শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যা প্রবণতা: ‘সঠিক ইসলামি শিক্ষা ও চর্চার অভাব’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুদ্দীন তাসলিম।।

জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে তুচ্ছ কারণ, পারিবারিক কলহ এবং পরকীয়াসহ নারী ঘটিত কারণে ৭ হাজার ৩৯১টি আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করেছে পুলিশ।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোবাইল কিনে না দেওয়া, সামান্য বকাঝকা করা এসব তুচ্ছ কারণে কিশোর, কিশোরী ও তরুণ তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ১১ হাজার ১০৯টি। এসব অপমৃত্যুর মধ্যে ৭ হাজার ৩৯১টিই আত্মহত্যার ঘটনা। পুলিশ সদর দফতরের (অপরাধ) শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, তুচ্ছ কারণ ও পারিবারিক কলহ এবং পরকীয়াসহ নারী ঘটিত কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।

উদ্বেগজনকভাবে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়া পেছনে ইসলামী অনুশাসন থেকে মানুষের দূরে থাকাকে দায়ী করছেন রাজধানীর জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি মিযানুর রহমান কাসেমী

সাময়িক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে প্রাধান্য দিচ্ছে মানুষ

‘নগদ যা দেখছি সেটাই পেতে হবে; কোনো প্রত্যাশা স্বপ্ন  বাকির খাতায় রাখা যাবে না এমন মানসিকতা থেকেই এইসব দুর্ঘটনা ঘটছে’ বলেন তিনি।

‘পৃথিবীর সাময়িক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে প্রাধান্য দিয়েই মানুষ জীবন হননের যে পন্থা অবলম্বন করছে  এর জন্য হাদিসে কঠোর শাস্তির কোথায় এসেছে। বলা হয়েছে; যে যেভাবে আত্মহত্যা করবে তাকে সেভাবেই জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে’ বলেছেন এই ইসলামি চিন্তাবিদ।

আত্মহত্যাই কি সবকিছুর সমাধান?

কোন পরিস্থিতিই দীর্ঘস্থায়ী নয়, মানুষ যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সেটা আবার ঠিক হয়ে যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘যে সমস্যাকে বোঝা ভেবে মানুষ আত্মহত্যা করছে;  আত্মহত্যার পর কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে? অথবা যা না পাওয়ার কারণে এই অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে তা কি পেয়ে ফেলছেন আত্মহত্যাকারী? উল্টো পৃথিবীর আলো-বাতাস, আনন্দ উচ্ছ্বাস হারিয়ে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয়ে যাচ্ছেন’।

আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে ইসলামি সামাধান

‘ইসলামি শিক্ষা ও ইসলামি ন্যূনতম জ্ঞান থাকা আবশ্যক। আলেমদের সংস্পর্শ ও তাদের কাছে বেশি বেশি যাতায়াত, তাবলীগে সময় দেওয়া এসব অবৈধ কাজ ও পরকালেল শাস্তি থেকে মানুষকে বাঁচানোর মাধ্যম’ বলে মতামত দিয়েছেন মুফতি মিযানুর রহমান কাসেমী।

‘অভিভাবকের উচিত জুমার দিনে সন্তানকে নিজের সাথে তাড়াতাড়ি মসজিদে নিয়ে যাওয়া। যেন সপ্তাহে একদিন হলেও দ্বীনি কথাবার্তা শুনতে পারেন শিশু-কিশোররা। বাড়িতেও ইসলামি তালিমের পরিবেশ চালু করা প্রয়োজন’পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এই ইসলামী চিন্তাবিদ আরো পরামর্শ দিয়েছেন, ‘পৃথিবীর সব চাওয়া পাওয়াকেই চূড়ান্ত ও জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে নেওয়ার যে মানসিকতা তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’।

দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে আলেমদেরও

তিনি আরো সংযোগ করেছেন, ওলামায়ে কেরামের উচিত ইলমি খেদমতের পাশাপাশি মসজিদ-মাদরাসার বাইরেও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ থেকে বের হয়ে সামাজিক সেবা ওয়াজ-মাহফিলসহ যেসব মাধ্যমে মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায় সে পন্থাগুলো অবলম্বন করা। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা; জাগতিক মোহ-মায়া ছাড়াও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধের পরে এক জগত আছে যার শুরু আছে, শেষ নেই।

ইসলামী চিন্তাবিদ আরো বলেছেন, ‘আলেমদের উচিত; ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মানুষকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে দেখানোর চেষ্টা করা’। ওরাসাতুল আম্বিয়া হিসেবে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা’।

জীবনের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ যখন তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য স্থির করবে তখন হতাশায় আত্মহত্যা এসব অবৈধ পন্থা কখনোই অবলম্বন করবে না। কারণ তার সামনে একটি লক্ষ স্থির রয়েছে। সে এ পথ ধরেই  এগোবে এখানে হতাশার কিছু নেই তার’।

আত্মহত্যার ক্ষেত্রে একটি কঠিন ব্যাপার হল, একজন মানুষের আত্মহত্যার কারণে তার পরিবার, বন্ধু , আত্মীয়-স্বজন, মিলিয়ে প্রায় ১৫০ জন মানুষ এতে ভোগেন। বিভিন্ন সংস্থা, টিভি, পত্রিকাও এর মধ্যে জড়িত থাকে। তাই করো মাঝে এধরণের আত্মঘাতী প্রবণতা দেখা দিলে সে বিশেষজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন হতে পারে, এছাড়া  মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারে বলেও পরামর্শ ইসলামি চিন্তাবিদদের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। এছাড়া প্রতি বছর ১০ লাখ মানুষ মারা যান এই আত্মহত্যায়। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ নানা মানসিক চাপ থেকে আত্মহত্যা করে থাকে। দেশে প্রতিদিন ত্রিশজন মানুষ আত্মহত্যা করেন বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালে এক বছরে বাংলাদেশে ১১০০ মানুষ আত্মহত্যা করেছে।

সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি জোর

এদিকে এ বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মো. ফারুক আলম জানালেন , সাধারণত টিনএজারদের মধ্যেই আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কারণ এই সময়ে তাদের নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক-হরমোনাল পরিবর্তন হয়। বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে সঠিক আচরণ করা অনেকের জন্যই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিষন্নতা দেখা দিতে পারে, তৈরি হতে পারে অস্থিরতা। অনেক সময় তাদের আবেগ, হতাশা অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গিয়ে আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নেওয়ার চিন্তা করে।

এ ধরনের অবস্থা থেকে টিনএজারদের বের করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে সবার মধ্যেই সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি জোর দেন তিনি।

তিনি বলেন, সমাজের অনেক বিষয় দেখে বা জেনে টিনএজাররা প্রভাবিত হয়, যেমন একটি ঘটনা তাদের মধ্যে ভালো কাজ করার প্রভাব তৈরি করে, ঠিক তেমনি কোনো নেতিবাচক ঘটনা থেকেও একই ধরনের পথ বেছে নেওয়াকেই তারা মুক্তির পথ ভেবে নেয় অনেক সময়।

পুলিশের পরিসংখ্যান

প্রসঙ্গত, পুলিশের পরিসংখ্যান মতে, জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করা ভিক্টিমদের মধ্যে ৫২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৮ শতাংশ নারী। আত্মহত্যা করা এসব ভিক্টিমের ৬০ শতাংশই আত্মহত্যা করেছে গলায় ফাঁস দিয়ে। বিষপানে আত্মহত্যা করছে প্রায় ২৬ শতাংশ। গায়ে আগুন দিয়ে ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আত্মহত্যা করা এসব ব্যক্তির মধ্যে ২৫ শতাংশরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় ৩৮ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রায় ২২ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের বয়স ৪৬ থেকে ৬০ বছর। ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক আছেন ৫ শতাংশ। পুলিশ সদর দফতর আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কর্মশালা করার নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেক জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (ক্রাইম) নেতৃত্বে মামলাগুলো পর্যালোচনা করে কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে বলেছে। পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি, অপারেশন, প্লানিং ও মিডিয়া) মো. হায়দার আলী খান আত্মহত্যার প্রবণতা রোধকল্পে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

আরো পড়ুন: ঘরবন্দি শিশুরা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানসিক বিকাশ

এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ