মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


ইসলামী অর্থনীতি ও আধুনিক অর্থনীতির মৌলিক রুপরেখা!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী আনাস হুসাইন।।

সম্পদ সীমিত কিন্তু চাহিদা অফুরন্ত–এটা আধুনিক অর্থনীতির স্লোগান। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা আধুনিক অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য৷ কিন্তু ইসলাম এর সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম মনে করে, একজন মানুষের অফুরন্ত চাহিদা তাকে স্বার্থপর করে তোলে। চাহিদা সীমিত করে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা ইসলামের আদর্শ। আর এটা ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতির পার্থক্য দর্শনগত।

পুঁজিবাদীর মূল কথা হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজের উপার্জিত সম্পদের মালিক; তার সম্পদে অন্য কারো কোনো অংশ থাকবে না। এ অর্থব্যবস্থায় মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। তা যে কোনো উপায়ে হতে পারে। ব্যয় করারও নির্দিষ্ট কোন সিমারেখা নেই।যে কোনো উপায়ে খরচ করতে পারে।

চাইলে তা কুক্ষিগতও করে রাখতে পারে। যেমন, এক ব্যক্তি চাইলে মদ ও মানব প্রচার করে কোটিপতি হতে পারে। আবার সে চাইলে তা মদ্যপান ও গর্হিত কাজে ব্যয়ও করতে পারে। এই অর্থব্যবস্থায় সম্পদ উপার্জনে ও ব্যায়ে কোনো নৈতিক আদর্শ নেই। সম্পূর্ণ স্বাধীন।এ ব্যবস্থা মানুষকে লোভী, স্বার্থপর ও হিংস্র করে তোলে। ভোগ-বিলাসই জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করে দেয়। এ অর্থব্যবস্থায় ধনী আরো ধনী হয়, দরিদ্র হয় আরো দরিদ্র।

পক্ষান্তরে ইসলাম বলে দেয়, সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা। আল-কুরআনের বাণী : হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। (সূরা বাকারা,১৭২)

ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ আল্লাহ মানুষকে সাময়িকভাবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। তাই সম্পদের উপার্জন করতে হবে আল্লাহর সন্তোষজনক উপায়ে। আর তা ব্যয়ও করতে হবে তাঁর নির্দেশিত পথে। এভাবে নির্দিষ্ট সীমার মাঝে থেকে সে যে কোনো পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করতে পারে, আবার ব্যয়ও করতে পারে। তবে তা কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না। বরং সমাজের মানুষের উপকারে তা ব্যয় করতে হবে।

এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য ঝলক দিয়ে ওঠে। ইসলাম মুসলমানকে অর্থ উপার্জন করার অবাধ সুযোগ দেয় না। বরং উপার্জনের পন্থা ও উপায়ের ক্ষেত্রে মানবতার স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ ও অবৈধতার পার্থক্য করে।

এ পার্থক্যের একটা মূলনীতি রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, অর্থ উপার্জনের যেসব পন্থা ও উপায় অবলম্বন করলে এক ব্যক্তির লাভ ও অন্য ব্যক্তির ক্ষতি হয় তা সবই অবৈধ।

অন্য দিকে যেসব উপায় অবলম্বন করলে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ন্যায়সঙ্গত সুফল ভোগ করতে পারে তা সবই বৈধ। এ মূলনীতিটি কুরআন মজীদে নিম্নোক্তভাবে বিবৃত হয়েছেঃ হে ঈমানদারগন! তোমরা পরষ্পরের ধন-সম্পদ অবৈধ ভাবে ভক্ষন করো না।
তবে পারষ্পরিক সম্মতি অনুযায়ী ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারো। আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে (অথবা পরষ্পর পরষ্পরকে) ধ্বংস করো না।

আল্লাহ তোমাদের অবস্থার প্রতি করুণাশীল। যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে যুলুম সহকারে এরূপ করবে তাকে আমি অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবো। (সূরা আন
নিসাঃ২৯-৩০)

ইসলামী অর্থনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হচ্ছে এই যে, বৈধ উপায়ে যে ধন উপার্জন করা হবে তাও পুঞ্জিভূত করে রাখা যাবেনা। কারণ এর ফলে নানান সংকট তৈরি হয় এবং সম্পদ -বন্টনে ভারসাম্য থাকে না। এতে মানুষ মারাত্নক দুনিয়া লোভী হয়ে যায়। এতে দেশের মানুষ অর্থ কষ্টে পরে। এটা মানবতা বিরোধী জঘন্যতম অপরাধ। এই ব্যাপারে আল্লাহ তা'য়ালা বলে “যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপণতা করে, তারা যেন একথা মনে না করে যে, তাদের এ কাজ তাদের জন্য মঙ্গলজনক বরং প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকারক । ”-(সূরা আলে ইমরানঃ ১৮০) যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও । ”- (সূরা আত তাওবাঃ ৩৪)

একনই পুঁজিবাদের মাথায় বাঁশের আঘাত। উদ্বৃত্ত অর্থ জমা করে রাখা এবং জমাকৃত অর্থ আরো অধিক পরিমান অর্থ সংগ্রহে খাটানো এটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের মূল কথা। কিন্তু ইসলাম আদতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ জমা করে রাখা পছন্দ করেনা।

তিন: ইসলাম অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ নয়,ব্যয় করার শিক্ষা দেয়। ব্যয় করার অর্থ বিলাসিতা,আয়েস-আরামের জীবনযাপন করে দু’হাতে টাকা উড়ানো নয়। বরং খরচের ক্ষেত্রে আল্লাহর পথের শর্ত আরোপ করে। অর্থাৎ সমাজের কোন ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে সমাজের জন্য কল্যানমূলক কাজে ব্যয় করতে হবে। এটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়।

এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার বাণী হল, “তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে যে, তারা কি ব্যয় করবে? তাদেরকে বলে দাও, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত (তাই ব্যয় করো)”–(সূরা আল বাকারাঃ ২১৯)

“তাদের অর্থ সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে। ”(সূরা আয যারিয়াতঃ ১৯) এখানে এসে ইসলাম ও পুঁজিবাদের দৃষ্টিকোনের আকাশ পাতাল ব্যাবধান।

পুঁজিবাদ মনে করে, অর্থ ব্যয় করলে দরিদ্র হয়ে যাবে এবং সঞ্চয় করলে বিত্তশালী হবে। কিন্তু ইসলাম বলে, অর্থ ব্যয় করলে কমে যাবেনা বরং বরকত ও বৃদ্ধি হবে।

বিত্তবান মনে করে, সম্পদ আহরন করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করলে সম্পদ বেড়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, সুদের মাধ্যমে বরং সম্পদ কমে যায়। সৎকাজে অর্থ নিয়োগ করলেই সম্পদ বেড়ে যায়

“আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন ও দান-সাদকাকে প্রতিপালন ও ক্রমবৃদ্ধি করেন। (সূরা আল বাকারাঃ ২৭৬) তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখো, আল্লাহর নিকট তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাকাত বাবদ যে দান করে থাকো একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে। ”(সূরা আর রূমঃ ৩৯)

ব্যয় করলে অর্থ বেড়ে কিভাবে? ব্যয়িত অর্থ কেবল নষ্টই হবেনা কেন? দান করলে যাকাত দিলে অতিরিক্ত লাভ ও কল্যাণসহ পূর্ণ মাত্রায় ফিরে আসবে, এটা কিভাবে সম্ভব?

অন্যদিকে সুদী ব্যবসায় অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থ হ্রাস ও লোকসানের সূচনা করবে। এটা কিভাবে সম্ভব। এই বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে অদ্ভূত। বিষ্ময়কর। অনেকে মনে করবে সম্ভবত এগুলো নিছক আখেরাতের সওয়াবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার।

নিঃসন্দেহে আখেরাতের সওয়াবের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এ দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সম্পদ যদি শুধুই সঞ্চয় করা হয়, ব্যবসায়ে নিয়োগ করা হয়, তাহলে সীমাবদ্ধ হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা প্রতিদিন কমে যেতে থাকবে।

কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় সর্বত্র মন্দাভাব দেখা দেবে। জাতীয় অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌছে যাবে।শেষ অবস্থা এই হবে পুঁজিপতিরাও নিজেদের সঞ্চিত ধন-সম্পদ অর্থ উৎপাদনের কাজে লাগাবার সুযোগ পাবে না। এজন্যই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, (সুদের পরিমান যত বেশীই হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য”।)

আর সম্পদ ব্যয় করলে, যাকাত ও সাদকা করলে, সকলের হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়-ক্ষমতার অধিকারী হয়। শিল্পোৎপাদন বেড়ে যায়।সবুজ ক্ষেতগুলো শস্যে ভরে ওঠে। ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি হয়। কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ হয় না। সবার অবস্থা হয় সচ্ছল। সমাজ হয় সমৃদ্ধিশালী। এর সত্যতা যাচাই করতে হলে আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।

লেখক: সাহিত্যিক, তিলাটিয়া, ফুলপুর, ময়মনসিংহ

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ