শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


অনলাইনে ইফতা : হুমকির মুখে ফতোয়া বিভাগ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।নুরুদ্দীন তাসলিম।।

ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যায়নের মাধ্যমে জাতির একজন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ গবেষক তৈরি হয়ে থাকে, যিনি কোরআন হাদিসের আলোকে মানুষকে শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়াদি সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।

ফতোয়া শাস্ত্রে একজন আলেমকে যোগ্য করে তুলতে দেশের প্রচলিত ফতোয়া বিভাগগুলোতে এক, দুই, তিন বছর এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোন কোন জায়গায় পাঁচ বছরও পড়াশোনা করানো হয়। তবে সম্প্রতি দাওরায়ে হাদীস/কামিল উত্তীর্ণদের জন্য রাজধানীর দারুল উলুম ঢাকার ব্যবস্থাপনায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম জুমে সপ্তাহে দুই দিন ৫ ঘন্টা করে ক্লাসের মাধ্যমে ইফতা কোর্স চালুর একটি পোস্টার ছড়িয়ে পরতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

উক্ত প্রতিষ্ঠানে কওমি মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণদের পাশাপাশি আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল উত্তীর্ণদেরও ইফতা পড়ার সুযোগ থাকছে।

অনলাইনে সপ্তাহে দুই দিন ৫ ঘন্টা করে ক্লাস করে ফিকাহ শাস্ত্রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মান রক্ষা করা কতটা সম্ভব? জানতে যোগাযোগ করেছিলাম রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে অবস্থিত শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ-এর সাথে, তিনি বলেছেন, ‘কুরআন-সুন্নাহ ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে উদ্ভাবিত বিধি-বিধানের নাম ফিকfহ। কারো প্রশ্নের ভিত্তিতে শরীয়তের বিধি-বিধান জানিয়ে দেওয়ার নাম ফতোয়া প্রদান। কুরআন সুন্নাহের সারমর্ম উদ্ধার করে ইজমা কেয়াসের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে শরীয়তের বিধি-বিধান জানাতে একজন আলেমকে যোগ্য করে তোলার জন্য খোলা হয়েছে ফতোয়া বিভাগ। জাতির সামনে ফতোয়া উপস্থাপন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে এত হালকা করে দেখার কোন সুযোগ নেই।’

সরাসরি ওস্তাদের সংস্পর্শে থেকে ১ বছরের যেসব ফতোয়া বিভাগ রয়েছে এর মাধ্যমেও ফতোয়ার মূল উদ্দেশ্য অর্জন হয় না উল্লেখ করে তিনি বলছেন, দেশে এক বছরের যেসব ফতোয়া বিভাগ রয়েছে এগুলোকে আমি দারুল ইফতার মধ্যে গণ্য করি না। এক বছরের বাইরে অনলাইনের জুম ক্লাসের মাধ্যমে যেখানে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ওস্তাদের সংস্পর্শ পাচ্ছে না, কিতাবের গভীরতায় ঢুকার সুযোগ পাচ্ছে না, একে কোনভাবে ফতোয়া বিভাগ বলা যায় না।

বর্তমানে আধুনিকায়নের নামে অনলাইন প্লাটফর্ম এবং যেসব শর্ট কার্টের ব্যবস্থাপনা চালু হচ্ছে- এসবের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে এক ধরনের হুমকির মুখোমুখি করা হচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তিনি।

তার ভাষায়, এসবের মাধ্যমে এলেম বিদায়ের আয়োজনগুলো সহজ করে তোলা হচ্ছে এবং ফতোয়া বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে হালকা করে মানুষের সামনে রসিকতা, ও তিরস্কারের পাত্রে পরিণত করা হচ্ছে।

তিনি নিজের ওস্তাদ ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা তাকি উসমানির উদ্ধৃতি টেনে বলেন, শুধু গৎবাঁধা কিছু উসুল মুখস্ত করা নয়, বরং ওস্তাদের সোহবতে থেকে, তার আচার-আচরণ, চিন্তা চেতনা ও কর্মপন্থা থেকে শিক্ষার্থীকে ফতোয়া শেখানোর তালিম দিয়েছেন আল্লামা তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ। এর পাশাপাশি আল্লামা শামী রহ.-এর উদ্ধৃতি সামনে নিয়ে এসে তিনি বলেন, বিজ্ঞ মুফতির তত্ত্বাবধায়নে থেকে, তারবিয়াত, অসংখ্য কিতাব অধ্যায়ন, শায়খের নিকট বারবার তামরিন করে সে অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়াই মুফতি বা প্রাজ্ঞ ফকিহ হওয়ার অন্যতম পদ্ধতি।

তিনি বলছেন, বর্তমানে অনলাইনে চালু হওয়া এই কোর্সের মাধ্যমে হয়তোবা মুফতি নামের কাগজের সার্টিফিকেট অর্জন হতে পারে। তবে এই সার্টিফিকেট অবশ্যই সত্যিকারের মুফতিদের জন্য কলঙ্কের।

অনলাইনে এই ইফতা কোর্সের কোন ভালো দিক থাকতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফতোয়া নিয়ে পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করে হয়তোবা লম্বা সিলেবাসের জন্য কিছুটা অনুশীলন করে নিতে পারেন, যা তার সামনে ইফতার করার জন্য সহায়ক হতে পারে ,কিন্তু এখানে কিছু ক্লাস ও কিছু উসুল শিখিয়ে ইফতার সার্টিফিকেট দেওয়ার মাধ্যমে ইলমে নববীর অনেক বড় ক্ষতি সাধন করা হবে।’ এসব কারণে তিনি আহলে এলেমদের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে বলছেন এবং এমন হাস্যকর সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে ঢাকার একটি অনলাইনে ইফতা কোর্সের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, দেশের প্রচলিত ধারার ইফতা বিভাগগুলোর সাথে অবশ্যই আমি আমার ইফতা বিভাগকে তুলনা করছি না, মূলত দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের খতিব যারা নানান ব্যস্ততায় ইফতা পড়ার সুযোগ পাননি, বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের জন্যই এই অনলাইন কোর্স। তবে মাদ্রাসার শিক্ষক. মসজিদের খতিবদের বাহিরেও যোগ্যতার ভিত্তিতে দাওরায়ে হাদীস/কামিল উত্তীর্ণদেরও এখানে ভর্তি করানো হয়।

খতিব ও শিক্ষকদের ইফতার সার্টিফিকেট দিতেই এই কোর্স কিনা প্রশ্ন করতেই এড়িয়ে গেছেন ওই পরিচালক।

তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে আরো বলেছেন, ‘দেশের প্রচলিত ধারার ইফতা বিভাগগুলোতে দু’,তিন বছর ও ক্ষেত্রবিশেষে যেসব প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর যেসব পড়ানো হয় আমার এখানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা সে পরিমাণ যোগ্য হয়ে উঠবেন বলে আমি দাবি করছি না। তবে বিভিন্ন অলি-গলিতে যেসব ইফতা বিভাগ গড়ে উঠেছে; সে তুলনায় আমার অনলাইন কোর্সের শিক্ষার্থীরা অবশ্য ভাল ফলাফল করবেন’-দাবি অনলাইনে ইফতা কোর্সের পরিচালকের।

কিছু অক্ষর শেখার নাম ইলমে ওহী নয়, সরাসারি শিক্ষকের সংস্পর্শ গ্রহণ এক্ষেত্রে অনেক বড় একটি বিষয়,ফতোয়ার মত একটি বিষয় যার মাধ্যমে জাতির অন্যতম গবেষক তৈরি হয়ে থাকে, সে বিষয়টিকে কি এই কোর্সের মাধ্যমে একেবারে হালকা করে দেওয়া হল বলে আপনার মনে হয় না? এই প্রশ্ন বেশ কয়েকবার করা হলেও তিনি বারবার এড়িয়ে গেছেন এর উত্তর।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ