বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


আশুরা দিবসে শোক পালনের শরয়ি বিধান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মোজ্জাম্মেল হক রাহমানী॥

আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে 'শাহাদাত বরণ' শোকের বিষয় নয়; 'শাহাদাত বরণ' আল্লাহ প্রদত্ত মহা নেয়ামত। 'শাহাদাত' এমন এক মহা দৌলত-সম্পদ, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে আল্লাহর কাছে কামনা করেছেন এবং উম্মতকেও প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করেছেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আমি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে শহীদ হতে চাই, পুনরায় আমাকে জীবন দান করা হলে, আমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে শহীদ হব, পুনরায় আমাকে জীবিত করা হলে, আমি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করব এবং আমি শহীদ হব। (মুসলিম শরীফ: ৪৯৬৭)

এজন্যই হযরত ওমর ফারুক (রা.) শাহাদাতের জন্য ক্রমাগত দোয়া করতেন (বুখারী শরীফ: ১৮৯০)। তাই হযরত হোসাইন (রা.) -এর শাহাদাতে হৃদয় দুঃখিত হওয়া ও দিল ব্যথিত হওয়া, অনিচ্ছায় চোখ থেকে অশ্রু ঝরা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এতে ধৈর্য ধারণ করা মুসলমানদের ঐতিহ্য-আদর্শ। উচ্চস্বরে চিৎকার ও বিলাপের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক শোক-দুঃখ প্রকাশ করা ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ।

এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) লিখেছেন: হযরত হোসাইন (রা.) -এর শাহাদাতে শোকাহত হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য উচিত, কারণ তিনি ছিলেন মুসলমানদের নেতাদের একজন এবং আহলে ইলেম সাহাবীদের অন্যতম। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদরের প্রিয় নাতি, বড় ইবাদতগুজার, অত্যন্ত সাহসী ও খুবই উদার।

তবে তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে এমন শোক উদযাপন করা যাবে না, যেমন রাফেজিরা করে। কারণ তাঁর পিতা হযরত আলী (রা.), যিনি তাঁর চেয়ে উত্তম ছিলেন, ১৭ ই রমজান ৪০ হিজরি সনে, শুক্রবার ফজরের নামাজে যাওয়ার সময় শাহাদাত বরণ করেন। হযরত হাসান-হোসাইনসহ কোনো সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে কখনো শোক উদযাপন করেননি।

একইভাবে হযরত উসমান গণি (রা.), যিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মতে হযরত আলীর চেয়ে উত্তম ছিলেন, পঁয়ত্রিশ হিজরি সনে ঈদুল আযহার পর নিজ বাড়িতে শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে কোনো সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শোক উদযাপন করেননি। হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) হযরত উসমান ও হযরত আলীর (রা.) চেয়ে উত্তম ছিলেন, মসজিদে নববীর মেহরাবে নামাজে কেরাত পাঠরত অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন।

কিন্তু তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে কোনো সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শোক উদযাপন করেননি। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) যিনি দুনিয়া ও আখেরাতে গোটা মানবজাতির নেতা, তাঁর মৃত্যু দিবসকে কেউ শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেননি। এজন্য ইসলামি শরিয়তে শোক উদযাপন করা নাজায়েজ ও হারাম। (আল্-বেদায়া ওয়ান্-নিহায়া ৮/২২১)

তবে কারো শোক-দুঃখে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে চোখ থেকে অশ্রু ঝরে, এটা ভিন্ন বিষয়, এটা জায়েয। যা নিম্নোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট।

হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে তাঁর পুত্র ইব্রাহিমের দুধ মায়ের ঘরে প্রবেশ করলাম। যখন ইব্রাহিমের প্রান বের হওয়ার উপক্রম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইব্রাহিমকে তুলে নিয়ে চুম্বন করলেন এবং শুঁকলেন। সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হলো।

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বললেন— হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও কাঁদছেন? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: হ্যাঁ, ইবনে আউফ! এটাতো রহমত-করুণা। অতঃপর তিনি আবার একই কাজ করলেন এবং বললেন: নিশ্চয়ই অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে এবং হৃদয় বিষণ্ণ হচ্ছে; কিন্তু আমরা এমন কথা বলব না, যাতে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হবেন। হে ইব্রাহিম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা দুঃখিত। (বুখারী: ১/১৭৪)

বিপদ-আপদে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সুন্নতের ব্যাপারে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম (রহ.) লিখেছেন: বিপদে-আপদে রাসূলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকতেন, আল্লাহর প্রশংসা করতেন, এবং “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন” পাঠ করতেন। আর যারা বিপদ-আপদে কাপড় ছিঁড়ে, জোরে জোরে বিলাপ করে ও মাথা ন্যাড়া করে, তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতেন, ঘৃণা প্রকাশ করতেন। (জাদুল মিয়াদ: ১/৫২৭)

অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, চোখ ও হৃদয়ের মাধ্যমে যে দুঃখ-শোক প্রকাশ করা হয়, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত-করুণা এবং হাত ও জিহ্বা দ্বারা যে দুঃখ-শোক প্রকাশ করা হয়, তা শয়তানের পক্ষ থেকে। (মুছনাদে আহমাদ: ৩০৯৩)।

ইসলামের আগ কিছু দুঃখ-শোক প্রকাশের পদ্ধতি ছিল। বিলাপ করা, চিৎকার করে কান্নাকাটি করা ও কাপড় ছিঁড়া ইত্যাদি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) এসব নিষেধ করেছেন এবং এগুলোর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। বুখারী শরীফে এসেছে, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের থেকে দায়মুক্ত, তাদের প্রতি বিরক্ত, যারা বিপর্যয়ে-বিপদে বিলাপ করে,আওয়াজ তোলে, হাহাকার করে, আতঙ্কে চুল উপড়ে ফেলে এবং তাক্বদিরের প্রতি বিরক্ত হয়ে পকেট বা পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। (বুখারী শরীফ: ১/১৭৩)

অন্য বর্ণনায় এসেছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকের সময় গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের ডাকের ন্যায় ডাক ছাড়ে। (বুখারী শরীফ: ১/১৭৩)

ফকীহগণও একে হারাম ও নাজায়েজ ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন, মৃতের উপর বিলাপ করা, উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করা হারাম। (আল্-ফিক্বহু আলাল্ মাজাহিবিল আরবাআহ্: ১/৪৫১)

ফকীহগণ শোক-দুঃখের উদ্দেশ্যে কালো কাপড় পরিধান নিষিদ্ধ করেছেন, যেমনটি ফাতাওয়ায়ে আলমগীরীতে রয়েছে: মৃতের শোক পালনের সময় কাপড় কালো করা জায়েয নয়, মৃতের ঘরের কাপড় কালো করাও জায়েয নয়। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী: ৫/৩৩৩)
মেশকাত শরীফে এসেছে হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন বিলাপকারী এবং বিলাপ শ্রবণকারী নারীকে। (মেশকাত শরীফ: ১/১৫১)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কালো দিবস পালন করা, কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করা ও কালো ফিতা বাঁধা শোক-দুঃখ পালনের কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। এটা মূলত পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণ-অনুসরণে প্রভাবিত হওয়ার ফলে তাদের শোক-দুঃখ ও মানসিক যন্ত্রণা প্রকাশের কিছু পন্থা অবলম্বন করেছে মুসলমানরা।

যা সম্পূর্ণ শরিয়ত গর্হিত কাজ। তা স্পষ্ট হারাম। ইসলামি শরিয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও, যদি কোনো মুসলমান এসব শরিয়ত গর্হিত-হারাম বিষয় পরিহার না করে, তাহলে এমন লোকদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী একেবারেই সত্য। নবীজি বলেন— "যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই একজন"। সুতরাং যে বিজাতিদের আচার-আচরণ গ্রহণ করবে, সে বিজাতিদের একজন হিসেবে গণ্য হবে।

সিনিয়র শিক্ষক: মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা, বসুন্ধরা, ঢাকা।

-এটি


সম্পর্কিত খবর