বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


রিসালাতুল খাইর-এর জাতীয় সীরাত কনফারেন্স ২০২১; কিছু উপলব্ধি ও কিছু অনুভূতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী।।

গতকাল ৫ নভেম্বর, মোতাবেক ২৮ রবিউল আউয়াল, জুমাবার বিকেল ৩টা থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় সীরাত কনফারেন্স ২০২১। অনুষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতায় করেছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহি মানবিক সংস্থা ‘‘আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন’’ এবং ব্যবস্থপনায় ছিলো গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ‘‘রিসালাতুল খাইর’’।

“আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন” ও ‘‘রিসালাতুল খাইর’’ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : “আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন” ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি মানবিক সংস্থা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি কর্মচঞ্চল ও কর্মযজ্ঞ মানবিক এ সংস্থা মানবসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছে। কল্যাণকামী, সমাজসেবী ও শিক্ষাবান্ধব সংস্থা হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন। সৃজনশীল, মননশীল কর্মেও এ প্রতিষ্ঠানের অবদান সর্বজনবিদিত। চিকিৎসাবঞ্চিত জনপদে স্বাস্থ্যসেবা, দুঃস্থ ও বেকার পুনর্বাসন, মসজিদ, মাদরাসা, অজুখানা, গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপন এবং ইয়াতিম-বিধবা-প্রতিবন্ধীদের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে এ দুর্যোগ-দুর্দিনেও মানুষের পাশে ছায়া হয়ে থাকছে আখাফা। সুন্দর, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নে পথ চলছে এ সংগঠন। আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন ইতিমধ্যে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এর উল্লেখযোগ্য একটি হলো রিসালাতুল খাইর। মানসম্মত শিক্ষা, জীবনগড়ার নৈতিক উপাদান ও চরিত্রবান মানুষের সান্নিধ্য নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জে এবং পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা, সময়ের ভাষা ও বিরাজমান সংকটের উৎস আর কারণ চিহ্নিত করার মাধ্যমে মানবতার সুদিন ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে রিসালাতুল খাইর স্বপ্ন আর অঙ্গীকার নিয়ে পথচলা শুরু করেছে।

গতকালের সীরাত অনুষ্ঠানের যখন প্রবেশ করি, তখন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক শ্রদ্ধেয় মাওলানা কবি মুসা আল-হাফিজ (হাফি.) আলোচনা করছেন। তখন বঙ্গবন্ধু হলটি কানায় কানায় ভর্তি। অনেক দর্শক দাড়িয়ে দাড়িয়ে আলোচনা শুনছেন। এমন সময় হলে ঢুকতেই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা সুহাইল সালেহ (হাফি.)-এর দৃষ্টি নিবিষ্ট হয় অধমের প্রতি। তিনি লোক পাঠিয়ে মঞ্চে নিয়ে যান। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। শ্রদ্ধেয় মাওলানা মুসা আল-হাফিজের মুক্তার মতো কথাগুলো শুনে মনে হলো, সীরাত নিয়ে গবেষণার নতুন এক দিগন্ত সূচিত হলো।

তিনি বলেন, হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সীরাতের দু’টি দিক রয়েছে। একটি হলো, তিনি মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ। আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিশ্বস্ত সন্তান। তাঁর সীরাতের আরকেটি দিক হলো, তিনি ছিলেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অর্থাৎ তিনি আল্লাহর বিধান নিয়ে এসেছেন। তাঁর বিধান-ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে মানবজাতিকে।

বর্তমানে অন্যরা তাঁকে মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ হিসেবে উপস্থাপন করতে খুব আগ্রহ দেখায়। এ নিয়ে তারা বিশাল বিশাল সীরাতগ্রন্থও রচনা করেছে। কিন্তু তাদের আপত্তি হলো, তাঁকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে মানা যাবে না। বরং সীরাতের এ দিকটি নিয়ে তারা বহু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তাই তারা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ নিয়ে কিছু প্রশংসা করলেও তাঁর জীবন-আদর্শের উপর মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে।

অনেকেই এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। তাই তারা সীরাত চর্চা করতে গিয়ে ওদের উদৃতি পেশ করেন। তাদের বিভিন্ন বইয়ের খণ্ডিত দু’একটি লাইন উল্লেখ করেন। অথচ এই বইগুলোতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সীরাতের উপর যে পরিমাণ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে এবং যেভাবে বিকৃত করে রাসুল্লাহ সা.-এর জীবনকে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা যদি জানতো, তাহলে তাদের এই নাপাক নামগুলো উচ্চারণ করতেও লজ্জাবোধ করতো। তাই রাসূলুল্লাহ সা. এর সীরাতের নামে আমাদেরকে এগুলো কী খাওয়ানে হচ্ছে? তা ভেবে দেখা দরকার।

যদি শ্রদ্ধেয় মাওলানা মুসা আল-হাফিজের আলোচনায় শুরু থেকে থাকা হতো, হয়ত তাঁর জ্ঞান সমৃদ্ধ আলোচনা থেকে আরো অনেক উপকৃত হওয়া যেতো। আল্লাহ তাঁকে উত্তম জাযা দান করুন।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ এর আলোচনা: শ্রদ্ধেয় মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ একজন বিশ্বচিন্তক আলেমে দ্বীন। তারুণ্যের অহংকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিষয় নির্বাচন, শব্দ চয়ন ও উপস্থাপনে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। তাঁর আলোচনা শুনে অভিভূত হতেই হয়। তিনি নিজেদের কোন প্রোগ্রামে হোক, কিংবা অন্যদের সাথে টকশো আলোচনায় হোক; একদম মূল পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করতে পারদর্শী। গতকালও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সময় উপযোগী তাঁর সীরাত আলোচনাটি সীরাত গবেষকদের জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। তিনি সীরাত চর্চাকে ‘খনিজ সম্পদ’ অন্বেষণ আখ্যা দিয়েছেন।

বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও সীরাত চর্চার প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন। এ সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের ধর্ম চর্চার ব্যবস্থা থাকলেও সীরাত চর্চার কোন সুযোগ না থাকায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, সীরাত শুধুমাত্র আখেরাতের সফলতার জন্য প্রয়োজন নয়; বরং পার্থিব উন্নতির জন্যও সীরাত চর্চার প্রয়োজন রয়েছে।

আজকের দূর্নীতি দমনের জন্য সরকার অনেক কিছু করছে। কিন্তু দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। একেকটি ঘটনা যখন প্রকাশ পায় তখন দেখা যায় শতকোটি টাকার দূর্নীতির বিষয় চলে আসে। বাংলাদেশের একটি চ্যানেলের বার্তা সম্পাদকের গোপন ঘটনা প্রকাশ পেল। তারা তো নারী অধিকারের ধ্বজাধারী। অথচ পর্দার আড়ালে তারাই নারীদেরকে দাসীর মতো ব্যবহার করছে। এগুলো সীরাত চর্চা না করার ফসল। কারণ, সীরাতে এমন এক শক্তি রয়েছে যে, যা দ্বারা মুর্হূতেই মানুষের মন-মস্তিষ্ক বদলে দেয়া যায়।

যেমন : সম্পদের লোভ-লিপ্সা কমানোর জন্য রাসূলুল্লাহ সা. হযরত হাকীম বিন হিযাম রা.-কে মাত্র একটি কথা বলেছেন। যখন তিনি একশটি উষ্ট্রি পাওয়ার পরও আবার চাইলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা. তাকে কোন আদেশও দেননি। কেবলমাত্র তিনি বলেছেন, “ওহে হাকীম! এই মাল তরোতাজা মিষ্টি (ফলের মত)। সুতরাং যে তা নিজের প্রয়োজন মত গ্রহণ করবে, তাকে তাতে বরকত দান করা হবে। পক্ষান্তরে যে মনে লোভ রেখে তা গ্রহণ করবে, তাকে তাতে বরকত দেওয়া হবে না”। এই কথার মাধ্যমে তাঁর জীবনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা ইতিহাস হয়ে আছে। তিনি আমৃত্যু কখনো কারো কাছ থেকে কোন কিছুই গ্রহণ করেননি। এ পরির্বতনের শক্তি একমাত্র রাসূলের সীরাতেই রয়েছে।

عن الزهري عن عروة بن الزبير، وسعيد بن المسيب، أن حكيم بن حزام رضي الله عنه، قال: سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم، فأعطاني، ثم سألته، فأعطاني، ثم سألته، فأعطاني ثم قال: "يا حكيم، إن هذا المال خَضِرَةٌ حلوة، فمن أخذه بسخاوة نفس بورك له فيه، ومن أخذه بإشراف نفس لم يبارك له فيه، كالذي يأكل ولا يشبع، اليد العليا خير من اليد السفلى"، قال حكيم: فقلت: يا رسول الله، والذي بعثك بالحق لا أرزأ أحداً بعدك شيئاً حتى أفارق الدنيا، فكان أبو بكر رضي الله عنه، يدعو حكيماً إلى العطاء، فيأبى أن يقبله منه، ثم إن عمر رضي الله عنه دعاه ليعطيه فأبى أن يقبل منه شيئاً، فقال عمر: إني أشهدكم يا معشر المسلمين على حكيم، أني أعرض عليه حقه من هذا الفيء فيأبى أن يأخذه، فلم يرزأ حكيم أحداً من الناس بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى توفي. صحيح البخاري 2/ 123 رقم 1472. صحيح مسلم 2/ 711 رقم 1035.

অর্থ : একদা হাকীম বিন হিযাম (রাঃ) তিন তিনবার আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে যাচ্ঞা করলে তিনি তাঁকে প্রত্যেক বারেই দান করলেন। শেষবারে তিনি বললেন, ওহে হাকীম! এই মাল তরোতাজা মিষ্টি (ফলের মত)। সুতরাং যে তা নিজের প্রয়োজন মত গ্রহণ করবে, তাকে তাতে বরকত দান করা হবে। পক্ষান্তরে যে মনে লোভ রেখে তা গ্রহণ করবে, তাকে তাতে বরকত দেওয়া হবে না। তার অবস্থা হবে সেই ব্যক্তির মত, যে খাবে অথচ তৃপ্ত হবে না। আর উপুড়হস্ত চিতহস্ত অপেক্ষা উত্তম। এই কথার পর হাকীম কসম খেয়ে বলেছিলেন যে, তিনি এরপর আর কারো কাছে কিছু চাইবেন না। করেছিলেনও তাই এমনকি তিনি দুনিয়া থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। (বুখারী ১৪৭২, ২৭৫০, ৩১৪৩, মুসলিম ২৪৩৪, তিরমিযী ২৪৬৩, নাসাঈ ২৬০২-২৬০৩)

অতঃপর আলোচনা করেন, ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ এডভাজারিং কমিটির চেয়ারম্যান আল্লামা গিয়াসুদ্দিন তালুকদার (হাফি.)। তাঁর ইলমী ও তথ্যবহুল আলোচনা সীরাত কনফারেন্সের মানকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিলো। তিনি কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রামাণ্য সীরাত আলোচনা করেছেন। আল্লাহ সকলকে জাযায়ে খায়ের দান করুন, আমীন।

প্রবীণ ব্যক্তিত্বগণের পাশাপাশি তরুণ ও যোগ্যরাও উপস্থিত ছিলেন। ড. শফিউল্লাহ কুতুবী, মাওলানা মুহাম্মদ নূর আনোয়ারী, মাওলানা তোহা দানিশ, মাওলানা মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ, মাওলানা খন্দকার হামিদুল্লাহ, মাওলানা সগীর আহমেদ চৌধুরি, মাওলানা আফিফ ফুরকান, অধ্যাপক আলাউদ্দিন চৌধুরী, মাওলানা হাছান মাহমুদ ফয়সাল, মাওলানা মাহমুদ মুজিব প্রমুখ।

পরিশেষে দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়ার উপ-পরিচালক আল্লামা ফুরকানুল্লাহ খলীলের দুআ ও মুনাজাতের মাধ্যমে কনফারেন্সের সমাপ্তি ঘোষিত হয়।

অভিমত: সীরাত কনফারেন্স স্মারক প্রকাশ, বিষয় ভিত্তিক আলোচনা, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে আনন্দমুখর সীরাত চর্চা অনুষ্ঠানটি নিঃসন্দেহে একটি উপভোগ্য ও শিক্ষনীয় অনুষ্ঠান ছিলো। এমন অনুষ্ঠান বার বার হওয়া প্রয়োজন। আগামীতে আরো সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যাবে ‘‘আল্লামা আবুল খাইর ফাউন্ডেশন’’ এবং ‘‘রিসালাতুল খাইর’’। এটিই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।

শিক্ষক: আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ