বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


বাংলাদেশের সত্যিকারের গর্ব: কাবার গিলাফের ক্যালিগ্রাফার মুখতারের সৌদির নাগরিকত্ব ও বিরল অর্জন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলী হাসান তৈয়ব।। ভাবতে পারেন-সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মক্কায় গিয়ে আবেগভরে যে কাবাঘর দেখে, পৃথিবীর সর্বত্র সে কাবাঘরের ছবির সয়লাব, সে কাবার কালো গিলাফের যে ক্যালিগ্রাফিগুলো সবার বিস্ময়ভরা মুগ্ধতা বয়ে আনে, সেটি একজন বাংলাদেশি হাতের কাজ! হ্যাঁ, তিনি আমাদের বীর চট্টলার গর্বিত সন্তান প্রফেসর মুখতার আলম শিকদার।

এই অনন্য কৃতিত্ব গোটা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। গত বৃহস্পতিবার সৌদি বাদশাহর এক রাজকীয় নির্দেশনায় বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানজনক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন পেশার দক্ষ বিদেশি নাগরিকদের সৌদি আরবে নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণার পর প্রথম দিনেই নাগরিকত্ব লাভ করেন বাংলাদেশের এই কৃতী সন্তান। তাদের মধ্যে প্রথম দিন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ইতিহাসবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক, বিনিয়োগকারক, প্রযুক্তিবিদ, ক্রীড়াবিদসহ পাঁচ বিদেশি নাগরিক আছেন।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন পেশার দক্ষ বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার এ রাজকীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়। সৌদি সংবাদমাধ্যম আশ-শারকুল আওসাতের বরাত দিয়ে সৌদি গেজেট জানায়, নাগরিকত্ব পাওয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন-পবিত্র কাবার গিলাফের (কিসওয়া) প্রধান ক্যালিগ্রাফার মুখতার আলম, ইতিহাসবিদ ড. আমিন সিদো, ড. আবদুল করিম আল সামমাক, প্রখ্যাত গবেষক ড. মুহাম্মদ আল-বাকায়ি ও প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী সামান আল-আনি।

এরপর থেকেই তিনি প্রশংসায় ভাসছেন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। আরবি-ইংরেজি মিডিয়াগুলোয় শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে সংবাদ ও ফিচারের হিড়িক। ইউকিপিডিয়াসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন তথ্যভান্ডারে যুক্ত হয়েছে মুখতারের জীবনী। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ভিডিও ডকুমেন্টারি। টুইটার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছাত্র ও ভক্তরা ছবিসহ প্রশংসা ও দোয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন।

সৌদি গেজেটের প্রতিবেদনে মুখতার আলমের পরিচয়ে বলা হয়, মুখতার আলম বর্তমানে মক্কার কিসওয়া (কাবার গিলাফ) কারখানায় পবিত্র কাবার কিসওয়ার প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও ফোরামে তার প্রধান ক্যালিগ্রাফিগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি দক্ষতাবিষয়ক প্রশিক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পাঠদান করেন। মক্কার দ্য ইনস্টিটিউট অব হলি মস্ক তথা পবিত্র মসজিদুল হারাম পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফি-বিষয়ক তার পাঠ শেখানো হচ্ছে। বিভিন্ন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে মক্কার যত ক্যালিগ্রাফার ও হস্তলিপিকার আছেন, তারা অধিকাংশই তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাত্র।

মুখতার আলম মক্কার বিশ্বখ্যাত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পিএইচডি গবেষণারত। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সার্টিফিকেটের ক্যালিগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও প্রশংসার সনদ পেয়েছেন তিনি।

এদিকে রোববার সম্মানজনক সৌদি নাগরিকত্ব লাভের জন্য হারামাইন শরিফাইন পরিচালনা অধিদপ্তর তাকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা দিতে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে মক্কা-মদিনা অধিদপ্তরের প্রেসিডেন্ট ও মক্কার গ্র্যান্ড ইমাম প্রফেসর ড. শায়খ আবদুর রহমান সুদাইস অধ্যাপক মুখতারের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়ার পর বক্তব্যে শায়খ মুখতারের নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র আরবি ক্যালিগ্রাফি একাডেমি এবং কাবার গিলাফের ক্যালিগ্রাফি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য প্রপোজাল তৈরির আদেশ দিয়েছেন।

শৈশব থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি আগ্রহী শায়খ মুখতার সৌদি আরবারিয়া টিভিকে জানান, ছোটবেলায় প্রাথমিক স্তরে পড়ার সময় থেকেই তার ক্যালিগ্রাফির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। এমনকি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি অন্যদের ক্যালিগ্রাফি শেখাতেন। তাছাড়া সেই ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন স্থানে ক্যালিগ্রাফি শেখাতেন ও ক্লাস করাতেন।

জানা যায়, মুখতার আলম শিকদার ১৩৮২ হিজরি (আনুমানিক ১৯৬২ সাল) চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের রশীদের ঘোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

সৌদি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ১৩৯৮ হিজরি সালে তিনি মক্কার স্থানীয় একটি হিফজ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে মাত্র ৯ মাসে পুরো পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। মক্কাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা শেষে ১৪১৩ হিজরি সালে মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে স্নাতক করেন। ১৪২২ হিজরি তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৪১৬ সাল থেকে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৪২৩ হিজরি থেকে তিনি পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ (কিসওয়া) প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আরবি ক্যালিগ্রাফি পেশায় তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত কাজ করছেন।

মুখতারের বাবার নাম মুফিজুর রহমান বিন ইসমাঈল শিকদার। মায়ের নাম শিরিন বেগম। তার বাবা কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি দীর্ঘ সময় সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফার্মাসিস্ট হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। মূলত বাবার কর্মসূত্রে পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ সময় সৌদিতে কাটিয়েছেন। পরিবারে মুখতারের চার ভাই ও এক বোন। বর্তমানে মুখতার তার মা, স্ত্রী ও চার মেয়েকে নিয়ে মক্কায় বসবাস করেন।

শুক্রবার স্থানীয় চ্যানেলে মুখতারের পরিবারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শায়খ মুখতারের মেয়েরা এ জন্য প্রথমত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং দ্বিতীয়ত সৌদি বাদশাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন, আমরা কখনও কল্পনাও করতে পারতাম না যে, মক্কার প্রিয়ভূমি ছেড়ে চলে যাব। আজ বাবাকে নাগরিকত্ব দেওয়ায় উদ্বেগ দূর হলো এবং বাংলাদেশি হিসেবে গর্বে বুক উঁচু হয়ে উঠল।

সূত্র: বিভিন্ন আরবি, ইংরেজি ও বাংলা সংবাদমাধ্যম অবলম্বনে

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ