলিয়ে দিতে পারে সেই ওয়াজ করবে। সুবহানাল্লাহ! বাক্যটি শুনতেই আমার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল।

মনে আমি যেন জমিনে গেঁড়ে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন- আমি দেখতে পাচ্ছি, যেসব আলেম যৌবনকাল থেকে ওয়াজ করে আসছে বার্ধক্যে উপনীত হয়েও তারা নিজেরা হেদায়াত পায়নি, এখনও তাদের আত্মশুদ্ধি হয়নি। হায় হতভাগা! কাকে পথ দেখাচ্ছো?

তুমি কি নিজে এখনও পথের দিশা পেয়েছো? আমি হুজুরের বয়ানের ইঙ্গিত বুঝে ফেললাম। আমাকেই টার্গেট করা হয়েছে- তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি।

আমি কেন ওয়াজ করার দুঃসাহস করলাম, এজন্যই আমার মাথার উপর এ আঘাত এসে পড়ল। বিশেষ করে, ওয়াজ তো সেই করবে-যে আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে বান্দাকে দিতে পারে'-হুজুরের এ বাক্যটিতে ছিল আমার সারা জীবন মনে রাখার মতো শিক্ষা।

দ্বিতীয় দিন মাদ্রাসার পাশে বাজারে একটি মাহফিল ছিল। যেহেতু অধিকাংশ ছিল আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্র। তাই এখানেও বিষয় ছিল একটাই (আত্মশুদ্ধি)।

আজকের বয়ানেও হুজুর পুরোপুরি আমাকে টার্গেট করলেন, আমার নামটা স্পষ্ট করে বলাই শুধু অবশিষ্ট ছিল। বললেন, গতকাল আমার এ ছেলে (পটিয়া মাদরাসার ফারেগ) ওয়াজ করছিল, আমার তো রাগ এসে গিয়েছিল। এখনও কি তার ওয়াজ করার বয়স হয়েছে?

এখন তো সে কিতাব পড়বে, অধ্যয়ন করবে, নিজের সংশোধনের চিন্তা-ভাবনা করবে"। তো হযরতের এ উপদেশ আমার হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে।

এরপর থেকে ওয়াজ-নসীহত এবং লেকচার দেওয়া থেকে মন অনেকটা উঠে গেলো। কর্মজীবনের সূচনায় এ ছিলো প্রথম পাঠ, যা মাদ্রাসায়ে ইশকে ইলাহীর শিক্ষক (মুফতী আযীযুল হক রহ.) আমাকে পড়িয়ে দিলেন। নতুবা বিশিষ্ট ওয়ায়েজে পরিণত হতাম আমি।

এই যে অল্প-বিস্তর ইলমী খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার সুযোগ হচ্ছে, তা আঞ্জাম দেয়া কঠিন হয়ে যেতো। জীবনের ধারাই বদলে গেছে আমার।
বই পুস্তক অধ্যয়ন করেছি তো জানার জন্য। অন্যকে শোনানোর জন্য বা মাহফিল গরম করার নিয়তে নয়, নিজের ফায়দার জন্যেই করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

হ্যাঁ, যদি কোন মাহফিলে বিশেষ কোন বিষয়ের ওপর কথা বলার দায়িত্ব আসে, সেই বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করা হতো। সাধারণ লোকজন দাওয়াত দিতে এলে প্রায় সময় ফিরিয়ে দিতাম। বশরত নগরের হযরত মাওলানা মফজল (রহ.) জানতেন, ওয়াজ করার কারণে আমাকে বকুনী খেতে হলো।

তাই তিনি আর আমাকে ওয়াজ করার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন না। কখনও যদি খুব বেশি বাধ্যবাধকতা থাকতো অথবা একান্ত প্রয়োজন হতো; তখন আমাকে সুপারিশ করতেন।

আজ এ কলাম যখন লিখছি, তখন আমার বয়স ষাট-সত্তরে উপনীত। হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর সেই সংশোধনমূলক শিক্ষার প্রভাব এখনও অনুভব করছি।

লেখক: আল্লামা সুলতান যওক নদভীর আমার জীবন কথা থেকে। প্রতিষ্ঠাতা, জামেয়া দারুল মা'আরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ