শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


শক্তিশালী মুমিন কারা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানী
ভাষান্তর: মাওলানা তাওহীদ আদনান কাসেমী নদভী

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ. দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে কল্যাণ সকলের মাঝেই বিদ্যমান। (সহীহ মুসলিম: ২৬৬৪)

সাধারণত আমাদের সমাজে শক্তি, বল বা জোর শব্দটি উল্লেখ করলে সকলেই উদ্দেশ্য নেয় দৈহিক শক্তি, বল বা জোর। তবে বাস্তবে এই শব্দগুলো নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, এতে অনেক ব্যাপকতা বিদ্যমান। মানুষের বিবিধ অবস্থা এই বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে পারে।

যেমন, মানুষের চরিত্রিকতা ও নৈতিকতারও একটা শক্তি বা জোর থাকে। ফলে কখনও কখনও নৈতিকতা এবং চরিত্রিকতার শক্তির মাধ্যমে এমন দুঃসাধ্য কাজ করা সম্ভব, যা হাত-পায়ের জোরে কখনো সম্ভব না। দৈহিক শক্তি দিয়ে সহায়-সম্পত্তি জয় করা যায়; কিন্তু নৈতিক শক্তির জোরে জয় করা যায় মানুষের মন।

অনুরূপভাবে ধন-সম্পদেরও একটা শক্তি আছে। শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষও ধন-সম্পদ দিয়ে বড় বড় যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে। রাজনৈতিক শক্তিও একটি কার্যকর শক্তি। রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও জাতি দেশ ও জাতির নিয়ন্ত্রক হয়।

শক্তি জ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা ও কলমেরও হয়। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যদি সে পাতলা গড়নের লোকও হয়; ভালো ব্যবহারে একজন অজ্ঞ ব্যক্তির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম। এটাই সবচেয়ে বড় শক্তি। একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি হাজার হাজার অশিক্ষিত মানুষের চেয়েও মূল্যবান।

জ্ঞান-শিল্পে পরিপূর্ণ একটি জাতি যদি সংখ্যালঘুও হয় তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হাজার গুণ বেশি কিন্তু জ্ঞান ও শিল্পে শূন্য এমন জাতির তুলনায় তারাই শ্রেষ্ঠ। পৃথিবীজুড়ে বহু উদাহরণ রয়েছে এর। চর্ম চোখে তাদের কত কৃতিত্ব দেখা যায়! ইতিহাসের চোখে তাদের কত মহিমা পড়া যায়!

এইতো সেদিনের কথা, আমরা যেনো ব্রিটিশদের ক্রীতদাস ছিলাম। সর্বপ্রথম যে কয়জন ইংরেজ ব্রিটেন থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল, ভারতের আদি বাসিন্দাদের তুলনায় তাদের সংখ্যা এতই কম ছিল যে, তাদেরকে যদি খামিরা গোলানো আটায় পরিমাণ মতো দেওয়া লবণের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে লবণের পরিমাণটাই বেশি হবে তাদের চেয়ে। কিন্তু এটা ছিল এমন এক সময়, যখন ব্রিটিশ শক্তির সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র ঝলমল করছিল।

কথিত আছে, ইংরেজ শাসিত রাজ্যে কখনো সূর্যাস্ত হতো না। তাদের শাসিত পশ্চিমের রাজ্যে সূর্যাস্ত হতে না হতেই পূর্বের রাজ্যে সূর্যোদয় হয়ে যেতো। পশ্চিমা দেশ আমেরিকা ও লন্ডনে যেমন রাজত্ব চালিয়েছে, পূর্বে সুদূর প্রাচ্যের দেশগুলোও তাদের দাসত্বের ছায়াতলে বসবাস করেছে।

অথচ ব্রিটেনের অধিবাসীরা শুধু সংখ্যার দিক দিয়েই নগণ্য ছিল না; বরং, মূল ব্রিটেনের আদি রাজ্যের আয়তন এতই সীমিত ছিল যে, ভারতের ক্ষুদ্রতম প্রদেশও তার আয়তনে বিস্তৃত।

আমার যখন ব্রিটেন সফরের সুযোগ হয়েছিল, আমি জানতে পারলাম, ব্রিটেনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব কেবল ৬০০ মাইল বা তারচেয়ে একটু বেশি। তাহলে তারা যে এত বিস্তৃত অঞ্চল শাসন করে গেলো, সেটা কোন শক্তিবলে করতে পেরেছিল? এটি পেশিশক্তি বা সংখ্যাগরিষ্ঠশক্তির ফলাফল ছিল না, বরং এটি ছিল তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং প্রযুক্তিগত শক্তির ফলাফল।

জাপানের কথাই বলা যাক, ছোট্ট থেকে ছোট্ট কয়েকটি অঞ্চল সম্বলিত একটি দেশ, কিন্তু এর প্রযুক্তিগত শক্তির মোহনীয়তার সামনে পুরো বিশ্ব একবাক্যে মাথা নত করতে বাধ্য। একই পণ্য যদি জাপানে তৈরি হয় এবং অন্য দেশেও তৈরি হয়, তবে ক্রেতা বিস্তারিত না জেনেও সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে, জাপানে তৈরি পণ্যটি ব্যয়বহুল হলেও মানগত দিক থেকে এটাই ভালো। একেই বলে জ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তির প্রভাব।

এই পটভূমিতে যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে মুমিনের শক্তির অর্থ অনেক বিস্তৃত। আর এ বিস্তৃতির মধ্যে এ সত্যটিও অন্তর্ভুক্ত যে, একজন মুমিন, যে জ্ঞানের শক্তিতে বলিয়ান এবং শিক্ষিত, সে এমন একজন মুসলমানের চেয়ে উত্তম, যে অজ্ঞ এবং জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত।

সম্ভবত এই বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إن اﷲ یحب المؤمن المحترف আল্লাহ পাক প্রকৌশলী মুমিনকে ভালবাসেন। (আল-মুজামুল আওসাত: ৮৯৩৪)

কারণ, যে জাতি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী, যে জাতি শিল্প ও প্রযুক্তি বিদ্যায় পারদর্শী, যে জাতি হালাল সম্পদের মালিক, তাদের অন্যকে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। তারা অন্যকে দেয়, নেয় না। তাদের নেওয়ার হাত নেই; বরং তারা দেওয়ার হাতের মালিক। বিশ্বজগত তাদের প্রতি মুখাপেক্ষী। তারা নিজ যোগ্যতা ও সামর্থ্যে উন্নীত হয়।

ইহুদীদের কথাই বলা যাক। তাদের সংখ্যা কত? আমেরিকার মতো দেশে তাদের সংখ্যা মাত্র ৫% পাঁচ শতাংশেরও কম; কিন্তু গণমাধ্যমের মতো একটি কার্যকর সংস্থা সম্পূর্ণভাবে তাদের হাতে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ১০০% শতভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাই একজন আমেরিকান রাষ্ট্রপতির জন্যও স্পষ্টভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার বা তাদের সমালোচনা করার অবকাশ নেই। পূর্বে যারা সমালোচনা করেছে, তাদেরকে নাকানী-চুবানী খাইয়ে ছেড়েছে ইহুদিরা। এ সবই শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতির মহিমা। আর সেজন্যই আমরা দেখি যে, নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ইহুদি।

ভারতের ব্রাহ্মণদের কথা ধরা যাক। তাদের সংখ্যা ৩-৪% তিন-চার শতাংশের বেশি নয়; কিন্তু কার্যত সমগ্র দেশের ক্ষমতা তাদের হাতে। তারাই রাজনৈতিক নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবং দেশের স্বরাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে। এটা তাদের শিক্ষাগত প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল। আর এরই প্রভাবে দেশের ৬০% ষাট শতাংশেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে ব্রাহ্মণ বা ভারতের উচ্চ বর্ণের লোকেরা অধিষ্ঠিত।

তাই আমাদের মুসলিমদের এমন একটি জাতি হওয়া উচিত, যারা হবে জ্ঞানের রত্ন দ্বারা সজ্জিত এবং শিল্প ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় সমৃদ্ধ। যাতে আমাদের হাত উঁচু থাকে। আমরা দেশকে কিছু দেওয়ার যোগ্য হতে পারি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الید العلیا خیر من الید السفلٰی নিচু হাতের চেয়ে উঁচু হাত উত্তম। (বুখারী: ১৬৭২)

যে জাতি মানুষকে দান করে, তারা সে জাতি থেকে উত্তম, যারা কেবল গ্রহণ করে। যে জাতি মানুষকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তারা এমন একটি জাতি থেকে উত্তম, যার হাতে একটি ভাঙ্গা থাল নিয়ে অন্যের কাছে ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, চাকরি-বাকরি, অর্থ-পুঁজি এবং রাজনৈতিক সাহায্য সহযোগিতার ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ায়।

কুরআনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, قُلْ ھَلْ یَسْتَوِیْ الَّذِیْنَ یَعْلَمُوْنَ وَالَّذِیْنَ لَا یَعْلَمُوْنَ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُوْلُوْا الْاَ لْبَابِ. হে নবী! আপনি বলে দিন, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি এক সমান? নিশ্চয় জ্ঞানীরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা ঝুমার:০৯)

এই আয়াতটি একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ। তবে এতে দুটি বিষয়ের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। একটি হলো জ্ঞানী ও শিক্ষিত এবং অজ্ঞ ও অশিক্ষিত এক সমান নয়। অন্যটি হলো সময় ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে কেবল যাদের জ্ঞান ও বোধ আছে এবং যারা ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বোধগম্যতা ও দূরর্দৃষ্টি অর্জন করেছে যথাযথভাবে।

জ্ঞানবান এবং অজ্ঞদের মধ্যে এই ব্যবধান শুধু পরকালেই দেখা দেবে না; বরং বিশ্বময় এর উদাহরণ রাত-দিন আমাদের সামনে একের পর আসতেছেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটি শিক্ষিত জাতি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে যতটুকু প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করতে সক্ষম, একটি অজ্ঞজাতি কখনো তা পারবে না।

প্রজ্ঞাবান একটি জাতি যুদ্ধক্ষেত্রে অজ্ঞ জাতিকে সহজেই পরাজিত করতে পারে। অর্থনীতিতেও অজ্ঞ জাতির বিপরীতে প্রজ্ঞাবান জাতি যথাযথ উন্নতি সাধন করতে সক্ষম। শিক্ষিত জাতি সহজেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম। তার প্রতিটি মতামত বিবেচনায় রাখা হয়। তার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম কথাও আমলে নেওয়া হয়। আর অশিক্ষিত জাতি জুলুমের শিকার হয়ে চিৎকার করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে। তথাপি কারো চোখে অশ্রু গড়ায় না। কারো আওয়াজ তাদের পক্ষে বলিষ্ঠ হয় না।

তাই অত্যুক্তি হবে না যদি বলা হয় যে, অজ্ঞতার বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষ ধর্মের দিক দিয়েই কেবল জ্ঞানী মানুষের অসমক্ষ নয়; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে থাকে। তারা শোষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় তাদের অপমানের কাহিনী... সূত্র: আল হেলাল মিডিয়া ইন্ডিয়া

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ