শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


অবহেলিত ‘দাওয়াহ’ বিভাগ: সমাধান কোন পথে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।কাউসার লাবীব।।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও আদর্শ মানুষ গঠনের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখছে দেওবন্দি চেতনায় গড়ে ওঠা কওমি মাদরাসাগুলো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সিলেবাসে একজন ছাত্র দাওরায়ে হাদিস কমপ্লিট করার পর নিতে হয় বড় একটি সিদ্ধান্ত। কেউ বেছে নেয় খেদমত বা ব্যবসা-বানিজ্যসহ নানা পথ। মেধা ও ফুরসত কুলালে কেউ নিজেকে আরো দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য ভর্তি হয় উচ্চতর শিক্ষার সৌরভময় উদ্যান তাখাসসুস বিভাগে; যে বিভাগগুলো জাতিকে উপহার দেয় একেকজন গবেষক ও চিন্তক আলেম।

তবে সরেজমিনে দেখা যায় বিভিন্ন কারণে ক্রমেই এ তাখাসসুস বিভাগগুলো আস্থা হারাতে বসেছে। বিশেষ করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ইফতা ও আদব বিভাগগুলো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে দেশের চিন্তক শিক্ষাবিদদের। তাছাড়া বিভিন্ন জটিলতায় অবহেলিত হচ্ছে ‘আদদাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ বিভাগ। আসলে মুমিন জীবনে দাওয়াহ মহান এক অধ্যায়। নতুন যারা তাখাসসুস বিভাগে ভর্তি হবে তারা কেন ‘আদদাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ বিভাগ’কে বেছে নেবে? তাছাড়া চলমান দাওয়াহ বিভাগগুলোর মানোন্নায়নে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?  এসব বিষয়ে কথা বলেছিলাম ইসলামিক স্কলার প্রথিতযশা দাঈ মুফতি আব্দুল মাজিদ-এর সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘একজন আলেমের নূন্যতম একটি দায়িত্ব হলো আদ-দাওয়াতু ইলাল্লাহ। তাঁর প্রজ্ঞাময় দাওয়াহ’র ছোয়ায় মানুষ দিশা পাবে সঠিক ও সুন্দর পথের। তাই অন্যান্য তাখাসসুসের বিভাগের চেয়ে ‘আদ-দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ’ বিভাগের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে যেমনিভাবে নামাজের আদেশ করেছেন, তেমনিভাবে ‘আদ-দাওয়াতু ইলাল্লাহ’র আদেশ করেছেন। তাই নামাজ যেহেতু আল্লাহ তাআলার আদেশের জন্য ফরজ, সেই হিসেবে ‘দাওয়াহ’ও একই কারণে ফরজ বলা যায়।’

‘নামাজের মাসায়েল না জেনে কেউ নামাজ পড়তে দাঁড়ালে সে যেমন চরম জটিলতায় পড়বে; এমনকি কখনো কখনো নামাজ ভেঙেও যেতে পারে। ঠিক দাওয়াহ’র ক্ষেত্রেও একই রকম। সঠিক নিয়ম-নীতি না জেনে এ পথে কাজ করতে নামলে কঠিন থেকে কঠিনতর জটিলতায় পড়তে হবে। তবে একটি বিষয় হলো, একজন আলেম দাওয়াহ’র জন্য আলাদা করে নিয়ম করে বা আয়োজন করে কাজ করতে হবে বিষয়টি এরকম নয়। তার চলাফেরা, কথাবার্তা, লেনদেন ও বিচার-বিশ্লেষণ সবই দাওয়াহ’র অংশ। তাই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়ার সময়ই অত্যন্ত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে চলতে হবে। নায়েবে রাসুল হিসেবে এটি আমাদের জন্য আবশ্যক’- বলেন, মুফতি আব্দুল মাজিদ।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘অনেক নবী সারাজীবন দাওয়াতের কাজ করেও কোনো উম্মত-অনুসারী তৈরি করতে পারেননি। বুখারী শরীফের কিতাবুল আম্বিয়াতে আছে ‘অনেক নবী কেয়ামতের দিন উম্মত শূন্য অবস্থায় বা গুটি কয়েক উম্মত নিয়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু এতোকিছুর পরও আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবী-রাসূলকে যে দৌলত দান করেছিলেন সেটি হলো উত্তম আখলাক, নম্রতা, শালীনতা, সুন্দর উপস্থাপন ভঙ্গি এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।’

‘আল্লাহ তায়ালা জানেন যে ফেরাউনকে হাজার বার হযরত মুসা আলাইহিস সালাম দাওয়াত দিলেও সে ঈমান আনবে না। তবুও তিনি নবী মুসা আ.কে আদেশ করেছিলেন ফেরাউনকে নরম ভাষায় দাওয়াত দেয়ার জন্য। এভাবে কোরআন-সুন্নাহর বিভিন্ন জায়গায় দাওয়াহ’র উপস্থাপন ভঙ্গি ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপের বিষয় শেখানো হয়েছে। আসলে প্রত্যেকটি ফরজ বিধান যেমন আগে শিখতে হয় তারপর পালন করতে হয়; তেমনিভাবে দাওয়াতের বিষয়টিও ঠিক একই রকম। আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, দাওয়াহ’র বিষয়ে নম্রতা, প্রাজ্ঞতা এবং সচেতনতা না থাকার কারণে বিভিন্ন সময় ওলামায়ে কেরামকে বিভিন্ন জটিলতায় পড়তে হয়। তাই ইফতা, উলুমুল হাদিসসহ অন্যান্য বিভাগের বিষয়ে যেভাবে মাদ্রাসাগুলো গুরুত্ব দিচ্ছেদ, সেভাবে যদি ‘দাওয়াহ’ বিভাগগুলো গুরুত্ব পায় তাহলে আমাদের দাওয়াতের ময়দানে চলমান সঙ্কট নিরসন সম্ভব হবে বলে মনে করি’- বলেন এই স্কলার।

তার মতে ‘একজন ছাত্র দাওরায়ে হাদিস পাশ করার পর কেন তাখাসসুস পড়বে? কে কোন বিষয়ে তাখাসসুস পড়বে? তা না জানার কারণে এই বিভাগগুলো অনেকটা খেল-তামাশায় পরিণত হয়েছে।’

এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় তিনি বলেন, ‘ইলমের তিনটি স্তর। এক. হল্লে কিতাব। দুই. হল্লে ফন। তিন. তাফাক্কুহ ফিদ্দ্বীন । এক্ষেত্রে তাখাসসুসের মূল লক্ষ্য হলো ফন বা শাস্ত্র ‘হল’ হওয়া। কেউ ইফতা নিয়ে তাখাসসুস করবে এর মানে হলো এ বিষয়ে সে প্রাজ্ঞ হয়ে উঠবে। এই শাস্ত্রে সে নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখবে। কিন্তু এখন প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র বিভিন্ন বিষয়ে তাখাসসুস সম্পন্ন করলেও হাতে গোনা কয়েকজন ‘মাহেরে ফন’ পাওয়া দুষ্কর।’

তিনি মনে করেন, ‘এক সময় ফারেগীন ছাত্ররা তাখাসসুস পড়ার জন্য যেত হলো সেই শাস্ত্রের অভিজ্ঞ আলেমদের কাছে। আর অভিজ্ঞ কেউ ছাড়া অন্যকেউ তাখাসসুস পড়ানোর বা সেই বিভাগ খোলার সাহসও করতো না। কিন্তু এখন এমন শিক্ষকরাও তাখাসসুস বিভাগ খুলে বসে থাকেন যিনি তাখাসসুসের কিতাবগুলোর এবারতও ঠিক মতো পড়তে পারেন না। এরফলে তাখাসসুস বিভাগগুলো একটি করুণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইফতা, আদব ও দাওয়াহ বিভাগগুলো এ জটিলতায় বেশি পড়ছে।’

‘এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে উদ্যোগ নিতে হবে দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডগুলোর। এটি হাইয়াতুল উলইয়ার তত্ত্বাবধানে হতে পারে। সকলে মিলে একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড দাঁড় করাবেন। যারা এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবেন একমাত্র তারাই তাখাসসুস বিভাগ খুলতে পারবেন। এর ফলে গড়ে উঠবে আমাদের সুন্দর আগামী’- মত দেন মুফতি আব্দুল মাজিদ।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর