বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


দাম্পত্য জীবনে রাসুল সা. এর আচরণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| ইসরাত জাহান রাত্রি ||

‘পূর্ণতার উচ্চ আকাশে পৌঁছে আছে তিনি,
সৌন্দর্যের পূর্ণ প্রকাশে তিনি ছাড়া নাহি,
সকল সুন্দরের সমাহার আছে শুধু যে তাঁরি আখলাকে,
খোদার প্রিয় বন্ধু তিনি, বাদশাহ দু’জাহানের,
সালাম জানাই তারই রওজা মুবারকে।’

মদিনার বুকে ঘুমিয়ে আছে এক টুকরো নূর। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকেও মানুষটি প্রতিটি মুমিন হৃদয় জুড়ে আছে। নয়নের জলে যার বাস, সে তো রবে নয়নে নয়নে। প্রত্যক বিশ্বাসী মুমিনদের দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে সকাল সন্ধ্যা সাঝে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুনিয়াতে তোমরা যাদেরকে অনুসরণ করবে, ভালোবাসবে; কেয়ামতের দিন তোমরা তাদেরই দলভুক্ত হবে।’ -বুখারী ৩৬৮৮

রাসুলুল্লাহ সাঃ এর পুরোটাই জীবনই আদর্শে মোড়ানো।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন এ সূরা আল মায়িদার ১৫ নাম্বার আয়াতে বলেন, তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে নূর এসেছে এবং তা একটি স্পষ্ট কিতাব।

কোরআন সুন্নাহর যেসকল জায়গায় নূর শব্দ ব্যবহার করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে এর উদ্দেশ্য এই যে, তিনি ছিলেন মানব ও জিন জাতির জন্য হিদায়াতের আলোকবর্তিকা । আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে মোমবাতি/প্রদীপের সাথে তুলনা করেছেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহর কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদা এত বিশাল। তবে সেই ক্ষেত্রে তুলনাটাও তো বিশাল হতে পারতো! চাঁদের সাথে কিংবা সূর্যের সাথে কেন তুলনা করা হয়নি?

এই কারণে হয়নি, চাঁদের আলো যতই স্নিগ্ধ হোক। যতই সুষমা মন্ডিত হোক না কেন। সে তার জোছনা দিয়ে যতই মানুষকে আনন্দ দিক এই চাঁদ কিয়ামত পর্যন্ত যদি চেষ্টা চালায় নতুন আরেকটি চাঁদের জন্ম দিতে পারবে না। সূর্যের আলো যতই প্রখর হোক, সূর্যের আলো যতই তীব্র হোক, সূর্যের আলো এই পৃথিবীর মানুষের জন্য যতই কল্যাণকর হোক না কেন কিয়ামত পর্যন্ত এই সূর্য চেষ্টা চালিয়ে নতুন আরেকটি সূর্যের জন্ম দিতে কখনোই পারবে না। কিন্তু প্রদীপের সাথে তুলনা করা হলো, ছোট্ট একটা উদাহরন, ধরুন, আপনার এলাকায় কোনো আলো নেই। কিন্তু আপনার বাড়িতে একটা প্রদীপ টিপটিপ করে জ্বলছে। এখন আশেপাশে যাদের বাড়িতে আলো নেই তারা কেউ প্রদীপ/কুপি/মোমবাতি নিয়ে এসেছে আপনার এখান থেকে একটু আলো নিয়ে যেতে । সবাই নিল। এখন দেখুন আপনার মূল প্রদীপ থেকে আলো কী কিছুটা ফুরিয়ে গেছে? কমেছে? না। কেননা এ মূল প্রদীপ থেকে যদি সারাদেশে এমনকি সারা পৃথিবীতে একযোগে আলো দেয়া হয় তবুও মূল প্রদীপের আলো শেষ হয়ে যাবে না। এজন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চাঁদের সাথে, সূর্যের সাথে তুলনা করেন নাই। র্প্রদীপের সাথে তুলনা করেছেন। আর এই প্রদীপ হলো চাঁদের আলো, সূর্যের আলো নয়, বিদ্যুৎ এর আলো নয়, প্রদীপের আলো নয় এটা হলো জ্ঞানের আলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে যে জ্ঞান বের হবে এটাই সঠিক ও আসল জ্ঞান। এই জ্ঞান বিকিরণ হবে বিকশিত হবে। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে আর আসছে সমস্ত মানুষের জন্য সমভাবে।

আল্লাহ কাছে তিনি এতই মার্যাদা সম্পন্নমানুষ দুজাহানের বাদশা শ্রেষ্ঠ মানুষ। জনাবে মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবার ছিলো সংসার ছিলো।

রাসূল সাঃ এর দাম্পত্য জীবন 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পুরোটা জীবনই আদর্শে মোড়ানো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবদ্দশায় কোনো বর্ণনায় দশটি, ত্রয়োদশটি অধিকাংশ গ্রন্থ ১১টি বিয়ের কথা এসেছে। এর মাঝে ১ম হলো

মা খাদিজাতুল কোবরা রা.। তিনি বিধবা ছিলেন এবং সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং উনি বেঁচে থাকা কালীন রাসূল সাঃ দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করেননি মতান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল সন্তান মা খাদিজার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে।

সওদা বিনতে যাম‘আহ: ইনি প্রথম দিকে ইসলাম কবুল করেন। পরে তাঁর উৎসাহে স্বামী সাকরান বিন ‘আমর মুসলমান হন। অতঃপর উভয়ে হিজরত করেন। সাকরান সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন সন্তানদের নিয়ে তার বিধবা স্ত্রী সওদা চরম বিপাকে পড়েন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওদাকে বিয়ে করেন

আয়েশা বিনতে আবুবকর: আয়েশা রা. এর পিতা আবুবকর রা. ছিলেন একমাত্র ছাহাবী, যাঁর পরিবারে চারটি স্তরের সবাই মুসলমান ছিলেন। যা অন্য কোন ছাহাবীর মধ্যে পাওয়া যায় না’। ইনিই একমাত্র কুমারী স্ত্রী ছিলেন। কোন সন্তানাদি হয়নি। নবীপত্নীগণের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ও হাদীছজ্ঞ মহিলা। জ্যেষ্ঠ ছাহাবীগণ বিভিন্ন ফাৎওয়ায় তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেন ও তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমরা কোন বিষয়ে আটকে গেলে আয়েশা রা.-এর নিকটে গিয়ে তার সমাধান নিতাম (তিরমিযী হা/৩৮৮৩)।

হাফছাহ বিনতে ওমর : তাঁর পূর্ব স্বামী খুনায়েস বিন হুযাফাহ । বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। ওহোদে যখমী হয়ে মারা যান। পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হাফছার বিয়ে হয়।

উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়াহ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আপন ফুফাতো ভাই ও দুধভাই আবু সালামাহর স্ত্রী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। আবু সালামাহ বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক হন। ওহোদে যখমী হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে উম্মে সালামাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহিতা হন।

যয়নব বিনতে জাহশ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফুফাতো বোন ছিলেন। প্রথমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পোষ্যপুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর সাথে বিবাহ হয়। পরে যায়েদ তালাক দিলে আল্লাহর হুকুমে তিনি তাকে বিয়ে করেন প্রচলিত দু’টি কুসংস্কার দূর করার জন্য। এক- সে যুগে পোষ্যপুত্রকে নিজ পুত্র এবং তার স্ত্রীকে নিজ পুত্রবধু মনে করা হ’ত ও তার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ মনে করা হ’ত। দুই- ইহূদী ও নাছারাগণ ওযায়ের ও ঈসাকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করত (তওবা ৯/৩০)। অথচ সৃষ্টি কখনো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তান হ’তে পারে না। যেমন অপরের ঔরসজাত সন্তান কখনো নিজের সন্তান হতে পারে না।

জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ: উনি বনু মুছত্বালিক্ব নেতা হারেছ বিন আবু যাররাবের কন্যা ছিলেন। ৫ম হিজরীতে বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে বন্দী হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহিতা হন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শ্বশুরকুল হওয়ার সুবাদে একশ’-এর অধিক যুদ্ধবন্দীর সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। জুওয়াইরিয়ার প্রথম স্বামী ছিলেন মুসাফিহ বিন সুফিয়ান মুছতালিক্বী।

উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান: কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী তার প্রথম স্বামী ছিলেন। উভয়ে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বামী মারা যান। তিনি একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বিধবা হন।

ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব:খায়বর যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইসলাম কবুল করে রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহিতা হন। মদীনা থেকে বিতাড়িত ইহূদী বনী নাযীর গোত্রের সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব-এর কন্যা এবং অন্যতম সর্দার কেনানাহ বিন আবুল হুক্বাইক্ব-এর স্ত্রী ছিলেন। উভয়ে নিহত হন। পরে রাসূল সাঃকে বিয়ে করেন।

মায়মূনা বিনতুল হারেছ:ইনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. ও খালেদ বিন অলীদ রা. এর আপন খালা ছিলেন এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মার সহোদর বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন। যিনি ইতিপূর্বে ৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পূর্বের দুই স্বামী মারা গেলে ভগ্নিপতি হযরত আববাস রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে তার বিবাহের প্রস্তাব দেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উত্তম। আর আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম প্রতিবেশী সে, যে তার প্রতিবেশীর কাছে উত্তম।’ -তিরমিজি : ১৯৪৪

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাম্পত্য জীবনের জানা অজানা কিছু কথা

মহান আল্লাহ রাসূল সাঃ এর চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ৬৮ নং সূরা আল - ক্বলমে ৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ওয়া ইন্নাকা লা‘আলা-খুলুকিন ‘আজীম। অর্থ: "হে নবী! নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত। "

এদিকে মা খাদিজা কী সার্টিফিকেট দিচ্ছে দেখুন!
স্ত্রী তো স্বামীর প্রতি ভালবাসা, তার জীবন যৌবন সবটুকু উজাড় করে দিতে পারেন কিন্তু ঈমান আনা কী এত সহজ বিষয়?বাপ দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করে! অথচ, মা খাদিজা রাঃ যখন আল্লাহ নবী সাঃ এর পক্ষ থেকে দ্বীনের দাওয়াত পেয়েছিলেন, তাওহীদ এর দাওয়াত পেয়েছিলেন। তিনি একটা মুহুর্ত দেরী করেন নাই,এক সেকেন্ডও ভাবেন নি, কোনো প্রশ্ন করেননি সঙ্গে সঙ্গে তিনি দাওয়াত কবুল করে পড়েন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। "মা খাদিজা রা. বলেন, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহ নবী বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই।’

কেননা একজন স্ত্রী ভালো জানেন তার স্বামী কেমন। তার ভিতর এবং বাহির একজন স্ত্রীর কাছে আয়নার মতো পরিষ্কার।

দ্বীনের এই দ্বায়াতি কাজে রাসূল সাঃ এর কাছে মা খাদিজা রা. তাঁর ধন সম্পদ সবটুকু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর যখন ওহি নাজিল হতো, নিরিবিলি জাবালে নূর পাহাড়ে থাকতেন দুইদিন তিনদিন পার হয়ে যেতো বাড়ি আসতেন না নবীজীর মহব্বতে মা খাদিজা একটু পানি, একটু খাবার ঐ পাহাড়ের চুড়ায় যেয়ে উঠতেন। কত মহব্বত। নবীজী যখন মা খাদিজা রাঃ কে বিয়ে করেন ৪০ বছর বয়সী একজন বিধবা নারী অথচ রাসূল সাঃ ছিলেন ২৫ বছরে যুবক। অথচ এতটাই মহব্বত ছিলো যে মা খাদিজা বেঁচে থাকা কালীন তিনি ২য় কোনো বিয়ে করেন নাই। প্রয়োজন হয় নাই। শুধু মা খাদিজা নয়। মা খাদিজার মৃত্যুর পর রাসূল সাঃ যতগুলো বিয়ে করেছেন সবাইকে রাসূল সাঃ সমভাবে সম্মান, মর্যাদা, মহব্বত করেছেন।

মা আয়েশা রা. পাত্রের যে দিক থেকে পান করতেন উনিও সেখান থেকে পান করতেন। আয়েশা রা. হাড্ডির যে স্থান থেকে কামড় দিয়ে খেতেন, উনি সেই স্থানেই কামড় দিয়ে খেতেন।

স্ত্রীদের আদর করে ছোট ছোট নামে ডাকতেন তিনি। কখনো ভালোবেসে আলাদা একটা নামই দিয়ে দিতেন। আয়েশা রা.কে আদর করে ডাকতেন ‘হুমাইয়ারা' নামে। আয়েশা রা কখনোই মা হতে পারেননি। তাই যখন তার বোন একটি ছেলে জন্ম দিয়েছিলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ছেলেটার নাম হবে ‘আব্দুল্লাহ’। আর আজ থেকে তুমি হচ্ছো ‘উম্মে আব্দুল্লাহ’ (আব্দুল্লাহর মা)। অনেকেই তাদের স্ত্রীকে আদর করে ‘ময়না-পাখি’, ‘জানু’- এসব নামে ডেকে থাকেন। তারা হয়তো জানেনও না যে, নিজের অজান্তেই তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি সুন্নাহ অনুসরণ করছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন একজন দায়িত্ববান স্বামী

সাফিয়া রা. ছিলেন খাটো গড়নের। তাই যখন তিনি বাহনে আরোহণ করতেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ঢেকে দিতেন। তারপর হাঁটু বিছিয়ে দিতেন। সাফিয়া রা. সেই হাঁটুতে পা দিয়ে বাহনে আরোহণ করতেন। প্রত্যেক স্ত্রীই তাঁর কাছে ছিলেন রাণীর মতো। একজন রাণী রাজার কাছ থেকে যতোটা মর্যাদা পান, তাঁর স্ত্রীরা তার চেয়েও বেশি সম্মান পেতেন।

প্রিয়তমাদের অনুভূতির দিকেও রাসূল সাঃ সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। নিজের জীবনে দুঃখ-কষ্টের কোন শেষ ছিল না, তবুও স্ত্রীদের কোনো কষ্ট নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নজর এড়াতো না।

বিদায় হজ্জের সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে আয়েশা রা. কাঁদছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আয়েশা রা-এর মাসিকের সময় শুরু হয়েছে। তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “সকল নারীদের জন্যই আল্লাহ্ এটা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। হজ্জ করতে যা করা প্রয়োজন তুমি তার সবই করো, শুধু তাওয়াফটা করো না।”

অনেক স্বামীই স্ত্রীদের মাসিক শুরু হলে তাদের, থেকে দূরে দূরে থাকেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোটেও এমন করতেন না। আয়েশা রাঃ-এর মাসিকের সময়েও তিনি তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন। সে অবস্থাতেই তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চুল আঁচড়ে দিতেন। একরাতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরতে মায়মুনা রা.-এর সাথে একই চাদরের নিচে শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ মায়মুনা রা.-এর মাসিক শুরু হলে তিনি দ্রুত উঠে পড়েন যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র দেহে রক্ত না লাগে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব বুঝতে পেরে তাঁকে ডেকে কাছে নিয়ে আসেন। দুজন আবার একই চাদরের নিচে শুয়ে থাকেন। স্ত্রীরা অসুস্থ হলে তিনি নিজে তাঁদের রুকিয়া করে দিতেন। জীবনসঙ্গিনীদের কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কষ্ট দিতেন না। তিনি স্ত্রীদের সর্বোচ্চ শালীনতা দেখিয়েন, তিনি ছিলেন ন্যায়ও ইনসাফকারী।

ইসলাম গ্রহণের পর হযরত সাফিয়া রা.কে কেউ ইহুদির কন্যা বলে কটাক্ষ করলে তিনি খুব কষ্ট পেতেন। একদিন নবীজি সাঃ ঘরে এসে দেখলেন সাফিয়া রা. কাঁদছেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, আয়শা রা. ও যয়নব রা. বলে থাকেন, আমরা সকল স্ত্রীর মধ্যে উত্তম। কেননা আমার নবীর স্ত্রী হওয়া ছাড়াও তার আত্মীয়ও। কিন্ত তুমিতো ইহুদী কন্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফিয়া রা.কে খুশি করার জন্য সান্ত্বনা দিয়ে বললেন : যদি আয়েশা রা. ও যয়নব রা. এই কথাই বলে থাকে যে, তাদের বংশের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বংশের সম্পর্ক রয়েছে তাহলে তুমি তাদেরকে কেন বলোনি যে, “তুমি একজন নবীর (হারুন আ.) কন্যা, একজন নবী (মূসা আ.) তোমার চাচা, আরেক জন নবী তোমার স্বামী। তাহলে কীভাবে তারা তোমার থেকে উত্তম হয়?

এক বর্ণায় পাওয়া যায়,একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে সকল স্ত্রীরা জানতে চাইলেন তিনি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালো ভালবাসে রাসূল সা. বললেন, রাতে তোমাদের কাছে আমি যাকে যেটা দিবো গোপন রেখে সকালে সবাই একসাথে জমা দিবে। তখন বলবো কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। রাতে সবার ঘরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি করে খেঁজুর দিলেন। সকালে সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট জমা দিতে আসলে সবাই দেখে সবার হাতেই একটা জিনিস,১টি খেঁজুর। তখন কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না।

স্ত্রীদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যয়

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল। এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ (স্ত্রীদের জন্য) ব্যয় করে। সে মতে (বিনিময়ে) নেককার স্ত্রীরা হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে।

বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী (স্ত্রীর জন্য) ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিজিকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, তদপেক্ষা বেশী ব্যয় করার আদেশ কাউকে করেন না। আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।' (সুরা তালাক : আয়াত ৭)

সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাঃ বলেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তুমি যে কোনো ব্যয় করবে তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে। এমনকি খাবারের যে লুকমাটি স্ত্রীর মুখে উঠিয়ে দিবে তার প্রতিদানও।

তিনি আরো বলেন, ‘সর্বোচ্চ অর্থ তাই, যা ব্যাক্তি তার পরিবারের জন্য ব্যয় করে খরচ করে।’- সহিহ মুসলিম

উম্মাহাতুল মু'মিনদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ উম্মুল মু'মিনদের উদ্দেশ্য করে কোরআনে কারীমে ৩৩ নং সূরা আল-আযহাব এর ২৮ ও ২৯ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে নাবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে বলঃ তোমরা যদি পার্থিব জীবন এবং ওর ভুষণ কামনা কর তাহলে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদেরকে বিদায় দিই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখিরাত কামনা কর তাহলে তোমাদের মধ্যে যারা সৎ কর্মশীল আল্লাহ তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।

তাফসির ইবনে কাসির এর দুই আয়াতের বর্ণনা করা হয়েছে এমন, মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাঃ কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন তার সহধর্মীদেরকে দুটো জিনিসের একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। যদি তারা পার্থিব জীবনের সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য, সুন্দর্য ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন পছন্দ করেন তাহলে তিনি যেন তাদেরকে বিবাহ সম্পর্ক হতে বিচ্ছিন্ন করে দেন আর তারা যদি দুনিয়ার অভাব অনটনে ধৈর্য্য ধারণ করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি এবং আখিরাতে সুখ- শান্তুি কামনা করে তাহলে তাঁরা যেন রাসূল সাঃ এর সাথে ধৈর্য্য ধারণ করে জীবন অতিবাহিত করেন। তারা সবাই যেন আল্লাহ ও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এবং আখিরাতকেই পছন্দ করে নেন। ফলে মহান আল্লাহ সবার উপরই খুশি হন অতঃপর তিনি তাদেরকে আখিরাতের সাথে সাথে দুনিয়াতেও আনন্দ সুখ- শান্তি দান করেন।

এ দুইটা আয়াত দুনিয়াবী উদ্দেশ্য একটা মেসেজ দিচ্ছে। ধরুন,আপনার স্বামীর স্বল্প আয়।এতে আপনার ভোগ বিলাসিতা সম্ভব না, এখন তারবওপর জুলুম করে হারামে দিকে এগিয়ে দেন তবে আপনি পার্থিব জীবনটাই উপভোগ করতে পারবেন আখিরাতে সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য নয়। আর আপনি যদি ধৈর্য্য ধারণ করে সৎ কর্মশীল হোন তবে মহান আল্লাহ আপনার জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। আল্লাহ সবটাই বলে দিয়েছেন। এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনার বিবেকের ওপর আপনি কোন পথে পরিচালিত হবেন।

সূরা আল - আযহাবে ৩২ এবং ৩৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ উম্মুল মু' মিনদের উদ্দেশ্য বলেন, হে নাবীর পত্নীরা! তোমরা অন্য নারীদের মত নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তাহলে পর-পুরুষের সাথে কোমল কন্ঠে এমনভাবে কথা বলনা যাতে অন্তরে যার ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায় সঙ্গত কথা বলবে। এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবেনা। তোমরা সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে; হে নাবীর পরিবার! আল্লাহ শুধু চান তোমাদের হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র করতে।

এখানেও আমাদের জন্য একটা মেসেজ এই যে, ‘যারা মাহরাম নয় তাদের সাথে মৃদু মোলায়েম কন্ঠে কথা বলা যাবে না। যাতে যাদের মনে ব্যাধি রয়েছে তাতে তাদের মনে ব্যাধি আরো বৃদ্ধি পায়। আর ২য় ধাপের আয়াতটা স্পষ্ট জাহেলিয়াত যুগের মতো যেন নিজেদেরকে প্রদর্শনী না করি। কেননা জাহেলিয়াত যুগের নারীরা পুরুষদের সামনে অবাদে চলাফিরা করতো কোনো তোয়াক্কা না করেই। তারা যখন ঘর থেকে বের হতো, বেপর্দা, লজ্জাহীনভাবে, বেপরোয়া চলাফিরা করতো। আল্লাহ তায়ালা এমন চলাফিরাকে নিষেধ করেছেন। আদেশ করেছেন সলাত কায়েম করা,যাকাত প্রদান করার এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাঃ এর আনুগত্য করার।।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উম্মাহাতুল মু'মিনীনদের পুরোটা জীবনই আদর্শ। দেখুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীরা কতটা ধৈর্য্যশীল ছিলেন। ছিলোনা তাদের বিলাসী জীবন যাপন।

আজকে সমাজে পরকীয়া, বেহায়া পনার ছড়াছড়ি। কেননা বিবাহকে আমরা কঠিন করে ফেলেছি। প্রাপ্ত বয়স্ক হলে সন্তানের বিয়ের কথা চিন্তা করিনা, তারা ফ্রী মিক্সিং এ মিশে যাচ্ছে এমনকি যারা বিবাহিত খোঁজ নিলে দেখা যা গোপনে গোপনে কত পরকীয়া চলছে। লিভটুগেদার চলছে। কোরআন বলছে একজন ব্যাক্তির স্বামর্থ্য থাকলে ইনসাফ করতে পারলে সে চাইলে একাধিক বিয়ে করতে পারে। আজকে আমরা নারীরা স্বামীর ২য় বিয়েই মানতে পারিনা অথচ রাসূল সাঃ এর একাধিক স্ত্রী ছিলো।

বোন! ধরুন আপনার স্বামী পুনরায় বিবাহ করতে চাচ্ছে তার সামর্থ্য অনুযায়ী। আপনি কী করবেন। আমি বলবো, আপনার সংসারী জীবনে যদি ত্রুটি থাকে বা নাই থাকে তবুও আপনি উত্তম ধৈর্য্য ধারণ করুন। আপনার স্বামী সামর্থ্য অনুয়ায়ী বিবাহ করতে চাচ্ছে আপনি যদি তাতে কড়া বাঁধা প্রদান করেন চার্টার করে তবে আপনি জেনে রাখুন আপনি আল্লাহর বিধানের সাথে নিয়মিত যুদ্ধ করছেন। আল্লাহর বিধানের সাথে কী যুদ্ধ করা যায়? এখন তিনি যদি বিয়ে না করে স্বাভাবিক ভাবে সংসার চালিয়ে আপনি তো দেখছেন সংসার সুখে চলছে কিন্তু তিনি যদি পরকীয়া, ব্যভিচারে লিপ্ত থাকে তাহলে বোন আপনানিও এ মহা অন্যায় গুনাহকে আপনিও ভয় করুন কেননা আপনার স্বামী পাশাপাশি কাল কিয়ামতে আপনাকেও জবাব দিহি করতে হবে। অবিবাহিতদের থেকে বিবাহিতদের শান্তি অনেক বেশি।

আপনি ধৈর্য্য ধারণ করুন। আল্লাহ যেদিন প্রতিদান দিবেন সেদিন শুকরিয়া আদায় করেও কুল পাবেন না আলহামদুলিল্লাহ
সেদিন মনের অজান্তেই বলে ফেলবেন আমি আমার রবকে ডেকে কখনোই ব্যর্থ হইনি।

আল্লাহ আমাদের প্রতিটি মানুষের চোখ, মুখ ও অন্তর হেফাজতের তৌফিক দান করুন কেননা এই তিনটা জিনিস হেফাজতে করা বড়ই কঠিন কাজ। আমাদের দাম্পত্য জীবন সুখ শান্তি দান করুক, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, উম্মাহাতুল মু' মিনীনদের জীবনী শুধু জানা নয়, তদানুরূপ জীবন পরিচালনা করার তৌফিক আল্লাহ দান করুক। আমাদের জীবনে গুনাহ গুলো আল্লাহ মাফ করুক। আমিন।

লেখিকা: শিক্ষার্থী, গুরুদয়াল সরকারী কলেজ, কিশোরগঞ্জ।

কেএল/

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ