শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


স্বপ্ন; স্বপ্নব্যাখ্যায় সুন্নত ও আদব: আল্লামা তাকি উসমানি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,  নবুয়তের দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে এবং নবুয়তের সুসংবাদ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

সাহাবায়ে কেরাম রা. প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সুসংবাদ কী? (এখানে সুসংবাদ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সুসংবাদ বাহক বস্তু)। রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “ সত্য স্বপ্ন”। সত্য স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ এবং তা নবুয়তের অংশ।

অন্য এক হাদিসে রাসূল সা. এরশাদ করেছেন, মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন নবুয়তের ছিচল্লিশতম অংশ।

সত্য স্বপ্ন, নবুয়তের অংশ
হুজুর সা. এর নবুয়তপ্রাপ্তির সময় হলো। নবুয়ত পাওয়ার পর ছয়মাস কোনও ওহী আসেনি। এ ছয়মাস হুজুরকে সত্য স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। বুখারি শরিফের বাদউল ওহীতে আছে, হুজুর সা. তখন স্বপ্নে যে ঘটনা ঘটতে দেখতেন জাগ্রত অবস্থায়ও তাঁর সঙ্গে সে ঘটনা ঘটত। তাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হতো এবং সকালের আলোয় সে স্বপ্নের সত্যতা মানুষের সামনে প্রকাশ পেত।

এভাবে ছয়মাস তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ছয়মাস পর ওহী আসতে শুরু করে। নবুয়ত পাওয়ার পর হুজুর সা. তেইশ বছর পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। এ তেইশ বছরের মধ্যে ছয়মাস তিনি শুধু স্বপ্নই দেখেছেন। কোনও ওহী আসেনি তাঁর কাছে।

এ কারণেই হুজুর সা. এরশাদ করেছেন, মুমিনের স্বপ্ন ওহীর ছিচল্লিশতম অংশ। এর মাধ্যমে একথা বোঝাতে চেয়েছেন যে, এর ধারাবাহিকতা আমার পরেও অব্যাহত থাকবে, মুমিন ব্যক্তিদের সত্য স্বপ্ন দেখানো হবে এবং এর মাধ্যমে তাদের সুসংবাদ দেয়া হবে। বুখারি শরিফের কিতাবুত তা’সীরের অন্য আরেক হাদিসে আছে, কিয়ামতের পূর্ববর্তী সময়ে মুসলমানদের অধিকাংশ স্বপ্ন সত্য হবে।

সুতরাং স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার নিয়ামত। মানুষ এর মাধ্যমে সুসংবাদ পেয়ে থাকে। তাই স্বপ্নে কোনও সুসংবাদ পেলে তার জন্য আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

স্বপ্ন সংক্রান্ত দুই সিদ্ধান্ত
আমাদের দেশে স্বপ্ন নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকে। কেউ কেউ সত্য স্বপ্ন, স্বপ্নের ব্যাখ্যা এগুলো মানে না। এটা খুবই গলদ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. বলছেন, সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছিচল্লিশতম অংশ। সত্য স্বপ্ন মুমিনের জন্য সুসংবাদ। তাহলে তো সত্য স্বপ্ন অস্বীকার করার কোনও অবকাশই নেই।

অপরদিকে কেউ কেউ কেবল স্বপ্ন নিয়েই পড়ে থাকে। স্বপ্নকেই মুক্তি ও সফলতার চাবিকাঠি মনে করে। কেউ একটা সত্য স্বপ্ন দেখে ফেললে লোকেরা তাকে পুজো করতে থাকে। কেউ নিজে কোনও সত্য স্বপ্ন দেখে ফেললে সে নিজেকেই বড় বুজুর্গ মনে করে পুজো করতে থাকে।

স্বপ্ন ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মানুষ। জাগ্রত অবস্থায়ও কখনও কখনও মানুষ স্বপ্ন দেখে। সেটাকে কাশফ বলা হয়। আর এ কাশফ যদি কারও একবার হয়ে যায় কাশফ হওয়ার সময় তার মধ্যে সুন্নত থাকুক বা না থাকুক তাকে সর্বাসর্ব বানিয়ে বসে থাকে মানুষ। সে মহামানবের রূপ নিয়ে মানুষের পূজ্য বস্তুতে পরিণত হয়।

ভালোভাবে অনুধাবন করা উচিত, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের সীমারেখা স্বপ্ন বা কাশফ নয়। মূল শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে, তার জীবন সুন্নত অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া না হওয়ার ওপর। সে কি জাগ্রত অবস্থায় গুনাহ থেকে বিরত থাকে? সে কি জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য করছে?

যদি না করে থাকে তবে তার হাজার স্বপ্ন, হাজার কাশফ আর হাজার কেরামত প্রকাশ পাক; এগুলো তার জন্য কোনও প্রকার শ্রেষ্ঠত্বের পরিমাপক বিবেচিত হবে না।

আজকাল এ ব্যাপারে মারাত্মক ভ্রষ্টতা ছড়িয়ে পড়েছে। পীর-মুরিদির সঙ্গে এগুলোকে আবশ্যক মনে করা হচ্ছে। সারাক্ষণ মানুষ এসবের পেছনেই পড়ে থাকে।

স্বপ্নের স্বরূপ
হযরত মুহাম্মদ বিন সিরিন রহ. অনেক বড় তাবেয়ী ছিলেন। স্বপ্নব্যাখ্যায় ইমাম ছিলেন। পুরো উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে তার চেয়ে বড় স্বপ্নব্যাখ্যাতা জন্ম নেননি হয়ত। আল্লাহ তাআলা তাকে স্বপ্নে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে দারুণ যোগ্যতা দান করেছিলেন। তার অনেক আশ্চর্য ও দুর্লব ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে।

কিন্তু তার ছোট্ট একটা বাক্য আছে, যেটা খুব স্মরণযোগ্য যার দ্বারা স্বপ্নে মূলতত্ত্ব প্রকাশ পায়। তিনি বলেছেন, “স্বপ্ন মানুষকে আনন্দ দেয়। কিন্তু তা যেন কাউকে কখনও ধোঁকায় না ফেলে। সে যেন এটা মনে না করে যে, আমার মর্যাদা অনেক ওপরে উঠে গেছে এবং এ ভাবনা যেন তার জাগ্রত অবস্থার আমল থেকে উদাসীন করে না দেয় ”

হযরত থানবি রহ. এর স্বপ্নব্যাখ্যা
হযরত থানবি রহ.এর কাছে লোকেরা তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করত। তিনি সাধারণত সবাইকে দুটি পংক্তি শুনিয়ে দিতেন,

আমি তো রাত্রী নই
রাত্রীর পুজারি নই
যে, আমি স্বপ্নের কথা বলে বেড়াব।

আমাকে দান করা হয়েছে সূর্য
রিসালাতের সেই রণতূর্য
আমি তো তারই গুণগান গেয়ে বেড়াব

তিনি বলতেন, স্বপ্ন যতই ভালো হোকÑ আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবে। সত্য স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। হতে পারে, আল্লাহ তাআলা কোনও এক সময় তোমাকে এর বরকত দান করবেন। কিন্তু শুধু স্বপ্নের খাতিরে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ফয়সালা করা উচিত হবে না।

হযরত মুফতি সাহেব রহ. এর সুসংবাদসমূহ
আমার পিতা (মুফতি শফী রহ.) সম্বন্ধে অনেক মানুষ স্বপ্ন দেখেছেন। যেমন কারও হুজুর সা. এর যিয়ারত হয়েছে স্বপ্নে এবং হুজুর সা. কে তিনি আব্বাজার রহ. এর আকৃতিতে দেখেছেন। অনেক মানুষ আব্বাজানকে নিয়ে এজাতীয় স্বপ্ন দেখেছেন।

কেউ যখন এধরনের চিঠি লিখে আব্বাজানের কাছে পাঠাতেন তখন তিনি সেগুলো নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখতেন। ‘মুবাশশিরাত’ শিরোনামের একটি রেজিস্ট্রি খাতায় সেগুলো উঠিয়ে রাখতেন।

ওই রেজিস্টারের প্রথম পাতায় আব্বাজানের নিজের কলমে লেখা ছিল , এই রেজিস্টারে আমার সম্বন্ধে দেখা আল্লাহর নেক বান্দাদের স্বপ্নগুলো এ উদ্দেশ্যে লিখে রাখছি, (যাই কিছু হোক এগুলো সুসংবাদবাহক, সৌভাগ্যসহায়ক) যেন আল্লাহ তাআলা এগুলোর বরকতে আমার ইসলাহ করে দেন।

কিন্তু পাঠকের প্রতি আমার সতর্কবানী থাকবে, ভেতরে যেসব স্বপ্ন বর্ণনা করা হবে সেগুলো কিছুতেই আমার মর্যাদার মানদ- হবে না। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তও নেয়া যাবে না। বরং মূল ভিত্তিমূল হলো আমার জাগ্রত অবস্থার আমল ও কথা। সুতরাং এগুলোর মাধ্যমে যেন মানুষ আমার ব্যাপারে প্রতারণার স্বীকার না হয়।”

কেউ যেন এই চিঠিগুলো পড়ে প্রতারিত না হয় সেজন্যই তিনি এই কথাগুলো লিখে রেখেছেন রেজিস্টারের প্রথম পাতায়।

এসবের ভেতর দিয়ে আমরা স্বপ্নের স্বরূপটা সন্ধান করার চেষ্টা করলাম। মানুষ ভালো স্বপ্ন দেখলে আল্লাহর শুকরিয়া আদয় করবে এবং দোয়া করবে, হে আল্লাহ! এই স্বপ্নকে আমার জন্য বরকতের উসিলা বানিয়ে দিন। এর মাধ্যমে আমি যেন নিজের ব্যাপারে বা অন্যের ব্যাপারে ধোঁকায় না পড়ি।

স্বপ্নে হুজুর সা.এর যিয়ারত
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, যে আমাকে স্বপ্নে দেখল সে আমাকেই স্বপ্নে দেখল। কেননা, শয়তান আমার রূপ ধারণ করে আসতে পারে না।

আল্লাহ তাআলা যদি কাউকে স্বপ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা. এর যিয়ারত করান তাহলে সেটা তার জন্য খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তাআলা এ সৌভাগ্য সবাইকে নসিব করুন। আমিন।
উপর্যুক্ত হাদিসের মূল বক্তব্য হলো, হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সা. এর যে আকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে কেউ যদি হুবহু সে আকৃতিতে তাঁকে দেখে তাহলে সেটা সত্যি হবে। কারণ, শয়তান হুজুর সা.এর রূপ ধারণ করে স্বপ্নে কাউকে প্রতারিত করতে পারবে না। এটা রাসূলুল্লাহ সা.এর বিশেষ মোজেযা।

আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তাআলা অনেক মানুষকে এ সৌভাগ্য দিয়েছেন যারা হুজুর সা.কে স্বপ্নে দেখেছেন। এটা অনেক বড় নিয়ামত ও সৌভাগ্য। এবিষয়ে আমাদের উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতামত আছে। কারও মতে এ সৌভাগ্য অর্জন করার জন্য চেষ্টা করতে হয়।

এর জন্য এমন আমল করতে হয় যে আমলের বরকতে হুজুর সা. এর যিয়ারতের সৌভাগ্য লাভ হয়। এর বুযুর্গরা বিশেষ আমল লিখেছেনও। যেমন, জুমার রাতে এতোবার দুরুদ শরিফ পড়ার পর এই আমল করে ঘুমালে হুজুর সা. এর যিয়ারত পাওয়ার আশা ও ভরসা হয়ে থাকে। এধরনের অনেক আমল প্রসিদ্ধ আছে।

আর কোনও কোনও উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এ ব্যাপারে একটু ভিন্ন। যেমন, আমার আব্বাজান রহ. এর কাছে এক ভদ্রলোক আসতেন। একবার এসে বলতে লাগলেন, দিল ও দেমাগে হুজুর সা.এর যিয়ারতে খুব আকাঙ্খা জাগছে। এমন কোনও আমল বাতলে দিনÑযাতে এ নিয়ামত আমার অর্জন হয়ে যায়।

আব্বাজান রহ. বললেন, ভাই! তুমি অনেক সাহসী মানুষ। তাই তুমি হুজুর সা.এর যিয়ারতের আকাঙ্খা করতে পারছ। আমার তো এই সাহসটুকুই হয় না, আমি দোজাহানের বাদশাকে স্বপ্নে দেখার আকাঙ্খা করব। কারণ, কোথায় আমি! আর কোথায় নবিজী সা.এর যিয়ারত! এজন্য তো আমার কখনও এধরনের আমল শেখার সুযোগই হয়নি।

আর কখনও এমনটি ভাবতেও পারিনি যে, দোজাহানের বাদশাহকে স্বপ্নে দেখার জন্য কোনও তদবির করাও যেতে পারে! যিয়ারত যদি হয়েও যায় তাহলে তাঁর আদব, হক, চাহিদা কিভাবে পূরণ করব? একারণে নিজের পক্ষ থেকে এ সৌভাগ্য অর্জনের চেষ্টা করিনি।

অবশ্য যদি আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে কখনও যিয়ারত করিয়ে দেন তবে সেটা তাঁর অশেষ কৃপা। তিনি নিজে যখন যিয়ারত করাবেন তখন তার আদব রক্ষা করার তাউফিকও তিনি দিয়ে দিবেন। সকল মুমিনের অন্তরে যেমন আকাঙ্খা হয় তেমনি আমারও হয়। কিন্তু যিয়ারতের চেষ্টা করা খুবই সাহসিকতার ব্যাপার। আমার সেই সাহসটাই হয় না।

স্বপ্ন সত্যি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। স্বপ্ন সহজে মানুষকে গোমরাহ করতে পারে। মানুষ অনেক অলীক স্বপ্ন দেখে দেখে নিজের ভেতরে নানা রকম চিন্তার জাল বিস্তার করে। আর সে স্বপ্নচিন্তা যদি হয় বিপথের, তাগুতের তাহলে তো খুবই ভয়াবহ তার সে স্বপ্নচারিতা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের কুসংস্কার, অপচিন্তা ও চিন্তাগত প্রতারণা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ