শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


যেমন ছিলেন হাসান বসরি রহ:

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাসান মুরাদ।।

হাসান বসরি রহ. এর উপাধী আবু-সাইদ। তার পিতা ইয়াসার; যাইদ ইবনু ছাবেত রা. এর আযাদকৃত গোলাম। তার মা খাইরা; উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা রা. এর আযাদকৃত দাসী। আম্মাজানের ঘরেই খাইরা খিদমত করতেন। হাসান রহ. তখন ছোট। কোলের শিশু। মাঝেমধ্যে খুব কাঁদতেন। মা খাইরা কাজে ব্যস্ত থাকতেন। মা বিনে অবুঝ শিশুর কাঁদা কে থামাবে? তখন উম্মে সালমা রা. হাসান বসরিকে কোলে নিতেন। এবং নিজ স্তনের দুধ পান করাতেন।

ধারণা করা হয়, নবী পরিবারের বরকতশিক্ত হয়েই হাসান বসরি রহ. শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী হতে পেরেছেন। হাসান হযরত ওমর রা. এর শাহাদাতের দু’বছর পূর্বে মদিনাতে জন্ম গ্রহণ করেন। ওমর রা. এর কাছে বিভিন্ন সময় পুষ্প শিশুদের দোয়ার জন্য আনা হতো। একদিন অন্যান্য শিশুদের সাথে হাসানকেও আনা হলো। তখন ওমর রা.হাসানের জন্য দোয়া করলেন “হে আল্লাহ তুমি হাসানকে দ্বীনের ফিকহ দান করো। এবং মানুষের কাছে তার ভালোবাসা বাড়িয়ে দাও”। ওমর রা. দু’টো দোয়াই আল্লাহ কবুল করেছেন।

হাসান বসরি রহ. সকলের প্রিয় ছিলেন। ছিলেন সুখে, দুঃখে মানুষের আস্থাভাজন। ভালোবাসার উদার বৃক্ষ। আরো ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ আলিম, ফকীহ, নির্ভরযোগ্য, দুনিয়াবিমুখ, ইবাদতকারী, সুঠামদেহী, স্পষ্টবাদী, বিশুদ্ধভাষী। হাসান বসরি রহ. হযরত উসমান রা. এরও বরকত লাভ করেছেন। উসমান রা. সাথে জুমার সালাত আদায় করতেন। প্রিয় নবীর সাহাবাদের স্নেহধন্য হয়ে হাসান রহ. এমন মর্যাদাবান হয়েছেন। একবার হযরত আনাস বিন মালিক রা.এর কাছে একজন মাসয়ালা জানতে চাইল। আনাস বিন মালিক রা. বললেন, তোমরা আমাদের প্রিয় ভাজন হাসানের কাছে জিজ্ঞাসা করো।

লোকেরা বলল; আমরা আপনার কাছে প্রশ্ন করছি, আর আপনি হাসানের কথা বলছেন? আনাস রা বললেন, নিশ্চয় আমরা শুনেছি,হাসানও শুনেছে। তবে আমরা ভুলে গেছি আর হাসান মনে রেখেছে। হযরত কাতাদা বর্ণনা করেন: আমরা হাসান অপেক্ষা বড়ো আলেম আর কাউকে দেখিনি। ওমর বিন আব্দুল আযিয রহ. খলিফা হয়ে হাসান বসরি রহ.কে বসরার কাজি বানালেন। আর বললেন; হাসান বসরি হলো শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের অন্যতম। কাজি (বিচারক) নিযুক্ত থাকাকালীন হাসান বসরি রহ.কোনদিন সরকারি ভাতা গ্রহণ করেননি।

হাসান রহ. এর বেড়ে ওঠে মদিনাতেই। পরে মায়ের সাথে বসরাতে প্রস্থান করেন। সে থেকেই নামের শেষে বসরি লকব যুক্ত করা হয়। বাকি জীবন বসরাতেই অতিবাহিত করেছেন। দেখতে ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দর। রাতজেগে ইবাদত করতেন। সর্বসময় আখেরাতের চিন্তায় চিন্তিত থাকতেন। চেহারায় থাকত ভীতির ছাপ। নামাজে দাড়িয়ে, নির্জন ঘরে খুব কাঁদতেন। আর বলতেন, ক্রন্দন মানুষকে আল্লাহর রহমতের দিকে ডেকে নিয়ে যায়। ইয়াযিদ বিন হাওশাব রহ.বর্ণনা করেন: হাসান বসরি এবং ওমর বিন আব্দুল আযিযের রহ. অবস্থা দেখে মনে হতো জাহান্নাম শুধু তাদের দুজনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

হাসান বসরি রহ.জীবনে দু’বার হজ্ব করেছেন। কাবুলে আব্দুর রহমান বিন সামুরা রা.এর সাথে জিহাদ করেছেন। সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার, আরবি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে এবং সম্মানিত ৪ মাস (আশহুরে হুরম) রোযাগুলো জীবনভর রাখেছেন। রাসুল রা. এর প্রতি ভালোবাসা ছিল অবর্ণনীয়। রাসুল সা.মসজিদে নববীতে একটি খেজুর কাঠে হেলান দিয়ে মিম্বারে বসতেন। সাহাবীদের সংখ্যা বেড়ে গেলে মসজিদে স্থান সংকুলান হলো না। তাই রাসুুল সা.তখন একটি মিম্বার বানাতে নির্দেশ দিলেন। তারপর সে খেজুর কাঠটি সরিয়ে দিলেন। এতে কাঠটি বাচ্চাদের মত ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। তারপর রাসুল সা.উঠে গিয়ে কাঠটিকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলেন।

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন :হাসান বসরি রহ.এ হাদীস বর্ণনা করে খুব কাঁদতেন,আর বলতেন; একটি জড় বস্তু কাঠ প্রিয় নবীর প্রেমে কাঁদে, অথচ আমরা কাঁদতে পারি না। হাসান রহ.কোন জিনিস ক্রয় করলে দাম ক্রয়মূল্য থেকে বাড়িয়ে দিতেন। কোন জিনিস বিক্রি করলে নিজ থেকে মূল্য কমিয়ে দিতেন। আর বলতেন, মানবতা ছাড়া আর কোন বিষয় উত্তম হতে পারে না

উপদেশ: ১. মালেক ইবনে দিনার রহ. হাসান বসরির রহ. কাছে জানতে চাইলেন ,আলিমের শাস্তি কি? উত্তরে বললেন; অন্তর মরে যাওয়া। আবার বললেন,অন্তর মরে যাওয়ার কি অর্থ? উত্তরে হাসান বসরি রহ. বললেন, আখেরাতের আমলের মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জন করা।

২. মানুষ যখন নেক আমল করে তখন তার অন্তর নুরপূর্ন হয় এবং শরীরে শক্তি সঞ্চর হয়। আর যখন বদ আমল করে তখন অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। এবং শরীর দূর্বল হয়।

৩. মুমিনগণ দুনিয়াতে আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দেয়, তাই তারা আখেরাতে নিরাপদ থাকবে। আর মুনাফিকগণ দুনিয়াতে আল্লাহর ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে তাই তারা আখেরাতে ভীতু হবে।

৪. মুসলমানের লক্ষণ হলো, দ্বীনে শক্তিশালী হওয়া,কোমলতা প্রদশ্রনে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া, ইয়াকীনের সাথে ঈমান থাকা, বিদ্যায় প্রজ্ঞাবান হওয়া, হকের পথে দান করা, আনুগত্যের পাশাপাশি হিতকামনা করা, উৎসাহ-উদ্দীপনায় তাকওয়া অবলম্বন করা, বিপদে পবিত্রতা ও ধৈর্যধারণ করা, প্রবৃত্তে ও লোভে আকৃষ্ট না হওয়া, চোখের খিয়ানত না করা।

৫. যখন বিপদ নেমে আসে তখন কে আল্লাহর দাসত্ব করে আর, কে গায়রুল্লার দাসত্ব করে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
৬. যার পরিধেয় পাতলা, তার দ্বীনও পাতল। যার দেহ মোটা, তার দ্বীন জীর্ণ। যার খাদ্য যত সুস্বাদু,তার উপার্জন তত গন্ধময়। মুমিনের পুজি হলো দ্বীন।যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বীন আছে,ততক্ষণ তার পুজি আছে।চলার পথে দ্বীন কখনো মুুমিনের বিপক্ষে কাজ করে না।

৭.মুমিন তার আত্নার নিয়ন্ত্রক। আল্লাহর সুন্তুষ্টির জন্য যে আত্নো-পর্যালোচনা করে কিয়ামতে তার হিসাব হবে হালকা । আর যারা পর্যালোচনা ব্যাতীত দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করে,কিয়ামতে তাদের হিসাব কঠিন হবে।
৮.পচন যেমন দেহে দ্রুত ছাড়িয়ে শরীর নষ্ট করে,অনুরুপ গীবত দ্বীনের মধ্যে ছড়িয়ে আমল নষ্ট করে। সূত্র: সিয়ারু আ’লামীন নুবালা, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আত-তারিখুল কাবির, আত-তবাকাতুল কুবরা।

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক,দারুস সুন্নাহ মাদরাসা,ভেড়ামারা,কুষ্টিয়া।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ