শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মুনাফা ও উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মাহমুদুল হাসান।।

পৃথিবীতে তিনটি মতবাদ আছে- পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্র ও ইসলাম। আমরা দেখব এসব মতবাদের কোনটি কতটুকু শ্রমিক অধিকার দিয়েছে। পুঁজিবাদের লক্ষ মুনাফা আর সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব।

বস্তুত মুনাফা ও উদ্বৃত্তমূল্য একই বস্তুর দুটি নাম, শুধু পরিভাষাগত পার্থক্য। যেমন একজন শ্রমিক কারখানায় এক মাস কাজ করে ৩০ হাজার টাকার মূল্য উৎপাদন করল। মালিক তাকে ১০ দিনের শ্রম মূল্য ১০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে বাকি ২০ দিনের শ্রম মূল্য ২০ হাজার টাকা নিয়ে গেল। এখন পুঁজিবাদের পরিভাষায় এই ২০ হাজার টাকা মুনাফা আর সমাজতন্ত্রের পরিভাষায় উদ্বৃত্ত মূল্য।

কারণ এটা শ্রমিকের বেতনের অতিরিক্ত মূল্য যা সে উৎপাদন করেছে কিন্তু মালিক আত্মসাৎ করেছে। এ বিষয়টা নিয়েই পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। সমাজতন্ত্র বলছে শ্রমিকের শ্রম মূল্য খাওয়ার তোমার কোন অধিকার নাই। পুঁজিবাদ বলছে ভুমি ভবন ও যন্ত্রপাতির সংস্থান করেছি আমি, তাছাড়া আগুন বন্যায় আমার খামার বা কারখানা ধ্বংস হয়ে গেলে শ্রমিক তার ক্ষতিপূরণ বহন করবে না। কাজেই বিনিয়োগ আমার ঝুঁকি আমার সুতরাং মুনাফাও আমার। সমাজতন্ত্র বলছে তোমার বিনিয়োগ ও ঝুঁকি কোনটারই দরকার নাই, উৎপাদন উপকরণ থাকবে জাতীয় মালিকানায় অর্থাৎ সরকারি। তখন সবাই নিজ নিজ সমর্থ্য অনুযায়ী শ্রম দিবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করবে।

তারপর এই উদ্বৃত্ত মূল্যের অবসান ঘটানোর জন্য সারা পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক তুফান বইয়ে দেয়া হয়। গত দেড়শ বছরে ২০০ কোটি মানুষ হত্যা করা হয়। তাছাড়া কত দেশ কত জনপদ কত জাতি উজার হয়ে গেছে, কত দুঃখ দুর্দশা লাঞ্ছনা বঞ্চনা পঙ্গুত্ব অসহায়ত্ব ও দুর্ভিক্ষের কারণ হয়েছে- এসবের পরিসংখ্যান কে দিতে পারে? অথচ ইসলাম যে ইনসাফপূর্ণ ও যুক্তি সঙ্গত শ্রমিক অধিকার দিয়েছে তা অনুসরণ করলে মানব জাতিকে এতটা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হতো না, সেইসাথে শ্রমিকের মৌলিক অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হত।

ইসলামে শ্রমিক অধিকার

একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয় বিধায় সংক্ষেপের জন্য মাত্র দুটি দলিল পেশ করা হলো। মাসরুর বিন সোয়াইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাবাযায় হযরত আবু যর গিফারির (রাঃ) সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তখন তিনি ও তার গোলাম এক জাতীয় পোশাক পরিহিত ছিলেন।

প্রভু-ভৃত্যের একই পোশাক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি একজনকে (বেলাল) কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান বলে লজ্জা দিয়েছিলাম। ঘটনা শুনে নবী করীম (সাঃ) আমাকে বললেন, হে আবু যর তোমার মধ্যে তো জাহেলিয়াতের স্বভাব রয়েছে। খাদেমরা তোমাদের ভাই- যাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। যার অধীনে তার কোন খাদেম ভাই থাকবে তাকে সে নিজে যা খাবে তাই খেতে দিবে সে নিজে যা পরবে তাই পরতে দিবে। তাদের উপর সাধ্যাতিত কাজের বুঝা চাপিয়ে দিও না, যদি কঠিন কাজ করাতেই হয় তাহলে নিজেরা তাদেরকে সাহায্য করবে (বুখারি)।

উক্ত হাদিস থেকে কয়েকটি মূলনীতি বেরিয়ে আসে।

১। শ্রমিক মালিক ভাই ভাইঃ ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক মালিক মর্যাদাগত কোন পার্থক্য নাই, তারা ভাই ভাই। রাসুল (সাঃ) বলেছেন নিজ হাতে উপার্জন করে খাওয়া সর্বোত্তম। অত্র হাদিসে শ্রমকে জীবিকার সর্বোত্তম পন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) ও আলী (রাঃ) অর্থের বিনিময়ে ইহুদির কাজ করে দিয়েছেন। বস্তুত শ্রম হলো একটা পণ্য। কাজেই অন্যান্য পণ্যের ন্যায় শ্রম-পণ্য বিক্রি করাও ইসলামের দৃষ্টিতে অসম্মানজনক নয়। এজন্যই শ্রমিক মালিকের মর্যাদা সমান।

২। শ্রমিক- মালিকের জীবনমান সমানঃ আগেকার যুগে বর্তমানের মতো শিল্প কারখানা ও শ্রমিক শ্রেণী ছিল না। তখন ঘর গৃহস্থালির প্রয়োজনে দাস বা কাজের লোক রাখা হতো। তখনকার কাজের লোকদের উপর ইসলাম যে বিধান দিয়েছে বর্তমান শিল্প শ্রমিকদের উপরও তা প্রযোজ্য হবে। বিভিন্ন হাদিসে রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন, তোমরা যা খাবে যা পরবে খাদেমদেরও তা খেতে পরতে দিবে।

এটা হল মূলনীতি- যার অর্থ হলো শ্রমিক মালিকের জীবনমান সমান থাকবে। এই সাম্যের অর্থ হলো মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সমান তবে গুণগত মানে পার্থক্য থাকতে পারে। যেমন মালিক উন্নত খানাপিনা, পোশাক ও সাত তলায় থাকবে কিন্তু শ্রমিক মানসম্পন্ন খাবার, শীত গ্রীষ্মের উপযোগী পোশাক ও বাসস্থান পাবে। মালিক বিদেশে চিকিৎসা করাবে, তার সন্তানকে বিদেশে পড়াবে কিন্তু শ্রমিক দেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর সুযোগ পাবে ও তার সন্তান দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। অর্থাৎ গুণগত মানে পার্থক্য থাকলেও শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে।

৩। কাজের সময় ও প্রকৃতিঃ শ্রমিকের উপর সাধ্যাতিত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এর অর্থ হলো শ্রমিকের জন্য ১৬ ঘন্টা শ্রম সময় হারাম। তেমনি ভাবে প্রকৃতিগতভাবে কোন কঠিন কাজ যা তার জন্য কষ্টকর হবে বা তার ক্ষতির কারণ হতে পারে- এমন কাজের ক্ষেত্রে মালিক নিজে হোক বা অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে হোক তাকে সাহায্য করতে হবে।

হযরত আবু হুরায়রা ((রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, তোমাদের কারো খাদেম যদি খাদ্য প্রস্তুত করে নিয়ে আসে তাহলে তাকে নিজের সঙ্গে খাওয়ায় শরীক কর। কারণ সে তোমার জন্যই আগুন ও ধোয়ার জ্বালা সহ্য করেছে। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সাঃ) বলেন, মজুর ও শ্রমিককে তার উৎপন্ন দ্রব্য হতেও অংশ দিবে। কারণ আল্লাহর মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যায় না।

উৎপন্ন খাদ্য ও পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্বঃ প্রথম হাদীস দ্বারা প্রমাণিত- শ্রমিক যদি খাদ্য তৈরি করে তবে তাকে খাদ্যে ভাগ দিতে হবে। দ্বিতীয় হাদীস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে- শ্রমিক যদি পণ্য উৎপাদন করে তবে সেই পণ্যে তাকে ভাগ দিতে হবে। এটা দান নয় শ্রমিকের হক্ব- প্রাপ্য। কারণ প্রাপ্য না হলে বঞ্চনা শব্দ ব্যবহার করা হতো না। তদুপরি শ্রমিককে আল্লাহর মজুর বলা হয়েছে মালিকের নয়।

কাজেই প্রত্যেক শিল্প কারখানায় বছর শেষে হিসাব করে শ্রমিকদের মুনাফার অংশ দেওয়া আবশ্যক। তার জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলিকে সোচ্চার হতে হবে। সেইসাথে আলেম সমাজ ও ইসলামপন্থীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এখন প্রশ্ন হল পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র কি শ্রমিক শ্রেণীর জন্য এর চেয়ে উত্তম ফয়সালা দিতে পেরেছে? কাজেই সবাইকে ইসলামিক শ্রম নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ