মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


‘প্রশিক্ষণ ছাড়াই মাদরাসায় শিক্ষকতা, আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে একজন শিক্ষক তার জীবনের দীর্ঘ এই সফরে হয়ে ওঠেন সমৃদ্ধ, পরিপক্ক। শিক্ষার্থীকে দেখাতে পারেন জীবনের সঠিক দিশা। বলতে গেলে কওমি মাদরাসায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি অনেকটা অবহেলিত। তবে বর্তমানে এ বিষয়টি অনেকটাই চর্চায় আসতে শুরু করেছে। এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক মাওলানা শিব্বির আহমদ। তিনি দায়িত্ব পালন করছেন বেফাকের প্রধান শিক্ষক প্রশিক্ষক হিসেবে। তার নিজেরও আছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এছাড়াও তিনি নোয়াখালীর চরমটুয়া দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়ে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আওয়ার ইসলামের সম্পাদক মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব


[caption id="" align="alignnone" width="300"]No description available. মাওলানা শিব্বির আহমদের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় আওয়ার ইসলাম সম্পাদক মুফতি হুমাযুন আইয়ুব। ছবি: আওয়ার ইসলাম।[/caption]

আওয়ার ইসলাম:  নবীন ফারেগীনরা ফারেগের সাথে সাথেই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, নতুন অথবা পুরাতন  যারাই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হচ্ছেন তাদের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: ড্রাইভিং ছাড়া যেমন ড্রাইভার হওয়া যায় না ঠিক তেমনি প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। সরকার এই বিষয়টি প্রমাণ করেছে, যেমন কেউ এমএ  পাশ করলেই শিক্ষক হতে পারে না, তার জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

পৃথিবীর যে কোন চাকরি করতে গেলে তাকে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যই বলতে হয়; আমাদের কওমি মাদরাসাগুলোতে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষকতা চলছে। এর মাধ্যমে আমাদের যে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে বের হচ্ছে তাদের অনেকেই অযোগ্য হয়ে বের হচ্ছে। বলা যায় এতে করে শিক্ষার্থীরা পঙ্গু হচ্ছে। শতকরা ৫ জন যোগ্য হয়ে বের হচ্ছে। এটা জাতীয়ভাবে আমাদের জন্য এক ধরনের ব্যর্থতা বলা যায়।

আওয়ার ইসলাম: প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষকতার কারণে শিক্ষার্থীরা পঙ্গু হয়ে বের হচ্ছে- এ প্রশ্নটা আপনি কার কাছে করবেন?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: জাতির ওলামায়ে কেরামের কাছে। জাতির ওলামায়ে কেরামের কাছে আমি শুধু বলব না, বারবার বলেছি, বলছি। আমি নিজের পয়সা খরচ করে পুরো দেশে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এ বিষয়ে বাংলা ও উর্দুতে আমি বইও লিখেছি। বাংলা ভাষার বইটি এখনো প্রকাশ হয়নি; তবে উর্দু ভাষার বইটি প্রকাশ হয়েছে। সেখানে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি।

আওয়ার ইসলাম: প্রশিক্ষণ কি শুধু নবীনদের জন্য প্রয়োজন নাকি সব বয়সের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: প্রশিক্ষণ নবীন-প্রবীণ সবার জন্যই প্রয়োজন। বিশেষ করে যে ক্লাসগুলোতে যোগ্যতা তৈরি হয় অর্থাৎ যারা নাহবেমীর, হেদায়াতুন্নাহু জামাতের শিক্ষক তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ফরজ।

যারা হাদিস-তাফসির এই বিষয়গুলোর শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন, তাদের যোগ্যতা তৈরি করা হয় না; বরং তাদের যোগ্যতা দিয়ে কাজ নেওয়া হয়। এই বিভাগের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না নিলেও চলে। তাদের শুধু জরুরী বিষয়গুলো বোঝা প্রয়োজন। এই বিভাগের শিক্ষকদের কাজের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। প্রশিক্ষণ নবীন শিক্ষকদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং নাহু সরফ; যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা যোগ্য হয়ে উঠেন এই বিভাগের শিক্ষকদের জন্য  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. মারকাযুদ দাওয়াহতে এসেছিলেন। তাকে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিভাগ ঘুরেফিরে দেখানো হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, আপনাদের কি হলো ফাউন্ডেশনের ঘরগুলো পড়ে যাচ্ছে, অথচ আপনারা দোতলা তিনতলা নিয়ে ব্যস্ত।

মারকাযুদ দাওয়াহতে ভর্তিচ্ছুকদের প্রায় ১০০ জনের মধ্যে বাছাই করে চারজন নেওয়া হয়। এতেই বোঝা যায় আমাদের ফাউন্ডেশন ও যোগ্যতার দিকটি কতটা দুর্বল। অথচ এ নিয়ে ফিকির নেই।

আওয়ার ইসলাম: এ বিষয়ে বেফাক ও হায়াতুল উলিয়ার নীতি-নির্ধারকদের কাছে আপনার কোন প্রস্তাব আছে কি না?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: অবশ্যই এ নিয়ে তাদের কাছে আমার প্রস্তাবনা আছে। সবাইকে আমি মুখে বলেছি, যাত্রাবাড়ী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা মাহমুদুল হাসানসহ বড় বড় অনেকের কাছে কিতাবের মাধ্যমেও আহ্বান পৌঁছিয়েছি।

আওয়ার ইসলাম: হায়াতুল উলিয়ার বা বেফাকের নেতৃবৃন্দের কাছে কি দাবি জানাবেন আপনি?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: দাবি হল; প্রশিক্ষণ ছাড়া কোন শিক্ষক রাখা হবে না। যারা আগে শিক্ষক হয়ে গেছেন তারাও প্রশিক্ষণ নেবেন। যারা অনেক প্রবীণ হয়ে গিয়েছেন তারা না নিলেও চলবে অথবা তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। নবীন যারা শিক্ষক হতে চাচ্ছেন তাদের জন্য প্রশিক্ষণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মূল্যায়ন এবং তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোও আমার দাবি।

আওয়ার ইসলাম: শিক্ষকদের জন্য মৌলিক কোন কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম বিষয় হলো, পাঠদান পদ্ধতি। দ্বিতীয় বিষয় হল, নাহু সরফ। তৃতীয় হল, ছাত্রদের কিভাবে মুত্তাকী , পরহেজগার, আল্লাহওয়ালা বানাবে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন। সবগুলো বিষয়ই আমি আমার কিতাবে বিস্তারিত লিখেছি।

আওয়ার ইসলাম: বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের শাসনের জন্য বেত ব্যবহার করা হয় এ বিষয়টিতে আপনার মতামত?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে আমার কিতাবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেতের কোন ব্যবহার নেই। শিক্ষার্থীদের মন জয় করে তাদের বুঝাতে হবে। আকাবিরদের বিভিন্ন ঘটনা বলে, উপদেশ নসিহতের মাধ্যমে ইলমে দ্বীনের গুরুত্ব বোঝাতে হবে তাদের। আদর যত্ন আপ্যায়নের মাধ্যমে তাদের আপন করে নিতে হবে। তারা যেন পড়াশোনাকে সহজ মনে করে- এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে আমার কিতাবে।

আওয়ার ইসলাম: আপাতত আপনি একাই এ কাজটি করে যাচ্ছেন?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: আমি এখন একা কাজটা করছি এবং লোক তৈরি করছি। তবে এ বিষয়ে এখনো তেমন কিছু করতে পারিনি। এর কারণ হচ্ছে; আমাকে যথেষ্ট পরিমাণ সময় দেওয়া হয় না। দেখা গেছে; কোনো একটি বিষয়ের জন্য দুই বছর, এক বছর অথবা ছয় মাস সময় প্রয়োজন। কিন্তু আমাকে ছয় মাসের জায়গায় মাত্র ৬ দিন সময় দেওয়া হয়। এতে করে আমি আমার সব ধরনের কথা বলতে পারছি না, সময় স্বল্পতার কারণে অন্যরাও নিতে পারছে না, বিষয়টা বুঝতে পারছে না। এছাড়া এতোদিন বিষয়টা লিখিত আকারেও ছিল না। বিষয়টির খুব একটা মূল্যায়ন করা হয়নি তাই এতে খুব একটা ফায়দাও হয়নি।

তবে একেবারেই ফায়দা হয়নি তা আমি বলবো না; কিছু কিছু মাদরাসায় এই বিভাগ চালু হয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ চান। তবে বিষয়টি একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যাপকতা পায়নি।

[caption id="" align="alignnone" width="317"]No description available. আওয়ার ইসলামকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন বেফাকের প্রধান শিক্ষক প্রশিক্ষক মাওলানা শিব্বির আহমদ। ছবি: আওয়ার ইসলাম।[/caption]

এ নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও ছিল না বাংলাদেশে। তবে আমি নোয়াখালীতে মাত্র একটা কেন্দ্র করেছি। আদর্শ মাদরাসা করেছি। সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি দেখিয়েছি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাকে বলে।

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমন পদ্ধতি তৈরি করেছি এর ফলে হেদায়েতুন্নাহু পড়ে প্রত্যেকটি ছেলে সহিহভাবে এবারত  পড়তে পারবে, অর্থ বের করতে পারবে। পুরো দেশে আমি এই বিষয়টি চালু করেছি; কেউ আমাকে সাপোর্ট দেয়নি। এখন বেফাকের পক্ষ থেকে পুরো দেশে কেন্দ্র ও প্রশিক্ষক দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তারা আমার কাছ থেকে লোক চাচ্ছে। আমি তাদের বলেছি সারাদেশে অনেক যোগ্য মানুষ আছে আপনারা সবাইকে ডাকুন, আমি তাদের হাতে বই দিব, এতে পুরো দেশে অসংখ্য যোগ্য প্রশিক্ষক তৈরি হবে।

আওয়ার ইসলাম: কত বছর ধরে এই কাজ করছেন?

মাওলানা শিব্বির আহমদ: ৪৫ বছর ধরে এই কাজ করে আসছি।  হাফেজ্জী হুজুর রহ. ও  ওলামা বাজার হুজুরের (মাওলানা সাইয়েদ আহমাদ রহ.) নির্দেশে এই কাজ করে আসছি।

আওয়ার ইসলাম: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। পুরো দেশে আপনার এই প্রচেষ্টা সফলতা পাক এই কামনা।

মাওলানা শিব্বির আহমদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ বিষয়টি তুলে ধরার জন্য। আপনাদের সফলতা কামনা করছি।

শ্রুতি লিখন নুরুদ্দীন তাসলিম।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ