শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ছোটবেলায় রোজার মাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সাইফুল্লাহ সুবহান।।

আমার যখন ছোটবেলা রোজায় তখন কনকনে শীত পড়ে। রোজা শুরুর আগেই মা শীতের কাপড় চোপড় ধুয়ে দেন। রোদে দেন লেপ কাঁথা।

রোজার দুএকদিন আগে বাবা ব্যগভর্তি রোজার বাজার নিয়ে আসেন। মুড়ি, বুট, গুড়, চিড়া, ডাল আর খেজুর। তেমন আহামরি কিছু না। তবু এসব নিয়েই আমাদের ভাইবোনের অন্তহীন উচ্ছাস। সবকিছু ব্যগ থেকে নামাই। নেড়েচেড়ে দেখি।

রোজার আগে আগেই একদিন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। সামনে অফুরন্ত ছুটি। সীমাহীন স্বাধীনতা। এই সুযোগে যাই নানাবাড়ি। নানাবাড়িই আমাদের ছোটবেলার প্রথম এবং একমাত্র ট্যুর স্পট। মা আমাদের সাথে যান না। মায়ের তখন অনেক ব্যস্ততা। রোজা আর শীতের প্রস্তুতি মিলে একাকার। দুদিন নানাবাড়ি বেড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসি।

স্কুল ছুটি থাকলে ব্যস্ততা বেড়ে যায় আমাদেরও। হেমন্তের ফসল তোলা হয়ে গেলে কেউ কেউ শীতের রবি শষ্য চাষে মনোযোগি হন। তবে অধিকাংশ ফসলি জমিই খালি পড়ে থাকে। গ্রামের ভাষায় এগুলোর নাম 'খিলক্ষেত'। এই 'খিলক্ষেত' ঘিরেই আমাদের সারাদিনের ব্যস্ততা। এই ক্ষেতই এখন আমাদের খেলার মাঠ। আমাদের চেয়ে বয়সে বড়রা কেউ কেউ এখানে ফুটবল ক্রিকেট খেলে। এসবে আমাদের আগ্রহ বা অধিকার কোনটাই নেই। আমরা দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বৌ ছি, কানা মাছি ভোঁ ভোঁ ইত্যাদি গ্রামীণ খেলায় মেতে দিন কাটিয়ে দেই।

একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি উঠোনে খেজুর পাতার স্তুপ। বুঝতে পারি সকাল সকাল গাছি এসেছে খেজুর গাছ 'ছোলতে'। গাছিকে আমরা বলি 'গাছ ছুলুইননা'। কেউ বলে 'শিউলি'। মুখ হাত না ধুয়েই দেই ছুট 'গাছি'র খোঁজে। ততক্ষণে অনেকগুলো গাছ 'ছোলা' শেষ। আর দুতিনটা মাত্র বাকি। এগুলো যতক্ষণ ছোলা না হয় গাছির পাছ পাছ থাকি। অবাক হয়ে তার হাতের কাজ দেখি। চকচকে একটা 'দা' (আমরা বলি 'ছেন') দিয়ে কি শিল্পিত উপায়ে তিনি গাছ কাটেন! শুষ্ক গাছে বইয়ে দেন সুমিষ্ট রসের ফোয়ারা। গাছ কাটা হয়ে গেলে গাছিকে বলে কয়ে একটা খেজুর ডালের লাঙ্গল বানিয়ে রাখি। কখনো আব্বাই বানিয়ে দেন। এই 'খেজুর ডালের লাঙ্গল' আমাদের ছোটবেলার বিনামূল্যের অমূল্য খেলনা।

সপ্তাহ দুয়েক পরে গাছে হাঁড়ি ঝোলে। বিকাল বেলা গাছি আসে গাছে হাঁড়ি দিতে। অদ্ভুত কায়দায় কোমরে হাড়ি ঝুলিয়ে তরতর করে গাছে ওঠে যান তিনি। গাছে হাঁড়ি দিয়ে আগের মতোই তরতরিয়ে নেমে আসেন। ভোরের আলো ফুটতেই আবার তার দেখা মেলে। গাছ থেকে রস ভর্তি হাঁড়ি নামিয়ে আনেন। এই দুই সময় আমরা সমবয়সী বন্ধুরা প্রায় তার সাথে গাছতলায় গাছতলায় ঘুরে বেড়াই।

গাছি সকাল বেলা হাঁড়ি নামিয়ে নিলেও গাছ থেকে রস পড়ে সারাদিনই। আমরা গাছের গোঁড়ায় গিয়ে হাঁ করে দাঁড়াই। ফোঁটা ফোঁটা রস খাই। কেউ কেউ এ সময় নিজস্ব কলসি, বোতল ইত্যাদি গাছের মুখে পেতে দেয়। এর স্থানীয় নাম 'ঝরা'। 'ঝরায়' জমা রসের নাস্তা খুব একটা স্বাদের হয় না কিন্তু এতে নিজস্বতার একটা প্রবল আনন্দ থাকে। ভীষণ আনন্দ!

প্রথম রোজার সেহেরির আয়োজনটা দোটানায় থাকে। আজ রোজার চাঁদ উঠবে কিনা এই নিয়ে দোদুল্যমানতা। চাঁদ দেখা গেলে মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয়। কাল থেকে রোজা। মা আর দাদি অযু করে নামাজে দাঁড়ান। সমবয়সী বন্ধুরা হল্লা করে মসজিদে যায়। সন্ধ্যার পর আমার বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। মসজিদে আর তাই যাওয়া হয় না। আমরা দুই ভাই-বোন মা আর দাদির সাথে নামাজে দাঁড়াই। তাদের সাথে নামাজের অভিনয় করি। তাদের নামাজ আর শেষ হতে চায় না। ছোট বোন একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। আমারও চোখ ঢুলু ঢুলু করে। মা আমাদের দুজনকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবার নামাজে দাঁড়ান। মায়ের নামাজ কতক্ষণ চলে কে জানে! আমি গভীর ঘুমে হারিয়ে যাই।

দীর্ঘ শীতের রাত নিটোল ঘুমে কেটে যায়। ভোর রাতে মায়ের ডাকে বা থালা বাসনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। জেগে দেখি বাবা দাদি সবাই পাতে বসা। ঘরের বিড়িলটাও আধবোজা চোখে বসে আছে পাশে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে মুখ হাত ধুয়ে আমিও সেহেরি খেতে বাবার পাশে এসে বসি। প্রথম রোজা রাখার প্রবল প্রতিজ্ঞা নিয়ে সেহেরি খাই। ছোট বোন হঠাৎ জেগে ওঠে কান্না শুরু করে। মা সেহেরি খাওয়া ছেড়ে তাকে সামলায়। সেও আমাদের সাথে সেহেরি খায়। বাবার পাশে বসা নিয়ে আমার সাথে খটমট করে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে এক দৌড়ে লেপের তল। আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়ে আজকে আমি রোজা। রোজার কথা মনে হতেই মুখে লালা জমে। থুতু ফেলতে ফেলতে গলা মুখ শুকিয়ে আসে। থুতু যদি পেটে চলে যায় রোজা তো তাহলে শেষ! ছোটবোনও রোজা রাখে। সকাল নয়টা কি দশটা পর্যন্ত। তারপর কিছু খেয়ে আবার রোজা রাখে। মা বাবা আমাকেও খেতে চাপাচাপি করেন। আমি কিছুতেই রাজি হইনা। দুপুরের দিকে শরীর খুব দুর্বল হয়ে আসে। আব্বা জোহর নামায পড়ে দুটি বন রুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। ছোটবোন তার ভাগের রুটি নিয়ে হেঁটে হেঁটে খায় আর বলে আমি রোজা। বাবা মা দাদি সবাই তার কথায় সায় দেয়। আমিও দেই।আব্বা আমাকে কাছে ডাকেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছোটদের রোজা একটা হয়ে যায় সেকথা বুঝান। আদর করে রুটি খাইয়ে দিতে চান। ক্লান্ত শরীরে আমি সহজেই আব্বার কথায় রাজি হয়ে যাই। রুটি খেতে শুরু করি।

সন্ধ্যায় সবার সাথে আমরা দুভাইবোনও ইফতারে বসি। খেজুর, মুড়ি-বুট-পেয়াজু, চিড়া গুড়ের শরবত, বাড়ির গাছের পেয়ারা, পেঁপে। ইফতারে আমাদের বাহারি আয়োজন। সব সামনে নিয়ে আজানের অপেক্ষায় বসে থাকি। হঠাৎ যেন সময় ধীর হয়ে যায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে আগায়। তারপর একসময় ভেসে আসে আজানের সুর। আমরা খেতে শুরু করি। খাই যা তার চেয়ে বেশি নষ্ট করি। খাওয়ার চেয়ে নষ্ট করাতেই যেন বেশি আনন্দ। এই নিয়ে মায়ের বকা শুনি, মার খাই। তারপর আবার যেই সেই!

একদিন ভোরে উঠে দেখি তখনও সূর্য ওঠেনি। চারিদিকে কেমন সন্ধ্যার মতো আবছায়া আলো আঁধার। নাজমুলদের বাড়ি যাই। সেখান থেকে নাজমুল সহ যাই রফিকদের কলমি ক্ষেতে। রফিকের দাদা বাড়ির পূবের ক্ষেতে কলমি শাক চাষ করেন। সকাল সকাল শিশির ধোয়া কলমি দেখতে অসাধারন লাগে। মাঝে মাঝে সাদা ও গোলাপি রঙের অসংখ্য কলমি ফুল ফোটে আছে। এগুলোর কোন কাজ নেই। আমরা তিনজনে সাধ্যমত ফুল তুলে যে যার মতো বাড়ি ফিরে যাই। এসে দেখি মা হাস মুরগির খোয়ার খোলেন। সেগুলোকে আদার (খাবার) খাওয়ান। সূর্য তখনও ওঠে না। তখনও সন্ধ্যার মতো আবছায়া আলো আঁধার। মা বলেন দূরে সমুদ্রে নিম্নচাপ উঠেছে। কিছুদিন সূর্য উঠবে না। সমুদ্রই ভালোমত চিনিনা। নিম্নচাপ তো অনেক পরের কথা। তবু সমবয়সীদের মাঝে জ্ঞান ফলাতে চেষ্টা করি। বুক ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করে সূর্য না উঠার নিজের মতো ব্যাখ্যা করি।

দেখতে দেখতে রোজা শেষের দিকে চলে আসে। আব্বা আমাদের নতুন জামা জুতো কিনে দেন। ঈদ পুরোনো হয়ে যাওয়ার ভয়ে সেসব আমরা সমবয়সীদের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখি। একেবারে ঈদের দিনে দেখানোর আশায় থাকি।
রোজার শেষের দিকে আসেপাশের বাড়ির দূরে থাকা আত্মীয় স্বজনরা বাড়ি আসতে শুরু করে। আনন্দে মুখরিত হয় পুরো এলাকা। বাতাসে বাতাসে বয়ে যায় আনন্দের আমেজ। একদিন সন্ধ্যারাতে ঘোষণা হয় শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে। আগামী কাল ঈদ। সমবয়সীরা হল্লা করে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। রোজা শেষ হয়ে যায়।

এনটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ