শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


চড়ামূল্যের বাজারে জীবন ধারণে ইসলামের নির্দেশনা কী?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| আবু সাঈদ ||

বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের দাম ঊর্ধ্বমূখী। হু হু করে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। তাই সবাইকে হিসাব কষে চলতে হচ্ছে। প্রাধান্য দিতে হচ্ছে ‘অধিক প্রয়োজন’কে। সংকটকালীন এ মূহুর্ত যাপনে ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ। ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, পরামর্শগুলো ব্যক্তি জীবনে আমলে নিলে তুলনামূলক সহজ প্রক্রিয়ায় সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

নারায়ণগেঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া আনওয়ারুল উলূম হাজী সাইজউদ্দিন এর সিনিয়র মুফতি শায়খ ইলিয়াছ খান আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘দেশ এখন সংকটময় মূহুর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের বিলাসী ব্যয় কমাতে হবে। খাদ্য ছাড়া অন্যান্য খাতের ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। অপচয় ছেড়ে মিতব্যয়ী হতে হবে।’

স্বদেশীয় পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দিয়ে উদীয়মান এ ইসলামী অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ডলার সঙ্কটের কারণে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানী করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেজন্য আমরা নিত্যপ্রয়োজনে দেশীয় পণ্যে চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করা উচিৎ।’

‘প্রত্যেকেই নিজ অবস্থান থেকে কিছু উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। শহুরে মানুষজনের পক্ষে ছাদকৃষির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব। গ্রামের মানুষজনও নিজেদের সুবিধামত স্থানে করতে পারে কিছু উৎপাদন। এতে নিজেদের ব্যয় কিছুটা হলেও কমে আসবে।’ সঙ্কটময় মূহুর্তে আর্থিক ব্যয় সংকোচনে এমন সামান্য চাষাবাদও ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শায়খ ইলিয়াছ খান বলেন, ‘এ সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের উদার ও আন্তরিক আচরণ করা উচিৎ। পণ্যের দাম চড়াভাবে না হাঁকিয়ে সাধ্যের মধ্যে রাখা উচিৎ। এতে একদিকে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জিত হবে। অপরদিকে সংকটময় মূহুর্তে অপর ভাইকে সহযোগিতা করার সাওয়াব পাওয়া যাবে।’

বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতির পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান আইএফএ কনসালটেন্সি লি. এর রিসার্চার এ্যান্ড কনসালটেন্ট ও রাজধানীর প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামীর সিনিয়র শিক্ষক মুফতি ফাহিম ফয়সাল আল মাসউদ বলেন, ‘এ সঙ্কটময় মূহুর্তে আমাদের শরীয়াহ বর্ণিত ‘হাজাহ নীতি’ অবলম্বন করে চলতে হবে।’

‘হাজাহ নীতি’ ব্যাখ্যা করে মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামীর সিনিয়র শিক্ষক মুফতি ফাহিম ফয়সাল আল মাসউদ বলেন, ‘হাজাহ নীতি’ ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। ইসলাম অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মানবিক চাহিদাকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছে।

প্রথম হলো এমন চাহিদা, যা পূরণ না হলে ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হবে বা এর কাছাকাছি অবস্থায় নিপতিত হবে। দ্বিতীয় হলো এমন চাহিদা, যা পূরণ না হলে ব্যক্তি বড় ধরনের সংকটে নিপতিত হবে। তৃতীয় হলো এমন চাহিদা, যা ব্যক্তি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রয়োজন মনে করে। চতুর্থ হলো এমন চাহিদা, যা ব্যক্তি বিলাসিতাবশত কামনা করে। পঞ্চম হলো এমন চাহিাদ, যা ব্যক্তিকে হালাল-হারাম ছাপিয়ে অর্থোপর্জনে প্রলুব্ধ করে। মানবিক চাহিদার এই শ্রেণী বিন্যাস ইসলামী অর্থনীতিতে ‘হাজাহ নীতি’ নামে পরিচিত।’

বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতির পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান আইএফএ কনসালটেন্সি লি. এর এ রিসার্চার এ্যান্ড শরীয়াহ কনসালটেন্স বলেন, ইসলাম প্রথম স্তরের প্রয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তা পূরণের পর সামর্থ থাকলে দ্বিতীয় স্তরে মনোযোগ দিতে বলে। অতপর পর্যায়ক্রমে তৃতীয় স্তর ও চতুর্থ স্তরে যেতে বলে। তবে পঞ্চম স্তরকে ইসলাম অনুমোদন করে না।’ অতপর মুফতি ফাহিম ফয়সাল আল মাসউদ বলেন, আমরা যদি যাপিত সময়ে ইসলাম প্রদর্শিত এই ‘হাজাহ নীতি’ মেনে চলি, এবং অপচয় ছেড়ে মিতব্যয়ী হই, তবে সঙ্কটময় এ মূহুর্তেও নিজেদেরকে সামলিয়ে নেওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।

কথা হয় রাজধানীর প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা দারুল উলূম আজমপুর এর সিনিয়র শিক্ষক মুফতি ফাহাদ হাসানের সাথে। তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ী মহল একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য পণ্যেরও দাম বাড়িয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সঙ্কটময় এ মূহুর্তে আমাদেরকে আন্তরিকতা ও উদারতা প্রদর্শন করতে হবে। যতদূর সম্ভব, পণ্যের মূল্য কম রাখতে হবে।’

পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেট প্রবণতায় অনুৎসাহিত করে মুফতি ফাহাদ হাসান বলেন, ‘দেশের এই সংকটময় মূহুর্তেও কোন কোন মহল সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করার জন্য পণ্যদ্রব্য সিন্ডিকেট করে রাখে। অথচ মানুষকে সঙ্কটে ফেলে পণ্য সিন্ডিকেট করা মারাত্মক কবিরা গুনাহ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই জাতীয় ব্যবসায়ীদের অনেক নিন্দা করেছেন। সেজন্য ব্যবসায়ী মহলকে সিন্ডিকেটের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে জনবান্ধব উদার ও আন্তরিক ব্যবসায়ী সমাজ।’

প্রয়োজনে রাষ্ট্রপ্রধানকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে মত দিয়ে দারুল উলূম আজমপুল মাদ্রাসার সিনিয়র এ শিক্ষক বলেন, ‘প্রয়োজনে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে বাজার মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। যেন অযথা দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি না পায়। ক্ষেত্র বিশেষ পণ্যের দামও নির্ধারিত করে দিতে পারেন।’

ডলারের মুদ্রাস্ফীতির কারণে আমদানী নির্ভর অনেক দেশকেই নিজেদের কারেন্সির অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে সে সাথে যুক্ত হয়েছে ডলার রিজার্ভ সঙ্কট। এতে এমনিতেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মূল্য অনাকাঙ্খিত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সে সাথে পালে হাওয়া দেয় বাঙালী ব্যবসায়ীদের অসুস্থ মানসিকতা-একটি পণ্যের মূল্য বাড়লে অন্য পণ্যেরও মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া এবং সিন্ডিকেটের মন্দ প্রবণতা। অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ইসলামী অর্থনীতি ব্যবসায়ীদের এসব অসুস্থ মানসিকতা পরিহারের নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক ব্যয় সংকোচিত করে মিতব্যয়ী হতে উৎসাহিত করে।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর