শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


অনন্ত জলিলের প্রতি খোলা চিঠি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

প্রিয় অনন্ত জলিল! 

আশা করছি ভালো আছেন। আমিও আপনার দুআয় ভালো আছি। আমি আপনার এক দীনি ভাই আপনার কাছে হৃদয়ের কিছু ব্যাথা ও আকুলতা প্রকাশ করতে আপনার সমীপে এ পত্র লিখছি। আমার আপনার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আদ দীন আন নসিহা কল্যাণকামীতা-ই পরম ধর্ম। তাই আপনার কল্যাণকামী এ ছোট ভাইয়ের কথাগুলো মনোযোগসহ শুনবেন বলে আশা করছি।

প্রিয় ভাই!
কয়েকদিন পূর্বে কুরবানি নিয়ে আপনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। দেশের প্রভাবশালী দুটি দৈনিকের শিরোনাম দেখলাম ‘৯গরুর কুরবানির টাকা বন্যার্তদের সহায়তায় দেবেন অনন্ত’, ‘কুরবানির সব টাকায় বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবো: অনন্ত জলিল’। খবরের ভেতরে দেখলাম, আপনার বক্তব্যকে চরমভাবে বিকৃত করা হয়েছে। আপনি বলেছিলেন, ‘প্রতি বছরের মতো ৮টি ১০টি গরু কুরবানি না দিয়ে এ বছর ১টি বা ২টি কুরবানি দিবো।

আর বাকি কুরবানির টাকা দিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবো।’ আপনার এ বক্তব্যকে পুঁজি করে ইসলামের একটি ওয়াজিব বিধান কুরবানি নিয়ে ভুল ম্যাসেজ সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

যদি বলি, কৌশলে ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে তাও অতুক্তি হবে না। শিরোনাম থেকে বুঝা যায়, কুরবানি না দিয়ে আপনি সে টাকা বন্যর্তদের দান করবেন। ইসলামের এ বিধান নিয়ে আপনার বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থান করে আপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। তাই আশু আপনার পক্ষ থেকে এর ব্যাখ্যামূলক বিবৃতি আশা করছি।

আমার প্রিয় ভাই!
কুরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে আপনি হয়তো জানেন, কুরবানি ইসলামের একটি ওয়াজিব বিধান। ধর্মের বিশেষ ‘শেআর’ তথা অমূল্য প্রতীক। একজন সামর্থবান মুসলিমের উপর ঈদুল আজহার দিনগুলোতে আল্লাহর নামে পশু কুরবানি করা আবশ্যক। সামর্থবান কেউ কুরবানি না দিলে গুনাহগার হবে। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় প্রতি বছর কুরবানি দিয়েছেন।

শেষ হজে তিনি একশ উট কুরবানি দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন থেকে শুরু উম্মাহর সকল মানুষ পৃথিবীর সব প্রান্তে এ আমল করে আসছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর কুরবানীর পশুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ।’ (সুরা হজ:৩৬) একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরবানির দিন কুরবানির চেয়ে প্রিয় আমল আর নেই। (তিরমিজি) মদিনাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
অভ্যাস ছিল, ঈদের নামাজের পর ঈদগাহে থাকা অবস্থায় কুরবানি করতেন। যেন সবাই কুরবানির গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং কুরবানির সিস্টেমও জানতে পারে। কুরবানির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঈদের দিন সামর্থবান কেউ কুরবানি না করলে সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (মুসতাদরাক হাকেম, ৩/৩৮৯)

মোটকথা কুরআন হাদিসের অসংখ্য বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, কুরবানি শরিয়তের একটি অকাট্য বিধান। প্রত্যেক ব্যক্তির উপর আলাদা আলাদাভাবে তা আবশ্যক। মনে করুন! নামাজ পড়া যেমন ফরজ কুরবানি করাও ঠিক তাই। আপনি এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়ে একশ গরু কুরবানি দিলেও তা নামাজের বিকল্প হবে না। ঠিক তেমনি জাকাত না দিয়ে দশটি গরু কুরবানি দিলে তা জাকাতের বিকল্প হবে না।

এমনিভাবে কুরবানি না দিয়ে হাজার কোটি টাকা দান করলেও কুরবানির ইবাদত আদায় হবে না। প্রত্যেকটি ইবাদত স্বতন্ত্র। তাকে স্বতন্ত্রই রাখতে হবে। মানুষকে ইবাদতবিমুখ করতে ইদানিং সমাজের কিছু সুশীল ও সেলিব্রেটিদের পক্ষ থেকে শরিয়াহ বিরোধী এমন কথা উঠানো হচ্ছে যা ইতিপূর্বে আমরা কেউ শুনিনি। কুরবানির ঈদ আসলেই কুরবানি না দিয়ে তা সদকা করে দেয়া বা গরিবদের সহায়তা করার কথা অনেক দীনহীন ‘অতিভদ্র’ ‘শ্রেণি’টি বলে থাকে। এবং তারা এর মাধ্যমে শরিয়াহর এ বিধানটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কিংবা যদি বলি, হালকা করার সুক্ষ্ম চিন্তার বীজ মানুষের অন্তরে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যা সচেতন মুসলিম
হিসেবে অনুচিৎ।

প্রিয় জলিল ভাই!
আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, প্রতি বছর কুরবানির ঈদ আসলে এ দেশের পরগাছা শ্রেণির কিছু বুদ্ধি বিক্রেতা বিভিন্ন টকশোতে বুদ্ধি বিক্রি শুরু করে। তাদের কল্পিত বুদ্ধির তাপে দীন থেকে দূরে থাকা অনেক সরলমনা মুসলিমও প্রভাবিত হয়ে থাকে। এত কুরবানি করে কী লাভ? এসব অপচয় না করে গরিবদের মধ্যে দান করলে ভালো হয়, কুরবানি না করে অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানো দরকার, একদিনে এত কুরবানির মাধ্যমে এত প্রাণির জীবননাশ মানবতা বিরুধি, অর্থনৈতিক ক্ষতি.... ব্লা ব্লা....। এমন অনেক প্রশ্ন তারা ডেলিভারি দিয়ে থাকে। কিংবা জেনে বুঝে ইসলামের এ মহান বিধানকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে থাকে।

আমার প্রিয় ভাই!
আমি বিশ্বাস করি, আপনি একজন মুসলিম। আপনি তাদের অপয়া চিন্তায় প্রভাবিত নন। এসব আপনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন না এমনটি আমরা ভাবতে চাই। বলি কী ভাই!! মানুষের মধ্যে আত্মিক পরিশুদ্ধতা না থাকলে মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় তার কল্পনা ও প্রসূত চিন্তকে খোদা বানিয়ে নেয়। আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের অবস্থাও তাই। বস্তুবাদ ও জড়বাদে আচ্ছন্ন হয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের কুদরত ও সুশৃখংল ব্যবস্থাপনার সুন্দর দিকটি তারা ভুলে যায়। নাস্তিক বা ধর্ম বিদ্যেষীদের এ এক মহাশুণ্যতা। এসব লোকদের কাছে তখন আল্লাহর নির্দেশ ও ইসলামের হুকুম আহকামকে প্রাণহীন মনে হয়। অর্থহীন ভাবে তারা।

একজন সুস্থ মানুষ মাত্রই বিশ্বাস করে একটি সুকুমার সমাজ বিনির্মান ছাড়া সভ্যতা টিকতে পারে না। আর সভ্যতা ও সমাজ টিকে থাকার জন্য সমাজের মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধতা দরকার। পেট ও পিঠ চালাতে এ সমাজের মানুষকে আগে প্রকৃত মানুষ হতে হবে। আপনি বিশ্বাস করবেন, নৈতিকতার সিঁড়ি বেয়েই প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়। এ পথ ছাড়া মানুষ হওয়া অসম্ভব। পরীক্ষিত এ দর্শন পৃথিবীর পুব ও পশ্চিমের। নৈতিকতা না থাকলে চুরি চামারি, খুন খারাবি, দুর্নীতি রাহাজানিতে সমাজ ভরে যাবে। তাই রাষ্ট্রকে শিক্ষার ক্ষেত্রে যেভাবে প্রচুর পরিমাণ খরচ করতে হয় ঠিক তেমনি নৈতিকতা অর্জনের জন্য সমান খরচ ও চেষ্টা করতে হয়। পৃথিবীর সব দর্শনের সারকথা হল, নৈতিকতা অর্জন হয় ধর্মের মাধ্যমে।

খোদাভীরুতার মাধ্যমে। আল্লাহর প্রতি আস্থা বিশ্বাস ও আনুগত্যের মাধ্যমে। আর এ সব কিছুই অর্জন হয় কুরবানির মাধ্যমে। কুরবানি ব্যক্তিকে ত্যাগ ও তাকওয়ার শিক্ষা দেয়। দেয় আরো আত্মিক বহুবিধ উপকার। কুরবানির এ বিশাল উপকার চর্মচোখে দেখা যায় না। বুঝতে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করলে আপনি বুঝতে পারবেন, কুরবানির মাধ্যমে গোস্ত ও রক্ত প্রবাহিত করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। কুরবানির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর ভয় অর্জন। তাকওয়া অর্জন। কুরবানির মাধ্যমে তাকওয়ার সিঁড়ি বেয়ে এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন সহজেই সম্ভব। তাইতো আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশ্ধসঢ়;ত ও রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি সেসবকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর তাকবীর পাঠ করতে পার, এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন। (সুরা হজ:৩৭) তাই আমাদের এ সমাজ টিকে থাকার স্বার্থেই কুরবানির এ ইবাদতকে সার্বজনীনতার রূপ দিতে হবে। ইবাদতকে ইবাদত হিসেবে পালন করতে হবে।

জলিল ভাই!
অনেক নাস্তিকরা বলে থাকে, কুরবানির প্রাণির জীবননাশের মাধ্যমে মানবতা ভুলণ্ঠিত হয়! আপনিই বলুন! অন্য কোন প্রাণির ব্যাপারে তারা এসব অসুস্থ থিউরি আওড়িয়ে থাকে? সময় থাকলে আপনাকে পৃথিবীব্যাপী মানবতা লুণ্ঠনের সমীক্ষা দেখাতাম। আপনাকে কুরবানির আত্মিক, দৈহিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপকারীতা বিজ্ঞানের আলোকে দলিলসহ বলতে পারতাম। তাদের দাবি! এভাবে প্রাণি হত্যার কারণে প্রাণী কমে যায়।

বলি কী! আল্লাহর অসীম কুদরত সম্পর্কে তাদের নুন্যতম ধারণা নেই। প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে, কোন জিনিসের প্রয়োজন বেশি হলে এর উৎপাদনও বেশি হয়। দেখুন! আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস (বস্তু দুনিয়ার উপাদান চতুষ্টয়) আমাদের কত বেশি প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা এগুলো আমাদের জন্য কত সহজবোধ্য করে দিয়েছেন। ঠিক কুরবানির বিষয়টিও। এর চাহিদা যত বাড়ছে উৎপাদনও তত বাড়ছে বৈ কি? পৃথিবীর কোথাও কুরবানির কারণে এসব প্রাণির ঘাটতি দেখা গেছে মর্মে কোন জার্নালের রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে? বরং যে বছর কুরবানি বেশি হচ্ছে সে বছর উৎপাদন বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের গত পাচঁ বছরের জরিপ তো তাই বলে! প্রকৃতি তথা আল্লাহর বিরোধিতা করলে গজব নেমে আসে এ ধরায়। তাই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে নেই। আমাদের পাশের রাষ্ট্রে গোমাতার নামে গরু জবাই নিষিদ্ধের ফলে সেখানে কী গরু সচারচর পাওয়া যাচ্ছে? এত বছর যাবৎ সেখানে গরু নিষিদ্ধ তাই সেখানে তো পায়ের নিচে গরু পড়ার কথা!

আমরা দেখছি এর বিপরিত। কারণ চাহিদা কম থাকায় উৎপাদনও আল্লাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে এ সেক্টরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা অসাধুপায় অবলম্বন করছে।

শ্রদ্ধেয় ভাই!
কুরবানি নিয়ে আপনার বক্তব্য বিকৃত করে যেসব মিডিয়া আপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে আপনার উচিৎ মুসলমান হিসেবে বিষয়টি স্পষ্ট করা। আপনি মজানেন, কুরবানি উপলক্ষে আমিষের যে ঘাটতে ক্ষুণ্যিবৃত্তিতে আবদ্ধ এ সমাজের ঘরে ঘরে তা কিছুটা লাঘব হয় এ কুরবানির মাধ্যমে। গরিবের মুখে হাসি ফোটাতে কিংবা বছরের একটি দিন ভুনা বিফের স্বাদ আস্বাদন করাতে এ পৃথিবীতে কুরবানির বিকল্প কোন পদ্ধতি আছে কি? এ পৃথিবীর কারো কাছে?

ভাই আমার!
আপনি আপনার হালাল উপার্জন থেকে আপনার উপর আবশ্যক হওয়া কুরবানি আদায় করে বাকি টাকা দিয়ে যে কোন কল্যাণকর কাজ করতে পারেন। যে কোন আর্থিক ইবাদতে শরিক হতে পারেন। কিন্তু কুরবানি একদম বাদ দিয়ে সে টাকা দিয়ে কুরবানি দেয়ার ফুলঝুরি মার্কা যে ট্রেন্ড চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আমি আপনার ছোট ভাই হিসেবে সতর্কতার সে কাজটুকু করলাম। আশা করছি আমায় ভুল বুঝবেন না।

আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনাকে সবাইকে তার দীনের জন্য কবুল করুন।

ইতি
আবুল ফাতাহ কাসেমি
রামপুরা, ঢাকা

-এটি


সম্পর্কিত খবর