বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


আশরাফ আলী থানবি রহ: ব্যক্তি ও প্রভাব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইফতিখার জামিল ।।

শাহ ওয়ালি উল্লাহ-এর পরে, গত দেড়শ বছরে, দক্ষিণ এশিয়ায় আশরাফ আলী থানবিই ছিলেন সবচেয়ে বড় আলেম। প্রভাব ও উৎপাদনে তার ধারেকাছেও কেউ যেতে পারবে না। একটা ছোট দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা আরও ভালোভাবে ধরতে পারবেন, তকি উসমানীর প্রসিদ্ধি-প্রভাব এখন দুনিয়াব্যাপী।

তবে তার লেখাজোখা একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লে মনে হবে, তিনি মূলত থানবির বক্তব্য-ব্যাখ্যা সহজভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তকি উসমানী নিজেও এই বিষয়টি বিভিন্ন জায়গায় স্বীকার করেছেন।

তাসাউফ সংকলন-পরিমার্জনে থানবির ভূমিকার কোন তুলনা হতে পারে না। জালালুদ্দিন রুমির ওপর তিনি প্রায় সাত আট হাজার পৃষ্ঠার বিশাল ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখেছেন।

আল্লামা ইকবাল এক চিঠিতে লেখেন, রুমির বিষয়ে আশরাফ আলী থানবিই সবচেয়ে বড় জীবন্ত অথরিটি । থানবি কুরআন-হাদিসের আলোকে তাসাউফকে উপস্থাপন করেছেন। একজন সূফী সাধক কীভাবে মুরিদদের সংশোধন করেন, তার নমুনা মিলবে তরবিয়াতুল সালিকিনে। আমি জুনায়েদ বাবুনগরির কাছে কিতাব পড়ার বিষয়ে পরামর্শ চাইলে তিনি আত তাকাসশুফ ও আত তাশাররুফ পড়ার কথা বলেন। বস্তুত এই দুই কিতাবে তাসাউফের সারকথা চলে এসেছে।

কুরআন বিষয়েও থানবির বিশেষ আগ্রহ ছিল। গত শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাফসীরের একটি বয়ানুল কুরআন। দেওবন্দি ধারায় লিখিত পরবর্তী তাফসীরগুলো মূলত বয়ানুল কুরআনের ছায়া অনুবাদ।

উলুমুল কুরআন ও তাজবিদ বিষয়েও তার বেশকিছু কিতাব আছে। ফার্সি ও উর্দুতে রচিত পূর্ববর্তী অনুবাদে কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে, সে বিষয়ে তিনি বেশকিছু রিভিউও লেখেন। থানবি ইলমে কেরাআতের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এখন রুকইয়া-চিকিৎসার বহুল প্রচলন ঘটেছে, থানবি কুরআনি চিকিৎসা নামে আমালিয়াত বিষয়ে একটা নতিদীর্ঘ বই লেখেন।

ইলমে কালামে থানবির অবদান কোন অংশে কম নয়। আল ইনতিবাহাতুল মুফিদা গতশতকের আলোচিত কালামি কিতাবের একটি। ইউটিউবে সার্চ করলে অনেক আরব শায়েখের দরস পেয়ে যাবেন।

পাশাপাশি সমকালে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোও তিনি উত্তর দানের চেষ্টা করেছেন, একাধিক সংকলন বের হয়েছে। যুক্তির আলোকে ধর্মীয় বিধিবিধান তুলে ধরেছেন। ফিকাহে তার দক্ষতা ও প্রভাব তুলনাহীন। উসুলে ফিকাহ ও ইফতা বিষয়ক লেখাজোখা এখন সংকলিত হয়েছে, ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে ছয় খণ্ডে। ই’লাউস সুনান ও আহকামুল কুরআন রচিত হয়েছে তার নির্দেশনায়।

আশরাফ আলী থানবির সবচেয়ে বড় অবদান হয়তো রাজনৈতিক তত্ত্ব (Political theology)। পাকিস্তান তত্ত্বের রাজনৈতিক পরিগঠন হয়েছে ইকবাল-জিন্নাহের হাত ধরে, ফিকহি কাঠামো দান করেছেন আশরাফ আলী থানবি। শুধু তাই নয়, আলেম সমাজের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, তারা কতটুকু স্বতন্ত্র থাকবেন, কতটুকু সম্পর্ক রাখবেন, এই বিষয়েও থানবি বিশদ ব্যাখ্যা দান করেছেন।

এভাবে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বেও তার ভূমিকা অপরিসীম। যদি এক কথায় বলতে চাই, তাহলে বলতে হবে উপমহাদেশে ‘ট্র্যাডিশন’ এর বর্তমান কল্পনা ও কাঠামো অনেকটাই থানবির তৈরি।

তবে আপনারা যারা সালাফ-আকাবিরদের লেখা পড়ে অভ্যস্ত নন, তারা আশরাফ আলী থানবি থেকে উপকৃত হতে পারবেন না। একই কথা তকি উসমানী লেখলে ধরতে পারবেন, থানবি লেখলে বুঝতে কষ্ট হবে। কেননা থানবি আধুনিক রুচি-ভাষা-রচনাশৈলী অনুসরণ করেননি। প্রি-মডার্ন যুগের লেখালেখি হজম করা একটু কঠিন।

খোদ আবুল হাসান আলী নদবীর মতো ব্যক্তিত্বকেও এই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। যুবক বয়সে তিনি সাধারণত আরব ও পশ্চিমা ধারার লেখা পড়ে অভ্যস্ত ছিলেন। ইতিহাস, দর্শন ও সমাজতত্ত্ব তাঁকে টানত বেশী। তিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানির রাসায়েল পড়তে আগ্রহ বোধ করতেন না। বড় ভাইয়ের অব্যাহত চাপে তিনি একসময় রাসায়েল পড়েন, তার সামনে একটি নতুন জগত খুলে যায়।

সালাফ-আকাবিরদের লেখায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে, এতে দোষের কিছু নেই। যত্ন ও চেষ্টা ছাড়া কোনকিছুই সম্ভব নয়।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ