বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


ইসলামে বিজয় উদযাপন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান।। কালের আবর্তে আমাদের মাঝে উপনীত হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এ মাসেই জন্ম হয়েছিল আমাদের স্বাধীন সত্তার, স্বাধীন রাষ্ট্রের।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল বিজয়ের রক্তিম সূর্য। এ দিনেই আমরা পরিত্রাণ পেয়েছিলাম পাকিস্তানি শোষণ থেকে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের শৌর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয়ের দিন।

প্রায় আড়াই শ বছর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি আমাদের শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ পাচার করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। আর আমাদের উপহার দিয়েছে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বরণডালা। লাখো মানুষকে মরতে হয়েছে ক্ষুধার জ্বালায়। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা মাটির নিচে চাপা দিয়েছে বারবার।

এরপর ব্রিটিশরা চলে গেল। দেশও ভাগ হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হিন্দুরা হিন্দুস্থান কায়েম করল। আর ইসলামের সুমহান আদর্শ সাম্য, ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইসলামী জীবনাদর্শের কথা ভেবে পাকিস্তান নামক একটি দেশ গঠন করে। পাকিস্তান ছিল দু’টি অংশে বিভক্ত। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান।

উভয় ভূখণ্ডের মানুষই মুসলমান। তারা এক আল্লাহকে সেজদাহ করে, একই দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ পড়ে। তারা এমন নবীর উম্মত, যাঁর স্পষ্ট নির্দেশ মুসলমান ভাই ভাই, মুসলমানের রক্ত ও মান-মর্যাদা একে অপরের জন্য আমানত। কাজেই ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডের ফারাক ধর্মের মেলবন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না এমনটাই ভাবনা ছিল বাঙালিদের। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক তার উল্টোটা। একই ধর্মের মানুষ হিসেবে ভাই ভাই হয়ে বসবাস করার যে আশা বাঙালিরা করেছিল, তা উবে গেল অল্প ক’দিনেই।

পাকিস্তানের নেতারা অচিরেই ভুলে গেলেন আল্লাহ ও আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে প্রদত্ত ওয়াদার কথা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পদে পদে বঞ্চিত করা হয়। বাংলার দামাল ছেলেরা গর্জে ওঠে। শুরু হয় মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই। আর এই লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ থেকেই জ্বলে উঠে মুক্তিযুদ্ধের মশাল।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এ দেশের অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে। মা-বোনরা সম্ভ্রম হারিয়েছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। সেই অগণিত মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসলই হলো এই বিজয়।

আজ ১৯৭১ সালের সেই দিনটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখার জন্য। সেদিন সব ঘরবাড়ি, দালানকোঠার শীর্ষদেশে শোভা পাচ্ছিল স্বাধীন বাংলার রক্ত-রঙিন পতাকা।

এত কষ্টার্জিত বিজয়ের দিনে জাতি তাদের বিজয়ানন্দে আনন্দিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এ কথা আমাদের খুব ভালো করে স্মরণে রাখতে হবে।

মুসলমান হিসেবে আমাদের আইডল বা আদর্শ হলো বিশ্বমানবতার মূর্তপ্রতীক, মুক্তির দিশারি, সফল রাষ্ট্রনায়ক, মহান নেতা বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা যা কিছু করব, নবীজির আদর্শেই করব। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ।’ [সূরা আহজাব : ২১]

ইসলামের প্রাণপুরুষ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের সময় বারবার জন্মভূমি মক্কার দিকে অশ্রুভরা নয়নে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা যদি নির্যাতন করে আমাকে বের করে না দিত, কখনোই আমি তোমাকে ত্যাগ করতাম না। ’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজির চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তিনি বলতেন, এই ওহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। ’ [মুসলিম : ২/৯৯০]

পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না যারা পরাধীন থাকতে চায়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাই কতই না চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে। আর এই স্বাধীনতার জন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন। সবাইকে উপভোগ করতে দিয়েছিলেন বিজয়ের প্রকৃত আনন্দ।

বিজয় দিবস সম্পর্কে পবিত্র কুরানের দু’টি সূরা আমাদের সামনে ভেসে আসে। একটি সূরাতুল ‘ফাতাহ’ (বিজয়), আরেকটি সূরার নাম ‘আন-নাসর’ (মুক্তি ও সাহায্য)। বিজয়ের যে আনন্দ প্রকাশ তা আল্লাহর শুকরিয়া, আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করার মাধ্যমেই ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দেয়।
বিজয় উদযাপনে ইসলামের নির্দেশনা হলো-

বিজয় আল্লাহর দান: কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।’’ [সূরা ফাত্হ : ১]
বিজয়ের জন্য দরকার যোগ্যতা ও সৎকর্ম : কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আমার ভূমির অধিকারী হবে সৎকর্মশীল ও যোগ্য বান্দারা।’’ [সূরা আল আম্বিয়া : ১০৫]

বিজয়ীদের কাজ: কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘(তারা) যাদের আমি পৃথিবীতে বিজয়, সফলতা ও প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে এবং সৎকাজে আদেশ দান করে ও মন্দকাজে বাধা প্রদান করে। সকল কর্মের পরিণতি আল্লাহরই নিকটে।’’ [সূরা হজ : ৪১]
বিজয় লাভের পর আল্লাহর প্রশংসা করা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন; তিনিতো তওবা কবুলকারী।’’ [সূরা নাসর : ১-৩]

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিজয়ের চেতনাকে জাগ্রত করে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি যেমন অসংখ্য দাসকে নিজ খরচে মুক্ত করেছেন তেমনি সমগ্র বিশ্বকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়-এটি এক ঐতিহাসিক অর্জন। সেই অর্জনকে টেকসই মাত্রা দিতে প্রয়োজন দেশের সকল জনসাধারণের সক্রিয় কার্যক্রম।

সব নাগরিকের সম্মিলিত প্রয়াসেই জাতি হিসেবে আমরা আরও উন্নত, সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলতে পারব।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ