বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


এগিয়ে চলছে ফকীহুল মিল্লাত রহ. স্মারক গ্রন্থের কাজ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।কাউসার লাবীব।।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের উদ্যোগে এগিয়ে চলছে উপমহাদেশের বরেণ্য আলেম ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রাহিমাহুল্লাহ’র প্রামাণ্য স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের কাজ।

আওয়ার ইসলামের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ‘ফকিহুল মিল্লাত রহ.’ স্মারকগ্রন্থের সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক ও খানকাহে ইমদাদিয়া আশরাফিয়া আবরারিয়া জানেশীন মুফতি আরশাদ রাহমানী।

জানা যায়, গত ১৫ অক্টোবর (শুক্রবার) ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরায় খানকাহে ইমদাদিয়া আশরাফিয়া আবরারিয়া এর ১৮তম বার্ষিক ইহইয়ায়ে সুন্নত ইজতিমায় ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রাহিমাহুল্লাহ’র প্রায় তিন হাজার খোলাফা, শাগরেদ, শুভানুধ্যায়ী আলেমের মজলিসে স্মারকের উদ্যোগ গ্রহণ করায় আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান মুফতি আরশাদ রাহমানী। পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধানের কথাও জানান।

আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব জানান, গত ২০ অক্টোবর (বুধবার) ফকিহুল মিল্লাতের ছোট সাহেবজাদা মাওলানা শাহেদ রাহমানীর নেতৃত্বে মুফতি আব্দুর রহমান রহ. এর জন্মস্থান ও প্রথম কর্মস্থল বৃহত্তর চট্টগ্রাম সফরে যায় টিম আওয়ার ইসলাম। পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গ, ভোলা, ফেনী, নোয়াখালী কুমিল্লা ও ঢাকাসহ ফকীহুল মিল্লাতের স্মৃতিবিজরিত জায়গাগুলো সফর করেছে আওয়ার ইসলাম টিম। পর্যায়ক্রমে আওয়ার ইসলাম টিম পুরো দেশ ও দেশের বাইরে সফর করবে ইনশাআল্লাহ।

প্রসঙ্গত, ফকিহুল মিল্লাত রহ. এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রে স্মৃতি বা আলোকপাতধর্মী লেখা আমাদের পাঠাতে পারেন। অনুগ্রহ করে লেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবেন:

ক. ফকিহুল মিল্লাত রহ. এর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ কোনো স্মৃতি থাকলে তা উল্লেখ করুন। তাঁর জীবনের অনুসরণযোগ্য দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করুন।
খ. আপনি যদি তার সঙ্গে সফর করে থাকেন, বিশেষ করে হজ-ওমরার সফর; সে স্মৃতিকথাগুলো উল্লেখ করতে পারেন। আপনার চোখে তাঁর চরিত্রের আদর্শ প্রশংসনীয় দিকগুলো উল্লেখ করুন।
গ. আপনার সঙ্গে যদি ফকিহুল মিল্লাহ রহ. কোনো ইসলাহী সম্পর্ক থেকে থাকে; সে সম্পর্কে স্মৃতিগুলো জানাতে পারেন। তার কোনো কারামতে আপনি বিমোহিত হলে তাও জানাতে ভুলবেন না।
ঘ. আপনি যদি তাঁর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়ে থাকে; তাহলে তার দরস-তাদরিসের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে পারেন। উল্লেখ করতে পারেন দরসে ঘটে যাওয়া অনন্যকিছু ঘটনার কথা।
ঙ. তাঁর কোনো লেখা, বক্তৃতা, ক্যাসেট বা স্মৃতিচিহ্ন আপনার কাছে সংরক্ষিত থাকলে আমাদের অবহিত করুন।

আশা করি এই স্মারকগ্রন্থের জন্য আপনার একটি মূল্যবান লেখা পেয়ে আমরা ধন্য হবো। ব্যস্ততার কারণে লেখা তৈরির সময় বের করতে না পারলে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় দিলে আপনার সঙ্গে দেখা করে বা কথা বলে আমরাই লেখা তৈরি করে নেব ইনশাআল্লাহ। অথবা আপনি ইচ্ছে করলে আমাদেরকে আপনার স্মৃতিকথা বা অভিব্যক্তিগুলো রেকর্ড করে মেইল করতে পারেন (ourislammedia@gmail.com) বা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো (+৮৮০১৭২৬৬৮৮৬৮৬) অথবা অন্যকোনো উপায়ে আমাদের হাতে পৌঁছে দিতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম কাজে পরস্পরের সহযোগী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

উল্লেখ্য, মুফতি আব্দুর রহমান রাহিমাহুল্লাহ এদেশে ইহয়ায়ে সুন্নাত, ইলমের শুদ্ধ চর্চা ও ইসলামি ফিকহের সমৃদ্ধ পথযাত্রার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাজ্ঞ আলেম, যুগ সচেতন ফিকহবিদ ও বুদ্ধিদীপ্ত ইসলাহি মুরব্বি।

ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহ. ছিলেন হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা শাহ আবরারুল হক হক্কী হারদুয়ী রহ. এর শিষ্য ও খলিফা। প্রিয় শায়েখের পথ ধরে তিনি বিভিন্নভাবে দেশের মানুষের কাছে সুন্নতকে প্রিয় করে তোলার মিশনে অনন্য ভূমিকা রাখেন।

ইলমি অজ্ঞনে তাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় আভিজাত্য ও ব্যাপক সংস্কারের কারিগর ফকিহুল মিল্লাহ রহ.। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুচারুভাবে তিনি বহু ইলমি কাননের জিম্মাদারের দায়িত্ব পালন করেন। বহু মাদরাসায় তাঁর হাত ধরে শুরু হয় ‘হাদ্দাসানা’র অমীয় প্রতিধ্বনি। তাছাড়া এদেশে ইসলামি অর্থনীতির সোনালী যুগ তাঁর বিস্ময়কর আবিষ্কার।

যুগসচেতন আলেম ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহ.-এর জন্ম ১৯২০ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ইমামনগর গ্রামে। পিতা মো. চাঁন মিয়ার ঘর আলোকিত করে দুনিয়াতে আসা এই শিশু নাজিরহাট বড় মাদরাসা ও জামিয়া আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। হাটহাজারী মাদরাসায় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি উপমহাদেশের প্রাচীন ইলমি কানন দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। ১৯৫০ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে কওমি মাদরাসা পাঠ্যক্রমের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের ইফতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র তিনি।

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সম্পন্ন করে দেশে ফেরার পর ঐতিহ্যবাহী দীনি শিক্ষাকেন্দ্র আল-জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি উত্তরবঙ্গে গমন করে সেখানে বহু মসজিদ-মাদরাসা, মক্তব ও হিফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৮টি উত্তরাঞ্চলীয় জেলার সহস্রাধিক দীনি প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ (উত্তরবঙ্গ) এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

প্রথিতযশা প্রাজ্ঞ এই আলেমে দ্বীন উত্তরবঙ্গ থেকে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামের জামিয়া পটিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত একাধারে প্রধান মুফতি, সহকারী মহাপরিচালক ও শিক্ষা বিভাগীয় পরিচালকসহ দাওরায়ে হাদিসের সর্বোচ্চ কিতাব বুখারি শরিফের প্রথম খণ্ডের দরস দেন। তখন দেশব্যাপী একশ সদস্য বিশিষ্ট ইফতা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা ঢাকা, জামিআতুল আবরার বসুন্ধরা রিভারভিউ, মদিনাতুল উলুম মাদরাসা বসুন্ধরাসহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি চট্টগ্রামের ঐহিত্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুলকবহর মাদরাসা ও উত্তরবঙ্গেও বগুড়া জামিল মাদরাসার সরাসারি পরিচালক ছিলেন। এছাড়া দেশের শত শত মাদরাসার উপদেষ্টা ও মুরব্বি হিসেবেও তিনি কল্পনাতীত খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

পাশাপাশি তার ইলমের জৌলস ছড়িয়েছেন তিনি দেশের বাইরেও। বিশেষ করে মসজিদে নববীতে তার হাদিসের পাঠ দানের অধ্যায়টি ছিল অনন্য। বাংলাদেশের মুরব্বিগণের মধ্যে মসজিদে নববীতে বসে আরব ছাত্রদেরকে হাদীসের কিতাবাদীর দরস দেওয়ার ঘটনা বিরল। তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি প্রতিবছর রমজানে মসজিদে নববীতে আরব ছাত্রদেরকে হাদীসের কিতাবাদীর দরস দিতেন। সে কারণে বিভিন্ন মহলে শাইখুল হাদিস ফিল আরব ওয়াল আজম নামে পরিচিত ছিলেন।

তাছাড়া সেবমূলক কাজে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার বর্নীল জীবনের বড় একটি অধ্যায় ছিল খেদমতে খলক। তার এ কাজগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গড়ে তোলেন সেবমূলক সংস্থা ‘ফকিহুল মিল্লাহ ফাউন্ডেশন’। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য মসজিদ , মাদরাসা, মক্তব হেফযখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া তিনি উক্ত সংস্থার মাধ্যমে দেশের গরিব, মিসকিন, এতিম ছাত্রদের আহার-বিহার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। এছাড়া পাশে দাঁড়াতেন অভাবী আলেম-ওলামাদের।

ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহ. দেশে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও অনন্য অবদান রাখেন। দুনিয়াব্যাপী প্রচলিত সুদভিত্তিক অর্থনীতির স্থলে কীভাবে সুদবিহীন ইসলামী অর্থনীতি প্রবর্তন করা যায় সে বিষয়ে সবসময় গবেষণা চালিয়ে গেছেন। এছাড়া উচ্চতর জন্য গড়ে তুলেন ইসলামিক ফাইন্যান্সের ওপর স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয় ‘সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিকস বাংলাদেশে।’

তাছাড়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১৯৮৩ সালে স্থাপিত হলে কওমি অঙ্গন থেকে তিনিই প্রথম শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য মনোনীত হয়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি ২০০৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি মনোনীত হন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে। দীর্ঘদিন তিনি সেন্ট্রাল শরিয়া বোর্ড ইসলামিক ব্যাংকস-এর ভাইস চেয়ারম্যানের ছিলেন। ব্যাংক এশিয়ার শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করেন তিনি। আর অল্প সময়ের জন্য তিনি ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের শরিয়াহ উপদেষ্টা ছিলেন। মুফতি আবদুর রহমান রহ. আরব বিশ্ব তথা দুবাই, বাহরাইন, কাতার ইত্যাদি রাষ্ট্র এবং ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে বড় বড় ইসলামি অর্থনৈতিক সেমিনারে যোগ দেন এবং ইলমের জৌলুস ছড়ান।

যুগ সচেতন প্রতিভাবান এ আলেম ২০১৫ সালের এই নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিক। আমিন।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ